নতুন করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দুই মাস হতে চললেও এটি ছড়ানোর কারণ এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। শুরুতে চীন বলে আসছিল, এটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না। তবে এটি যে ছোঁয়াচে তা পরিষ্কার হতে খুব একটা সময় লাগেনি।
কিন্তু এরই মধ্যে এমন অনেক রোগীও মিলেছে যারা সম্প্রতি চীন ভ্রমণ করেননি, আবার করোনা আক্রান্তের সংস্পর্শেও যাননি। এ ধরনের রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় শুক্রবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও)। সংস্থার মহাপরিচালক ড. তেদ্রোস আধানম গেব্রিয়েসুস বলেছেন, এমন পরিস্থিতিতে ভাইরাসটিকে ঠেকানোর সুযোগ সংকুচিত হয়ে আসছে।
ডাব্লিউএইচও মহাপরিচালক আরো বলেন, ‘যেসব সংক্রমণের কারণ পরিষ্কার নয়, যেমন করোনা প্রাদুর্ভাব এলাকায় ভ্রমণবৃত্তান্ত নেই অথবা আগে কোনো আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসারও কোনো উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে না, সেসব সংক্রমণ নিয়ে আমাদের উদ্বেগ আছে। ইরানে নতুন করে আক্রান্ত হওয়া এবং মৃত্যুর ঘটনা খুবই উদ্বেগজনক।’
গেব্রিয়েসুস বলেন, চীনসহ অন্যান্য দেশ যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঠেকানোর এখনো সুযোগ আছে। সম্ভাব্য মহামারি ঠেকাতে সব দেশকে আরো বেশি প্রস্তুত থাকতে হবে।
গত কয়েক দিন ধরে চীনে নতুন করোনাভাইরাসের প্রকোপ গড়পড়তা কিছুটা কমেছে। তবে এ সময়ে চীনের বাইরে বিভিন্ন দেশে প্রকোপ বাড়ছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় গতকাল আক্রান্ত হয়েছে ১৪২ জন। গত দুই দিনে ইতালিতে দুজন ও ইরানে একজন মারা গেছেন। আগের দিনও ইরানে দুজনের মৃত্যু হয়। সব মিলিয়ে চীনের মূল ভূখণ্ডের বাইরে সাতটি দেশে এ পর্যন্ত ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে এ ভাইরাসে।
ডাব্লিউএইচও মহাপরিচালক বলেন, চীনে সংক্রমণ কমার খবরটি আশাব্যঞ্জক। তবে সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ে এখনই ভবিষ্যদ্বাণী করা খুব আগাম হবে।
তিনি বলেন, দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থা আছে যেসব দেশে, সেসব দেশেই ভাইরাসটির সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া নিয়ে উদ্বেগ আছে। এ রোগ যাতে অন্যান্য দেশে মহামারি আকার না নেয় সে জন্য এখনই সর্বোচ্চ তৎপরতা চালানো জরুরি। এখনো এই ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তবে যত সময় যাচ্ছে, সুযোগ ততই কমে আসছে।
গত ৩১ ডিসেম্বর চীনের হুবেই প্রদেশে নতুন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রথম শনাক্ত হয়। নিউমোনিয়ার মতো লক্ষণ নিয়ে নতুন এ রোগ ছড়াতে দেখে চীনা কর্তৃপক্ষ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাকে সতর্ক করে। এরপর ১১ জানুয়ারি প্রথমবারের মতো একজন কভিড-১৯ রোগে মারা যান। এরপর ৩০ জানুয়ারি বৈশ্বিক জরুরি স্বাস্থ্য অবস্থা ঘোষণা করে ডাব্লিউএইচও।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শুরুটা কিভাবে তা এখনো পরিষ্কার হয়নি। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, হুবেই প্রদেশের উহান নগরীর একটি সি ফুড মার্কেটের কোনো প্রাণী থেকে এ ভাইরাস প্রথম মানুষের শরীরে আসে। তা ছাড়া এখন পর্যন্ত এ ভাইরাসের কার্যকর কোনো প্রতিষেধক উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়নি।
চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন জানিয়েছে, গত শুক্রবার চীনে নতুন সংক্রমণের সংখ্যা কমেছে। এদিন দেশটির মূল ভূখণ্ডে ৩৯৭ জনের শরীরে নতুন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। আগের দিন এই সংখ্যা ছিল ৮৮৯ জন। মৃতের সংখ্যাও কমে গেছে। বৃহস্পতিবার ১১৮ জনের মৃত্যু হলেও পরদিন প্রাণ হারিয়েছে ১০৯ জন।
শুক্রবার রাত ১২টা পর্যন্ত দেশটির মূল ভূখণ্ডে সংক্রমিত হয়েছে মোট ৭৬ হাজার ২৮৮ জন। মারা গেছে দুই হাজার ৩৪৫ জন। সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছে ২০ হাজার ৬৫৯ জন। ফলে সেখানে বর্তমানে রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৩ হাজার ২৮৪ জনে।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা জানিয়েছে, চীনের বাইরে ২৯টি দেশে নতুন করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে অন্তত এক হাজার ৪৮৪ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৭২৭ জন কভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে জাপানে। যার মধ্যে ৬৩৪ জনই ইয়োকোহামা বন্দরের কাছে পৃথক করে রাখা প্রমোদতরী ডায়মন্ড প্রিন্সেসের যাত্রী ও ক্রু।
ইতালিতে দুজনের মৃত্যু : গত দুই দিনে ইতালিতে কভিড-১৯ রোগে দুজন মারা গেছেন। গতকাল মারা যাওয়া নারী দেশটির লমবারদি অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন। দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এএনএস জানিয়েছে, দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় শিল্পপ্রধান এলাকায় ভাইরাসটির সংক্রমণ বিস্তার লাভ করে এ পর্যন্ত ৩০ জনকে আক্রান্ত করেছে। এর আগে শুক্রবার রাতে পার্শ্ববর্তী ভেনেতো অঞ্চলের পাদুয়া শহরের একটি হাসপাতালে কভিড-১৯-এ আক্রান্ত ৭৮ বছর বয়সী এক ব্যক্তি মারা যান। ছোট শহর ভোগে ইউগানিওর এই বাসিন্দা দুই সপ্তাহ আগে পাদুয়ার হাসপাতালটিতে ভর্তি হয়েছিলেন। ইতালিতে নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা এটি।
আরও পড়ুন :
করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে ডব্লিউএইচও’র পরামর্শ
ফেব্রুয়ারিতে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ কমবে
করোনা ভাইরাস : চীন ফেরতদের তালিকা তৈরির নির্দেশ
করোনা ভাইরাস : চীনে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৭০
করোনা ভাইরাস : সচেতনতা ও করণীয়
ইরানে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫ : গতকাল ইরানে কভিড-১৯ রোগাক্রান্ত এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। আগের দিন মারা যান দুই ব্যক্তি। সব মিলিয়ে দেশটিতে মোট পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যকেন্দ্রের প্রধান কিয়ানুশ জাহানপুর গতকাল জানিয়েছেন, ইরানে এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে ৭৮৫ জনকে পরীক্ষা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে নতুন করে ১০ জনের শরীরে এই ভাইরাসের অস্তিত্ব ধরা পড়েছে। এর আগে ১৮ ব্যক্তির শরীরে করোনাভাইরাস ধরা পড়ায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ২৮ জনে।
ইরানে বেশির ভাগ আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে রাজধানী তেহরানের দক্ষিণে পবিত্র শহর কোমে। এটি শিয়া মুসলিমদের জন্য জনপ্রিয় এলাকা।
দক্ষিণ কোরিয়ায় আক্রান্ত বেড়ে ৩৪৬ : চীনের মূল ভূখণ্ড ও জাপানে আটকা প্রমোদতরীর পর সবচেয়ে বেশি কভিড-১৯ আক্রান্তের দেশে পরিণত হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। দেশটির রাজধানী সিউলের কেন্দ্রীয় এলাকাগুলোতে জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। গতকাল নতুন করে ১৪২ জন সংক্রমিত হয়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৪৬ জনে। এর আগে বৃহস্পতিবার চেয়ংদোর একটি হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত হয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রথম মৃত্যু ঘটে। দায়েগু শহরের একটি গির্জায় সমাবেশে অংশ নিয়েছিলেন করোনা আক্রান্ত এক নারী। এর পর থেকে সেখানে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।