করোনা: শিক্ষকদের বেতন না দেয়ার অজুহাত খুঁজছে টাকাওয়ালা স্কুল-কলেজগুলো

নিজস্ব প্রতিবেদক |

তাদের ফান্ডে রয়েছে কোটি কোটি অলস টাকা। অধ্যক্ষের কক্ষের টাইলসেই খরচ করে আড়াই কোটি টাকা। মাসে চা নাস্তার খরচ কোটি টাকার ওপরে। প্রধান সহকারীর বেতনই ৬৫ হাজার টাকা। একাধিক ব্যাংকে জমানো টাকার বার্ষিক সুদও হয় কয়েক কোটি টাকা। কিন্তু করোনায় এই ক্রান্তিকালে এইসব নামী-দামী ও ধনাঢ্য প্রতিষ্ঠানগুলোই তাদের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রতিষ্ঠানিক বেতন না দেয়ার অজুহাত খুুঁজছে। এসব প্রতিষ্ঠানে রয়েছে শত শত ননএমপিও শিক্ষক। ধনাঢ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর এমপিওভুক্ত শিক্ষকরাও প্রতিষ্ঠান থেকে মোটা অংকের টাকা পেয়ে থাকেন। ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ থাকায়  মাত্র একমাসের টিউশন ফি আদায় করতে পারেনি রাজধানীর এসব এমপিওভুক্ত ও ধনাঢ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এতেই তারা বলে বেড়াচ্ছে তারা নাকি আর্থিক সংকটে পড়েছে! তাদের এই অসৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বরাবরের মতোই এগিয়ে এসেছে কতিপয় কম প্রচার সংখ্যার পত্রিকা ও কম দর্শকের টিভির নামধারী সাংবাদিকরা। ধনাঢ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান ও পরিচালনা পর্ষদের ইচ্ছায় প্রকাশিত ও প্রচারিত হয় এইসব রিপোর্ট। চটকদার শিরোনাম দিয়ে প্রকাশ করা এসব রিপোর্টের শিরোনাম দেখে মনে হবে হ্যা সত্যিই স্কুল-কলেজগুলোর সংকটের কথাই তুলে ধরেছে মনে হয়। এমন ভেবে এইসব রিপোর্ট নিজ নিজ ফেসবুক গ্রুপেও শেয়ার দেন অনেক শিক্ষক। বাস্তবে ধনাঢ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ফান্ডে জমানো টাকা এই দু:সময়েও শিক্ষকদের পেছনে খরচ না করার একটা অজুহাত মাত্র।

আজ রোববার ১২ এপ্রিল এমনই একটা জাতীয় দৈনিক পত্রিকার একটি রিপোর্টের অংশ বিশেষ তুলে ধরছি দৈনিক শিক্ষার পাঠকের জন্য। তুলনামূলক কম প্রচারসংখ্যার পত্রিকাটি লিখেছে: “রাজধানীর বড় ও খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানরা বলছেন, অনেকটা আকস্মিকভাবেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তারা। এমন অবস্থা সামাল দেওয়ার জন্য তেমন কোনো আর্থিক প্রস্তুতিও নেই প্রতিষ্ঠানের। মার্চ মাসের বেতন টেনেটুনে পরিশোধ করা হলেও চলতি মাসে কীভাবে বেতন-ভাতা দেবেন, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন তারা। তবে সবচেয়ে বিপদে পড়েছে ছোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের আয় কম।

রাজধানীর নামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ফৌজিয়া রেজওয়ান সম্প্রতি  বলেন, বেইলি রোডের মূল শাখাসহ তার প্রতিষ্ঠানের চারটি শাখায় প্রতি মাসে তিন কোটি ২২ লাখ টাকা শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে হয়। তারা মার্চ মাসের বেতন দিয়েছেন। তবে করোনার প্রভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে এপ্রিলের বেতন মে মাসে গিয়ে কীভাবে দেবেন, তা ভেবে পাচ্ছেন না। মে মাসে ঈদুল ফিতর থাকায় শিক্ষক-কর্মচারীদের ঈদ বোনাসও দিতে হবে। অধ্যক্ষ ফৌজিয়া জানান, তাদের প্রতিষ্ঠানে প্রতি তিন মাসের বেতন একসঙ্গে নেওয়া হয়। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বেতন তাদের আদায় করা ছিল। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে পড়ায় এপ্রিল থেকে জুনের বেতন নেওয়া হয়নি। 

পত্রিকাটি আরো লেখে: “রাজধানীর বৃহৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। মতিঝিলের মূল শাখা ছাড়াও বনশ্রী ও মুগদাপাড়ায় এর শাখা রয়েছে। ২৮ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর এই প্রতিষ্ঠানে প্রতি মাসে আড়াই কোটির বেশি টাকা বেতন-ভাতা দিতে হয় বলে জানালেন অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগম। তিনি বলেন, আমরা সাধারণত তিন মাসের বেতন একসঙ্গে নিয়ে থাকি। তবে জানুয়ারির বেতন ও ভর্তি ফি একসঙ্গে নেওয়া হয়। অনেকে এখনও জানুয়ারির বেতনই দেননি। ফেব্রুয়ারি ও মার্চের বেতন মার্চের ৫, ১৫ ও ২৫ তারিখে পরিশোধের জন্য নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। ১৭ মার্চ থেকে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় টিউশন ফি আদায় করা যায়নি। এদিকে ঈদের আগে প্রতিষ্ঠান খোলা অনিশ্চিত। না খুললে প্রতিষ্ঠানের ৬২৫ শিক্ষক ও দুই শতাধিক কর্মচারীর বেতনের ব্যবস্থা করতে হবে গভর্নিং বডিকে। সবকিছু নির্ভর করছে তাদের সিদ্ধান্তের ওপর।

সেচ্ছায় এমপিও ত্যাগ করা মিরপুরের মনিপুর স্কুলটি নিয়ে কি লিখেছে দেখুন: মিরপুরের মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের মূল শাখার পাশাপাশি আরও তিনটি শাখা রয়েছে শেওড়াপাড়া, ইব্রাহীমপুর ও রূপনগরে। এ প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ মো. ফরহাদ হোসেন বলেন, তাদের শিক্ষক-কর্মচারী মিলে জনবল ৮৫০-এর বেশি। তাদের প্রতি মাসে বেতন দিতে হয় চার কোটি টাকার বেশি। টিউশন ফি ছাড়া তাদের প্রতিষ্ঠানের আর কোনো আয় নেই। করোনার বন্ধ দীর্ঘায়িত হলে তাই সমস্যা হবে। তিনি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হলেও প্রতিষ্ঠানের অফিস কয়েকদিনের জন্য খুলে দেওয়া গেলে অভিভাবকরা এসে টিউশন ফি দিয়ে যেতে পারতেন।

দৈনিক শিক্ষার অনুসন্ধানে জানা যায়, এসব পত্রিকার প্রতিবেদনগুলো শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠানিক বেতন-ভাতা না দেয়ার বা কম দেয়ার পক্ষে যুক্তি হিসেবে দেখানো হবে। বলা হবে, দেখছেন পত্রিকার রিপোর্ট? শুথু আমাদের না সব স্কুল-কলেজের একই অবস্থা। 

মিরপুরের মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে নামে প্রতিমাসে সাড়ে ১৪ লাখ টাকা এমপিও বাবদ দেয়া হয়। কিন্তু গত তিনবছর ধরে ওই টাকা তারা তোলেন না। এমপিও নেয়ার আবেদনে প্রতিষ্ঠানটির এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জোর করে সই আদায় করার অভিযোগ প্রতিষ্ঠানটির প্রধান ফরহাদ হোসেনের বিরুদ্ধে। তিনি একটি নামকাওয়াস্তে টিভি চ্যানেলে কথিত অনুষ্ঠান উপস্থাপন করেন। সেখানে নিজেকে শিক্ষক ও সাংবাদিক পরিচয় দেন। অথচ জীবনে সাংবাদিকতা কি তা-ই জানেন না এই অবৈধভাবে থাকা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। মনিপুর স্কুলটিকে যিনি তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন সেই সফদর আলী স্যারকে তাড়িয়ে দিয়েছে স্থানীয় সংসদ সদস্যরা। অর্থকষ্ট ও মনোকষ্টে তিনি মারা গেছেন কয়েকবছর আগে।   

অনুসন্ধানে জানা যায়, শুধু নাম প্রকাশের লোভ সামলাতে না পেরে কতিপয় শিক্ষক নামধারী কিছু সাংবাদিককে তাদের গণমাধ্যমে প্রকাশের জন্য মতামত দিয়ে থাকেন।  এভাবে প্রতিবেদনটাকে জায়েজ করে নামধারী সাংবাদিকরা আর এতে বুঝে না বুঝে রসদ জোগায় কম পরিচিত ও সত্যিকার আর্থিক সংকটে থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। 

এদিকে, টাকাওয়ালা ও আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের মালিকানাধীন কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যে শিক্ষকদের বেতন কমিয়ে দিয়েছে। করোনার অজুহাতে এই অপর্কমটি করেছেন তারা।  

শিক্ষকদের বেতন পরিশোধ না করার বিষয়টি স্বীকার করেন ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান ও গাইবান্ধা-১ আসনের সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী সাংবাদিকদের বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি জমা নিতে পারিনি। নতুন শিক্ষার্থী ভর্তিও বন্ধ রয়েছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় চালু হলেও অনেক শিক্ষার্থী ফিরে আসবে না। বিশেষ করে আমাদের চার শতাধিক বিদেশী শিক্ষার্থী ছিল, তাদের বেশির ভাগই ব্যাক করবে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের দেয়া টিউশন ফির টাকায় চলে। তাদের কাছ থেকে টাকা না এলে শিক্ষকদের বেতন পরিশোধ করব কীভাবে? 

শিক্ষকদের বেতন হয়নি ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিরও। বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন।

আরও পড়ুন: শিক্ষকদের বেতন কাটছেন টাকাওয়ালা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মালিকরা

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, করোনার এ সংকট তো বিশ্বব্যাপীই। আসলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তো কারো অনুদানে চলে না। নিজস্ব আয়ের মাধ্যমেই শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বেতন দিতে হয়। এখন আমাদের যদি আয় না হয়, তাহলে বেতন পরিশোধ করা যাবে না, এটাই স্বাভাবিক। বড় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ থেকে বেতন দিচ্ছে। এছাড়া বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ই আর্থিক সংকটে পড়ে গেছে। 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল - dainik shiksha ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0024709701538086