করোনা সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে ৪৫ জেলা

নিজস্ব প্রতিবেদক |

দেশের ৪৫টি জেলা এখন করোনাভাইরাস সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এ হিসাবে দেশের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি জেলাই করোনা সংক্রমণের জন্য উচ্চ ঝুঁকি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার শর্ত অনুযায়ী, শনাক্তের হার ১০ শতাংশে পৌঁছালে তা ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়। গত এক সপ্তাহের হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এসব জেলায় শনাক্তের হার ১০ থেকে ৪০ শতাংশের মধ্যে থাকছে। উচ্চ সংক্রমিত জেলাগুলোকে স্বাস্থ্য বিভাগ 'এ', 'বি' ও 'সি' তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছে। 'এ' ক্যাটাগরির ১০ জেলায় শনাক্তের হার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। এর মধ্যে একমাত্র পিরোজপুর ছাড়া বাকি ৯ জেলা সীমান্তবর্তী।

সীমান্তবর্তী ৩০ জেলার মধ্যে ২১টিই উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে রাজশাহী বিভাগের সীমান্তবর্তী জেলাগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। এ বিভাগের দুই জেলায় শনাক্তের হার ৪২ শতাংশের বেশি। 'বি' ক্যাটাগরির ১৪টি জেলায় শনাক্তের হার ২০ থেকে ২৯ শতাংশের মধ্যে এবং 'সি' ক্যাটাগরিতে থাকা ২১ জেলায় শনাক্তের হার ১০ থেকে ১৯ শতাংশ। এত দিন সংক্রমণের শীর্ষে থাকা ঢাকা এখন রয়েছে মধ্যম ঝুঁকিতে। গত এক সপ্তাহে এখানে শনাক্তের হার ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতাত্ত্বিক পর্যালোচনায়ও শনাক্ত ও মৃত্যুর হার বৃদ্ধির তথ্য উঠে এসেছে। করোনার ২৩তম সপ্তাহের রোগতাত্ত্বিক পর্যালোচনা গতকাল শনিবার শেষ হয়েছে। আগের সপ্তাহের তুলনায় পরবর্তী সপ্তাহে রোগতাত্ত্বিক সূচকে কী পরিবর্তন হয়, তা এই পর্যালোচনায় উঠে আসে। নমুনা পরীক্ষা, শনাক্ত, সুস্থতা ও মৃত্যু- এই চারটি সূচক এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয়। এ হিসাবে ২২তম সপ্তাহের সাপেক্ষে ২৩তম সপ্তাহে নমুনা পরীক্ষা বেড়েছে ২ দশমিক ৪৩ শতাংশ। শনাক্তের হার বেড়েছে ২৭ দশমিক ২০ শতাংশ, সুস্থতার হার বেড়েছে ২১ দশমিক ৪৯ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার বেড়েছে ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ।

স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের মতে, করোনার ভারতীয় ধরন 'ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট' শনাক্ত হওয়ার পর সীমান্তের জেলাগুলোতে প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়ছে। ঈদে যাতায়াতের ফলে অন্য জেলাগুলোতেও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। সীমান্তবর্তী কয়েকটি জেলায় রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। শয্যা সংকটে রোগী ভর্তি করা সম্ভব হচ্ছে না কোনো কোনো হাসপাতালে। জেলা-উপজেলা শহরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণে সীমান্তের সাত জেলায় গত মে মাসে লকডাউনের সুপারিশ করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্য ও রোগতত্ত্ববিদদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি। কিন্তু সাতক্ষীরা ছাড়া আর কোনো জেলায় এখনও লকডাউন দেওয়া হয়নি। এর বাইরে কয়েকটি ইউনিয়ন ও পৌরসভা পর্যায়ে লকডাউন ঘোষণা করেছে স্থানীয় প্রশাসন। তবে সুপারিশ না করলেও সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়ে যাওয়ায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় আগেই লকডাউন দেওয়া হয়।

ঝুঁকিপূর্ণ ৪৫ জেলা :'এ' ক্যাটাগরিভুক্ত সীমান্তবর্তী ৯ জেলা সাতক্ষীরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নড়াইল, রাজশাহী, নাটোর, যশোর, খুলনা, চুয়াডাঙ্গা ও লালমনিরহাটে শনাক্তের হার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশের মধ্যে। সীমান্ত এলাকার বাইরে পিরোজপুর জেলায় শনাক্তের হার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। 'বি' ক্যাটাগরিতে থাকা বাগেরহাট, জামালপুর, ফরিদপুর, নওগাঁ, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, রাজবাড়ী, নোয়াখালী, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, সিলেট, ঝিনাইদহ, গোপালগঞ্জ ও কুড়িগ্রাম- এই ১৪ জেলায় শনাক্তের হার ২০ থেকে ২৯ শতাংশ। 'সি' ক্যাটাগরিতে থাকা চাঁদপুর, রংপুর, সিরাজগঞ্জ, ফেনী, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম, ঝালকাঠি, কিশোরগঞ্জ, বরিশাল, বগুড়া, শেরপুর, নরসিংদী, জয়পুরহাট, সুনামগঞ্জ, মাদারীপুর, নীলফামারী, কক্সবাজার, গাইবান্ধা, গাজীপুর, লক্ষ্মীপুর ও হবিগঞ্জ- এই ২১ জেলায় শনাক্তের হার ১০ থেকে ১৯ শতাংশ।

আরও পড়ুন : দৈনিক শিক্ষাডটকম পরিবারের প্রিন্ট পত্রিকা ‘দৈনিক আমাদের বার্তা’

সীমান্তের ২১ জেলাই ঝুঁকিতে :রাজশাহী বিভাগের সীমান্ত সংলগ্ন জেলা রয়েছে চারটি। এর মধ্যে রাজশাহীতে শনাক্তের হার ৪২ দশমিক ৬৬ শতাংশ, চাঁপাইনবাবগঞ্জে শনাক্তের হার ৪৩ দশমিক ৪৮, নওগাঁয় শনাক্তের হার ২৩ দশমিক ৭২ এবং জয়পুরহাটে শনাক্তের হার ২৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ।

খুলনা বিভাগের মধ্যে সীমান্ত সংলগ্ন জেলা রয়েছে ছয়টি। এর মধ্যে শনাক্তের হার সাতক্ষীরায় সবচেয়ে বেশি। এই জেলায় শনাক্তের হার ৪৭ দশমিক ৫০। এরপর যশোরে শনাক্তের হার ৩২ দশমিক ৫৯, চুয়াডাঙ্গায় শনাক্তের হার ২৮ দশমিক ৪৯, ঝিনাইদহে শনাক্তের হার ১৭ দশমিক ৮৭, মেহেরপুরে শনাক্তের হার ১১ দশমিক ১৭ এবং কুষ্টিয়ায় শনাক্তের হার ১৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ।

দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব ও ফেসবুক পেইজটি ফলো করুন

চট্টগ্রাম বিভাগের সঙ্গে সীমান্তবর্তী জেলা রয়েছে ছয়টি। এর মধ্যে একমাত্র চট্টগ্রামে শনাক্তের হার ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। অন্য পাঁচ জেলায় শনাক্তের হার ১০ শতাংশের নিচে রয়েছে। এর মধ্যে কুমিল্লায় ৫ দশমিক ৪৬, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শনাক্তের হার ৫ দশমিক ০৭, ফেনীতে ৯, খাগড়াছড়িতে ২ দশমিক ৮ এবং রাঙামাটিতে ৪ দশমিক ১৪ শতাংশ। তবে সীমান্ত না থাকলেও নোয়াখালীতে শনাক্তের হার ১৭ দশমিক ১৯ এবং কক্সবাজারে ১০ শতাংশ।

রংপুর বিভাগে সীমান্তবর্তী জেলা রয়েছে ছয়টি। প্রতিটি জেলাই উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে লালমনিরহাটে শনাক্তের হার ৩০ দশমিক ২৯ শতাংশ, কুড়িগ্রামে শনাক্তের হার ২৭ দশমিক ৯৬ শতাংশ, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুরে শনাক্তের হার ২৫ শতাংশ করে, পঞ্চগড়ে শনাক্তের হার ১০ দশমিক ৯ শতাংশ এবং নীলফামারীতে শনাক্তের হার ১০ দশমিক ৭ শতাংশ।

ময়মনসিংহ বিভাগের সঙ্গে সীমান্তবর্তী জেলা রয়েছে চারটি। এর মধ্যে জামালপুরে শনাক্তের হার ২১ দশমিক ১৬ শতাংশ এবং শেরপুর ১২ শতাংশ। তবে ময়মনসিংহে শনাক্তের হার ৭ শতাংশ ও নেত্রকোনায় ৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

সিলেটের সঙ্গে সীমান্ত জেলা রয়েছে চারটি। এর মধ্যে দুটি ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে মৌলভীবাজারে শনাক্তের হার ২১ দশমিক ৬৫ শতাংশ ও সিলেটে ১৫ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। এর বাইরে সুনামগঞ্জে শনাক্তের হার ৮ দশমিক ২৩ শতাংশ এবং হবিগঞ্জে শনাক্তের হার ৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

তবে সীমান্ত না থাকলেও খুলনা জেলায় শনাক্তের হার ৩১ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এরপরই ফরিদপুরে শনাক্তের হার ২১ দশমিক ৩৬ শতাংশ, গোপালগঞ্জে ১৯ দশমিক ২৮ শতাংশ, টাঙ্গাইলে ১৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ, নোয়াখালীতে ১৭ দশমিক ১৯ শতাংশ, পিরোজপুরে ১৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং কক্সবাজারে ১০ শতাংশ রোগী শনাক্ত হয়েছে।

'সুপারিশ আমলে না নেওয়ার মূল্য' :বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, সংক্রমণ বৃদ্ধির পর সীমান্তবর্তী সাত জেলায় আরও এক সপ্তাহের লকডাউনের সুপারিশ করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞ কমিটি। কিন্তু কেন্দ্রীয় প্রশাসন থেকে বলা হলো, এলাকার পরিস্থিতি বিবেচনা করে স্থানীয় প্রশাসন লকডাউনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। অথচ সংক্রমণ বাড়লেও স্থানীয় প্রশাসন ওই জেলাগুলোয় লকডাউন দিচ্ছে না। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়, স্থানীয় প্রশাসনের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে তারা দায়মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন। সুপারিশ না মানার মূল্য দিচ্ছে জনগণ। ভাইরাসটি বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে। ধাপে ধাপে এটি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে। এতে ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ভারতীয় ধরনটি অধিক সংক্রমণপ্রবণ। এটি ভারতে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশে তা ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি ভয়ানক হতে পারে। সুতরাং এ বিষয়ে সরকারের উচিত ছিল, দ্রুততার সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। কারণ, ভাইরাসটির কমিউনিটি ট্রান্সমিশন ঘটেছে। মানে এটি ছড়িয়ে পড়ছে। অথচ নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্যোগ নেই বললেই চলে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, ভারতের সঙ্গে সীমান্তবর্তী জেলাগুলো নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ উদ্বিগ্ন। ওই জেলাগুলোতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকাদানের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার যে বিষয়গুলো রয়েছে, তা অধিকাংশ মানুষ মানছেন না। এটিই সংক্রমণ বৃদ্ধির আরেকটি কারণ। সুতরাং সবার প্রতি পরামর্শ- স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, মাস্ক ব্যবহার করুন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান - dainik shiksha সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! শিক্ষককে পিটিয়ে হ*ত্যা, চাচাতো ভাইসহ গ্রেফতার ৩ - dainik shiksha শিক্ষককে পিটিয়ে হ*ত্যা, চাচাতো ভাইসহ গ্রেফতার ৩ কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক কেনো বদলি চান - dainik shiksha শিক্ষক কেনো বদলি চান ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে - dainik shiksha ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0049278736114502