কর্মজীবনে পদপদবি ও অবসর জীবনে উপলব্ধি

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

জীবনের প্রতিটি স্তরই প্রতিযোগিতাপূর্ণ। শিক্ষাজীবনে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার মধ্যে বেড়ে উঠে চাকরিতে প্রবেশের জন্য অতিক্রম করতে হয় প্রতিযোগিতার বিশাল পর্বতমালা। কর্মক্ষেত্রে এসেও পড়তে হয় কঠিন প্রতিযোগিতায়। এ প্রতিযোগিতা যেন এক বিশাল লড়াই, যে লড়াই পদপদবির জন্য লড়াই। ক্যারিয়ার গঠনে নিজ প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও শুরু হয় প্রতিযোগিতা। উচ্চ পদপদবি পাওয়ার জন্য মানুষ বিভিন্ন পন্থায় দ্রুত ওপরে ওঠার চেষ্টা করে; উঠতে গিয়ে অনেকে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, আবার এরই মধ্যে কেউ-বা পৌঁছে যায় সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে। শুক্রবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, এই পদ-পদবিধারী ব্যক্তিরা সাধারণত ক্ষমতাবান হন এবং গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। গুরুত্বপূর্ণ পদ উপভোগ করেন। তাদের কাছে আত্মীয়স্বজন, সহকর্মী, বন্ধুরা অনেক সাহায্য-সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন; কিন্তু অন্যের প্রত্যাশা তেমন পূরণ হয় না। তবে দীর্ঘ চাকরিজীবনে অনেক চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে যৌবনের পুরো সময়টি অতিবাহিত করে যখন অবসরে যান, তখন তারা উপলব্ধি করেন তাদের ক্ষমতার কথা, সোনালি দিনের কথা, যা দিয়ে তারা সমাজ, বৃহৎ পরিবার, সহকর্মী, বন্ধু এমনকি নিজ প্রতিষ্ঠানের পূর্বসূরিদের কল্যাণেও অনেক কিছুই করতে পারতেন, কিন্তু তেমন কিছু করেননি। মাঝে মাঝে এই ভাবনাগুলো নিশ্চয়ই তাদের মনকে বিষণ্ন করে, কষ্ট দেয়।

পদপদবি ব্যক্তির মধ্যে অহংকার জন্ম দেয়। সমাজ ও প্রতিষ্ঠানে নিজেরাই শ্রেণির সৃষ্টি করেন। ভুলে যান এই পদপদবির ক্ষণস্থায়িত্বের কথা। যে পদে আজ একজন অধিষ্ঠিত আছেন, সেই একই স্থানে/পদে যে বা যারা অতীতে ছিলেন তাদেরও খুব বেশি স্মরণ করা হয় না। চাকরিজীবনে বহু বাঘা বাঘা কর্মকর্তা বাস্তবতার নিরিখে অবসরে এসে একেবারেই নিরীহ হয়ে যান। চাকরিতে থাকতে মানুষের এই উপলব্ধি হয় না। সম্পদের পাহাড়, দামি গাড়ি, দামি চেয়ার, আশপাশের চাটুকারদের মধ্যে যেন তারা খেই হারান। অনেকে আবার টাকার পেছনে ছুটতে গিয়ে পরিবারকেও প্রয়োজনীয় সময় দেন না, সন্তানরা সঠিকভাবে মানুষ হচ্ছে কি না তাও খেয়াল দেন না।

কিছু ঘটনা বলি। জামাল সাহেব দীর্ঘ ৩০ বছর একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। চাকরিতে থাকা অবস্থায় তিনি মরণব্যাধি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে প্রায় পাঁচ বছর আগে মারা যান। তার দীর্ঘদিনের সহকর্মীরা আজও নিজ নিজ পদে কর্মরত আছেন, অনেকে আরো বড়ো পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। কিন্তু মৃত্যুর পর জামাল সাহেবের পেনশনের পাওনা টাকার জন্য তার পরিবার কর্মস্থলের পুরোনো সহকর্মীদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করলেও এখন পর্যন্ত টাকা পায়নি এবং দিন যতই যাচ্ছে সহকর্মীরাও যেন অচেনা হয়ে যাচ্ছেন!

আব্বাস সাহেব সরকারি বড়ো কর্মকর্তা। তার পদ ও পদবি তাকে অনেক ক্ষমতাবান করেছে। তিনি নিয়মনীতি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পালন করেন, নিয়মের বাইরে কখনো যান না, যেন একজন কট্টর নিয়মপালনকারী। তার এই কট্টর পন্থার জন্য তিনি কাছের আত্মীয়, সহকর্মী, সাধারণ মানুষকে একদমই সাহায্য সহযোগিতা করতে পারেন না বা সাহায্যের চেষ্টাও করেন না। একসময় তিনি অবসরে গেলেন, ক্ষমতা পদপদবিবিহীন হয়ে পড়লেন। আত্মীয়স্বজন গ্রামবাসীরা তার সঙ্গে খুব বেশি মেশে না, তাদের কথা, এই লোক যখন চাকরিতে ছিলেন তখন চাইলেই অনেক মানুষের উপকার করতে পারতেন; কিন্তু নিজের ক্লিন ইমেজ ধরে রাখার জন্য কিছুই করেননি। অবসরে এসে আব্বাস সাহেব উপলব্ধি করেন নিয়মের মধ্যে থেকেও তিনি অনেকের উপকারে আসতে পারতেন!

লতিফ সাহেব অবসর জীবনযাপন করছেন। যখন চাকরিতে ছিলেন, তখন তিনি তার পদপদবি নিয়ে এতটাই অহংকারী ছিলেন যে, তার আচার-আচরণের জন্য কাছের মানুষগুলোও তার কাছে সাহায্যের জন্য যেত না। সহকর্মী ও অধীনস্থদের সঙ্গে অত্যন্ত রুঢ় আচরণ করতেন। তারাও এখন তাকে এড়িয়ে চলে। কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলে তার কাছে তেমন কেউ যায় না। অবসর জীবনে এসে লতিফ সাহেব এ বিষয়গুলো গভীরভাবে উপলব্ধি করেন এবং ভাবেন চাকরিতে থাকাকালে এ রূপ আচরণ না করলেও পারতেন!

ছালাম সাহেব ও রশিদ সাহেব দুটি প্রতিষ্ঠানে বড়ো দুই কর্মকর্তা এবং দুজনই বড়ো মাপের দুর্নীতিবাজ এবং তাদের প্রতিষ্ঠানও দুর্নীতিগ্রস্ত। তারা নিজেদের জন্য অঢেল সম্পদ করেছেন এবং তারা আত্মীয়স্বজন ও গ্রামবাসীর অনেক উপকার করেন। লোক দেখানো সমাজ সেবামূলক কাজও করেন অনেক। গ্রামের মানুষ তাদের গুণকীর্তন করে এবং সাহায্য-সহযোগিতা নিয়েও আবার পেছনে তাদের দুর্নীতিবাজ বলে গালি দেয়। অবৈধ টাকার পেছনে ছুটতে গিয়ে ছালাম সাহেব নিজ সন্তান ও পরিবারকে সময় দেননি, নিয়ন্ত্রণ করেননি। তবে রশিদ সাহেবের বিষয়টি একটু ভিন্ন, তিনি অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ দিয়ে সন্তানদের বিদেশ পাঠিয়েছেন, বিদেশে তারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, উচ্চশিক্ষিত হয়েছে ঠিকই তবে বৃদ্ধ পিতা-মাতার খোঁজখবর রাখে না। রশিদ সাহেবকে বাইরে থেকে সুখী মানুষ মনে হলেও ভেতরে তিনি সত্যিকারে নিঃস্ব; তার চাপা কান্না কিংবা দীর্ঘশ্বাস কেউ শুনতে পায় না।

আনিছ সাহেব সরকারি বড়ো কর্মকর্তা। তার পদপদবি তিনি উপভোগ করেন। তিনি সততার সঙ্গে তার প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন এবং নিজের যতটুকু সামর্থ্য আছে তা দিয়ে তার সহকর্মী, প্রতিষ্ঠানের পূর্বসূরি, আত্মীয়স্বজন ও গ্রামের লোকদের সাহায্য-সহযোগিতা ও সমস্যা সমাধানে সদা তত্পর থাকেন। নিঃস্বার্থভাবে তাদের জন্য ভালো উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং উপকার করার জন্য তিনি সচেষ্ট থাকেন। সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন, কর্মক্ষেত্রে একজন আস্থাভাজন, নিঃস্বার্থ ও আদর্শ মানুষ হিসেবে সবার কাছে পরিচিত। সন্তানরাও সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছে। কিছু দিন হলো তিনি অবসর গ্রহণ করেছেন। সব শ্রেণির মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে। বিভিন্ন পরামর্শের জন্য তার কাছে আসেন।

ওপরের চিত্রগুলো আমাদের কর্মময় জীবনের অসংখ্য চরিত্রের কয়েকটি মাত্র। পদপদবি পেতে একজন ব্যক্তিকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে হয়। আনিছ সাহেবের মতো নিজেকে একজন বিচার-বিবেচনাসম্পন্ন ব্যালান্সড মানুষ হিসেবে তৈরি করতে পারলেই চাকরিকালে ও অবসরজীবনে নিজেকে সার্থক মনে হবে। সেবাই ধর্ম সততাই সর্বোত্কৃষ্ট পন্থা। অহংকার মানুষকে সঙ্গীহীন করে। স্বপদে থেকে পূর্বসূরিদের সেবায় নিবেদিত হওয়ার শিক্ষাও একান্ত জরুরি। সহকর্মী ও অধীনস্থদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ পরিহার করা উচিত। ভালোবাসা দিয়ে যা অর্জন করা যায় তা কঠোরতার মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব নয়। আচরণ হলো বিনিয়োগ, যা সারা জীবন মুনাফা দেয়। আমাদের সবারই নিজ নিজ অবস্থানে, পদে থেকে রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানের জন্য, পরিবার ও প্রতিবেশীদের জন্য গঠনমূলক কিছু করা উচিত ।

লেখক : সৈয়দ মো. রফিকুল ইসলাম, প্রাক্তন অধ্যক্ষ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, জাহানাবাদ, খুলনা।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ - dainik shiksha বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি - dainik shiksha যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি - dainik shiksha তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ - dainik shiksha সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই - dainik shiksha শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী - dainik shiksha বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0023598670959473