কলেজ ছাত্রছাত্রী সমতা ৩ বছরের মধ্যেই

দৈনিক শিক্ষাডেস্ক: |

প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫০ দশমিক ৫৪ শতাংশই নারী। এর মধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রের তুলনায় ছাত্রীর অংশগ্রহণ বেশি। তবে সুখবর হচ্ছে, আগামী ৩ বছরের মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিকেও ছাত্রীর হারে দেশ সমতা অর্জন করবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কয়েক মাস আগে এ আগাম ঘোষণা দিয়েছে। সমতা অর্জনের পাশাপাশি উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার কমাতে সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। আজ শুক্রবার (১ ফেব্রুয়ারি) দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে একথা বলা হয়েছে। 

৩ বছরের মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিকে ছাত্রীর হারে সমতা অর্জনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ আগাম ঘোষণাকে উৎসাহ উদ্দীপক বলে আখ্যায়িত করেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী। তিনি বলেন, এটা ঠিক যে গত ৮ বছরে শতাংশের হিসাবে উচ্চ মাধ্যমিকে ছাত্রীর অংশগ্রহণের অগ্রগতি আশানুরূপ নয়। কেননা ২০০৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে ছাত্রী ভর্তির হার ছিল ৪৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ।

২০১৭ সালে এটা বেড়ে হয়েছে ৪৭ দশমিক ২৪ শতাংশ। বরং এর তুলনায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ছাত্রী বৃদ্ধির হার বেশি। তবে সংখ্যার বিচারে উচ্চ মাধ্যমিকে ছাত্রীর অংশগ্রহণ অনেক বেড়েছে। এটা আমাদের মধ্যে অনেক আশা জাগিয়েছে। আগামীতে উচ্চ মাধ্যমিকেও ছাত্রছাত্রীর হারে শুধু সমতা অর্জনই নয়, ছাত্রীর অংশগ্রহণ বেশি হবে বলেই স্বপ্ন দেখা যায়।

এ শিক্ষা বিশেষজ্ঞ বলেন, ১ দশক আগেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে সমতা অর্জিত হয়েছিল। কিন্তু নানা চ্যালেঞ্জের কারণে উচ্চ মাধ্যমিকে সমতায় আনার গতি মন্থর হয়ে যায়। সমতা অর্জনের ক্ষেত্রে অন্তত সাতটি প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জ দূর করতে হবে।

রাশেদা কে চৌধুরীর মতে, উচ্চ মাধ্যমিকে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকগুলোর শীর্ষে আছে নিরাপত্তাহীনতা। এছাড়া দূরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবস্থান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আবাসন সংকট, যাতায়াত সমস্যা, আর্লি ম্যারেজ (আগাম বিয়ে), কলেজ পর্যায়ে নারী শিক্ষকের স্বল্পতা এবং পুরুষ শিক্ষকের হাতে ছাত্রী নিগ্রহের দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হওয়া।

তিনি মনে করেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অপরাধ বিশেষ করে ছাত্রী ও নারী শিক্ষক নিগ্রহের যথাযথ বিচার না হলে সমতা অর্জন দূরের কথা, যেটা আছে সেটাও কমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। উচ্চ মাধ্যমিকে ছাত্রছাত্রীর হারে দেশ প্রায় সমতা অর্জনের পথে। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) শিক্ষার সর্বশেষ চালচিত্রের ওপর প্রকাশিত এক সমীক্ষা অনুযায়ী, বর্তমানে প্রাথমিকে মোট ছাত্রছাত্রীর মধ্যে প্রায় ৫১ শতাংশ ছাত্রী।

মাধ্যমিক শিক্ষায় আরও এগিয়ে মেয়েরা। এ স্তরে মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৫৪ শতাংশ ছাত্রী। এইচএসসি পর্যায়ে নারী-পুরুষের সমতা প্রায় প্রতিষ্ঠার পথে। ওই স্তরে ছাত্রীর অংশগ্রহণের হার ৪৭ দশমিক ২৪ শতাংশ।

গত বছর এসএসসি পরীক্ষার আগে এক সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ঘোষণা দেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বাংলাদেশ ছাত্র ও ছাত্রীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে সমতা অর্জন করেছে বহু আগে। আগামী তিনবছরের মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিকেও আমরা সমতা অর্জন করতে সক্ষম হবো। সেই লক্ষ্যে কর্মপন্থা নির্ধারণ ও কর্মসূচি চলছে।

বিগত কয়েক বছর ধরে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি), জেএসসি-জেডিসি ও এসএসসি পরীক্ষার পরিসংখ্যানেও দেখা গেছে, অংশগ্রহণেই শুধু বেশি নয়, সফলতায়ও নারীর হার বেশি।

গত ডিসেম্বরে পিইসি ও জেএসসি-জেডিসির ফল প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে পিইসিতে মোট অংশগ্রহণকারী ছাত্রীর মধ্যে ৯৭ দশমিক ৬৮ শতাংশই উত্তীর্ণ হয়েছে। মোট অংশগ্রহণকারী ছাত্রের মধ্যে পাস করেছে ৯৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। সংখার বিচারে প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার বেশি। সর্বোচ্চ সাফল্যের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত জিপিএ-৫ প্রাপ্তির দিক থেকেও ছাত্রী বেশি। ১,৬১,৪১১ জন ছাত্র জিপিএ-৫ পেয়েছে।

সেখানে ছাত্রীদের মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২,০৬,৭৮২ জন। অপরদিকে জেএসসি-জেডিসিতে অংশগ্রণহারী মোট ছাত্রের মধ্যে পাসের হার ৮৫ দশমিক ১২ শতাংশ। অথচ ছাত্রীদের মধ্যে পাসের হার ৮৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ।

এসএসসি-এইচএসসিতেও সাফল্যে নারীরা এগিয়ে। ব্যানবেইসের এ সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন ধারার আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি প্রফেশনাল, কারিগরি ও শিক্ষক শিক্ষায়ও নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে।

নারী শিক্ষার অগ্রগতিতে ধর্মকে অনেকেই প্রতিবন্ধক হিসেবে মনে করে থাকেন। কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষায় ছাত্রের চেয়ে ছাত্রীর অংশগ্রহণ ১০ শতাংশ বেশি। বর্তমানে মাদরাসার মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫৫ শতাংশের বেশি ছাত্রী।

উচ্চ শিক্ষায়ও দিন দিন বাড়ছে নারী। এ স্তরে বর্তমানে ৩২ দশমিক ৫৭ শতাংশই ছাত্রী। এছাড়া শিক্ষক শিক্ষায় নারীর হার ৪০ দশমিক ৬১ শতাংশ, কারিগরি ও ভোকেশনালে ২৪ শতাংশ, প্রফেশনাল শিক্ষায় ৪৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ এবং ইংরেজি মাধ্যমে ছাত্রীর হার ৩৮ দশমিক ২৫ শতাংশ।

জানা গেছে, ১০ ফেব্রুয়ারি ব্যানবেইস শিক্ষার চালচিত্রের ওপর আরেকটি বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে যাচ্ছে। সেটি অনুযায়ী ২০১৮ সালে মাধ্যমিকে লেখাপড়ায় ছাত্রী বেড়েছে ১১ লাখের বেশি।

এ স্তরে মোট ছাত্রছাত্রী প্রায় ১ কোটি ২৯ লাখ। এর মধ্যে ছাত্রী ৬৯ লাখ ৫২ হাজার। ২০১৭ সালে ছিল ৬৮ লাখ ৩৫ হাজার ৫৭৪ জন। বেড়েছে উচ্চ মাধ্যমিকেও। ২০১৭ সালে যেখানে ছাত্রী ছিল ১২ লাখ ৫০ হাজার ৬২৯ জন। সেখানে ২০১৮ সালে মোট ছাত্রী বেড়ে হয়েছে ১৪ লাখ ২ হাজার।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘শিক্ষার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্বে রোল মডেল। এ সফলতার পেছনে বড় অবদান রেখে আসছে মেয়েরাই।

তারা যে এগিয়ে এসেছে, এর নেপথ্যে কাজ করেছে একটি জিনিস- ‘সামাজিক চুক্তি’। সমাজে গতিশীলতা থাকলে শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়ে। নারী শিক্ষার অগ্রগতিতে ব্যক্তিপর্যায়ের অঙ্গীকার এবং ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ইতিবাচক ভূমিকাও সহায়ক প্রভাব রেখেছে।

আজকে দেখা যাচ্ছে, হেফাজতে ইসলামের অনুসারীদের প্রতিষ্ঠিত মাদরাসায়ও ছাত্রী আছে। নারী শিক্ষার অগ্রগতিতে আছে ভালো নীতিগুলোর ব্যাপারে সব সরকারের ঐকমত্য। সর্বোপরি রাজনৈতিক সদিচ্ছা আছেই।

তবে উচ্চ মাধ্যমিকে কত ছাত্রী বাড়ল তাতে আগ্রহ খুঁজে পান না বলে জানান গণসাক্ষরতা অভিযানের (ক্যাম্পে) উপপরিচালক কেএম এনামুল হক। তিনি বলেন, আগের স্তরে মোট কতজন পাস করল, আর তাদের মধ্যে কতজন পরবর্তী স্তরে ভর্তি হল সেটা এ মুহূর্তে গুরুত্ব দেয়ার সময় এসেছে।

সরকারি প্রতিষ্ঠান ব্যানবেইসের তথ্য অনুযায়ীই মাধ্যমিকে ২০১৭ সালে ৭৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ ভর্তি হয়েছে। এর মানে হচ্ছে পিইসি পাস করা বাকি ২৫ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে।

একই ভাবে এসএসসি পাস মাত্র ৪০ দশমিক ৫০ শতাংশ উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছে। অর্থাৎ ৬০ শতাংশই ঝরে পড়েছে। তাই মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে কতজন ছাত্রী সেটি আর বিবেচনার ক্ষেত্রে গুরুত্ব বহন করে না। তিনি বলেন, আগে এসএসসি ও এইচএসসিতে প্রকৃত ভর্তির হার শতভাগ করতে হবে। এরপর ছাত্রীর হার দেখতে হবে।

তিনি জানান, অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এট্আুই প্রকল্পের অধীনে আমার গ্রাম আমার শহর কার্যক্রমে ২০২৩ সালের মধ্যে প্রাথমিকে ৮০ শতাংশ, মাধ্যমিকে ৬০ ও উচ্চ মাধ্যমিকে ৫০ ছাত্রছাত্রীর লেখাপড়া সমাপনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।

এটা সার্থক হলে আগের স্তরে পাস করা শিক্ষার্থীর স্কুল-কলেজের বাইরে থাকার হার কমবে। রাজধানীর শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক আকলিমা বেগম বলেন, শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ বা সাফল্য ধরে রাখতে প্রতিবন্ধক চিহ্নিত, চ্যালেঞ্জ ও বৈষম্য চিহ্নিত করে দূর করতে হবে।

পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সর্বত্র কন্যাশিশুর নিরাপত্তাহীনতা। নারী শিক্ষায় বিনিয়োগ এখনও তুলনামূলক কম। কর্মস্থলে পুরুষ সহকর্মীর ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির ঘাটতি প্রকট। তিনি বলেন, রাষ্ট্রকে মনে রাখতে হবে, নারী শিক্ষার এ অগ্রগতির মূল কারণও নারী।

আর অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, নারী শিক্ষার অগ্রগতির ক্ষেত্রে বাল্যবিয়ের প্রকোপ প্রধান বাধা। বাল্যবিবাহ বা আগাম বিবাহের নানা কারণের একটি সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা।

নারী প্রগতির ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে ধর্ষণ, নিগ্রহ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে চলার পথে নিরাপত্তাহীনতা, সাইবার ক্রাইম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নামধারীদের হাতে ছাত্রী নিগ্রহ, চাকরিতে প্রবেশে বৈষম্য, অর্থপূর্ণ কর্মসংস্থানের ঘাটতি অন্যতম। এসবের কারণ খুঁজে প্রতিকারে ব্যবস্থা নিতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে।

সুত্র: যুগান্তর


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান - dainik shiksha সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা - dainik shiksha লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক কেনো বদলি চান - dainik shiksha শিক্ষক কেনো বদলি চান ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে - dainik shiksha ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0049431324005127