কল্পনা থেকেই মানুষের গবেষণার সৃষ্টি

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

অদ্ভুত কল্পনাগুলোকে প্রথমে অবিশ্বাস করেছে, উপহাস করেছে মানুষ। কোনোভাবেই সেগুলো মানতে চায়নি। নতুন কল্পনা ও ধারণা সৃষ্টির মানুষগুলো ধিকৃত, অপমানিত, অবহেলিত হয়েছে। শনিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, অনেক সময় প্রচলিত ধারণার বিপরীতে গিয়ে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছে, শাস্তি ভোগ করেছে। ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত হয়েছে। কিন্তু মানুষের অনেক কল্পনা যেগুলো প্রথমে অসম্ভব স্বপ্ন বলে মানুষ উড়িয়ে দিয়েছে, সেগুলোই একদিন সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। এর অর্থ কী? এর অর্থ হচ্ছে কল্পনা ও ভাবনাকে যখন অসম্ভব ও অবাস্তব বলে মনে হবে, তখনই ধরে নিতে হবে নতুন কোনো ধারণা বা আবিষ্কার পৃথিবীতে আসার আগাম বার্তা ঘোষণা করছে। সবকিছুই সময়নির্ভর।

সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের যুক্তি, চিন্তা ও বিশ্বাসের পরিবর্তন ঘটে। কোনো একটা সময়ের মানুষ কারও উদ্ভট কল্পনা ও ভাবনাকে পাগলামি বলে হাসাহাসি করেছে, অন্য সময়ের মানুষ সেটার জন্ম হতে দেখে বিস্মিত হয়েছে।

এ বিস্ময় থেমে থাকেনি, বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অগ্রসরমান ধারণায় রূপান্তরিত হয়েছে। সেটা ক্রমাগত বিকশিত হয়েছে আর এর সঙ্গে সঙ্গে আরও নতুন নতুন অদ্ভুত ধারণা ও মানুষের কল্পনা পৃথিবীর মানুষকে ভাবতে শিখিয়েছে। যুগে যুগে পাগলাটে ও উদ্ভট চিন্তা কারও কারও কাছে মহামূল্যবান হয়ে নতুন একেকটি ধারণাকে একেকটি কালজয়ী আবিষ্কারে পরিণত করেছে। ক্রমাগত মানুষ এ ধারণা দ্বারা বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হয়েছে, অলীক কল্পনা বাস্তব হয়ে মানুষের চিন্তার জগৎকেই পরিবর্তন করেছে। মৌলিক ধারণার ফলিত ফলাফল বিভিন্ন উপাদানে পরিণত হয়ে মানুষের জীবনের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। বহু উদ্ভট ও পাগলাটে ভাবনাকে ফেলে দেয়া যায়নি, বরং এগুলোই একদিন বিজ্ঞান হয়েছে। যে বিজ্ঞানের সূত্রপাত ঘটেছে ক্লান্তিহীন কিছু মানুষের রাত দিন এক করে ফেলা নোনা ঘামের বিনিময়ে, মেধা ও চিন্তার সংমিশ্রণে। যেটা তারা তিল তিল করে করেছে, গড়েছে, প্রমাণ করে কিংবা বানিয়ে দেখিয়েছে; সেটাই গবেষণা।

গবেষণার প্রথম ও শেষ কথাই হল পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কিছু নেই। প্রাচীনকালে মানুষ মনে করত পৃথিবী সমতল। এর কোনো শুরু বা শেষ নেই। সূর্য সম্পর্কে মানুষের মনে নানা ধরনের কৌতূহল ছিল।

কারও কারও ধারণা ছিল, প্রতিদিন একটা করে সূর্য তৈরি হয় আর ধ্বংস হয়। কেউ কেউ ভাবত সূর্য রথে করে ঘুরে বেড়ায়। আবার কেউ কেউ বিশ্বাস করত, নৌকায় করে সূর্যকে পূর্ব থেকে পশ্চিমে সরিয়ে আনা হয়। প্রাচীনতম ভারতীয় জনগোষ্ঠী ধারণা করত কয়েকটি হাতি পৃথিবীকে ধরে আছে, হাতিগুলো বসে আছে কচ্ছপের পিঠের ওপর। এ কচ্ছপগুলো আবার পানির ওপর সাঁতার কাটছে। এ ধরনের কয়েকটি অমূলক তথ্য সেসময় প্রচলিত ছিল। সে সময় মানুষেরা দূর-দূরান্তে যেতে ভয় পেত। ভাবত দূরে যেতে যেতে যদি পৃথিবীর কিনারা দিয়ে গভীর গর্তে পড়ে যায়। এরিস্টটল মনে করতেন, পৃথিবী সব সময় স্থির অবস্থায় আছে। সূর্য, গ্রহ, উপগ্রহ, তারকাপুঞ্জ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। মানুষের সে সময় ধারণা ছিল, পৃথিবীর অবস্থান মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে। মিসরীয় গণিতবিদ ক্লডিয়াস টলেমি পৃথিবীকে মহাকাশের কেন্দ্রে ধারণা করে বিশ্বজগতের মানচিত্র আঁকেন, যেটি চার্চের গুরুরা মেনে নেয়। টলেমির মডেলটি ছিল গোলাকার এবং সেখানে স্বর্গ এবং নরকের কথা উল্লেখ থাকায় চার্চ এটি মেনে নেয়। ১৫১৪ সালে পোলিশ পুরোহিত কোপার্নিকাস সূর্যকে কেন্দ্রে রেখে আরেকটি মডেলের ধারণা দেন।

চার্চের সঙ্গে মতবিরোধ হতে পারে- এ ভয়ে তিনি নিজের নাম প্রকাশ করেননি। গ্যালিলিও তার আবিষ্কৃত টেলিস্কোপের মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে, সূর্য সৌরমণ্ডলের কেন্দ্রে অবস্থিত এবং পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে। পরবর্তী সময়ে গ্যালিলিও ও কেপলার কোপার্নিকাসের এ পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন। পুরাতন মতবাদকে পরিবর্তন করে নতুন মতবাদ প্রদান করায় গ্যালিলিওকে গৃহবন্দি করা হয়। এর সঙ্গে দুটি শর্ত যুক্ত করা হয়।

এর প্রথমটি ছিল বাইরের কারও সঙ্গে দেখা করার অধিকার তাঁর থাকবে না, অন্যটি ছিল ইতালির বাইরে তিনি নিজের গবেষণালব্ধ ফলাফলকে প্রকাশ করতে পারবেন না। কিন্তু তিনি এ অন্যায় বিধিনিষেধ মেনে নেননি বরং বিজ্ঞানের সত্যের ওপর আত্মবিশ্বাস নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি তার জীবনের গভীর উপলদ্ধি থেকে বলেছেন, ‘ঈশ্বর আমাদেরকে অনুভূতি, যুক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু আমাদেরকে সেগুলোর ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন, এমন কথা আমি মানি না।’

সবচেয়ে বড় কথা হল, পৃথিবী আর সূর্য নিয়ে মানুষ কল্পনা করেছে। এগুলো নিয়ে নানাভাবে ভেবেছে, ভাবনার প্রতিফলন ঘটিয়েছে বিভিন্নভাবে। সেখানে বিজ্ঞান না থাকলেও সত্য-মিথ্যা নানা বর্ণের নানা ছন্দের কল্পনা ছিল। হতে পারে সেটা ভুল কিংবা অলীক, নিছক সাধারণ ভাবনা। কিন্তু এ কল্পনা ও ভাবনাগুলো একদিন গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানের সত্যে পরিণত হয়েছে।

এখনও গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানের সত্যের পেছনের সত্যকে খোঁজার প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে, থাকবে। পৃথিবীতে প্রাণীদের প্রাণ আছে; কিন্তু সবুজ লতাপাতায় জড়ানো উদ্ভিদের প্রাণ আছে এটা কি স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর আগে কেউ ভেবেছেন? ভাবেননি। তিনি যদি না ভাবতেন হয়তো এখনও আমরা জানতাম উদ্ভিত প্রাণহীন কিংবা জড়পদার্থ। উদ্ভিদেরও যে প্রাণ আছে, আমাদের দেশে বসেই এ বিজ্ঞানী প্রমাণ করেছেন।

সারা বিশ্বকে নতুন ধারণা দিয়ে বিজ্ঞান ও গবেষণার ইতিহাসকেই বদলে দিয়েছিলেন এ বাঙালি বিজ্ঞানী। কেবল মানসিক শক্তিকে আঁকড়ে ধরে তিনি এ ধরনের অনেক বিশ্বমানের গবেষণা করে গেছেন। তিনি তারই আবিষ্কৃত ক্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্রের সাহায্যে প্রমাণ করেছিলেন উদ্ভিদের প্রাণের অস্তিত্ব। এখন সারা পৃথিবীতে উদ্ভিদের জীবন আছে এ সত্যটি মেনে নানা ধরনের গবেষণা চলছে। আলবার্ট আইনস্টাইন বড় মাপের একজন বিজ্ঞানী হলেও তার কোনো পরীক্ষাগার ছিল না।

তিনি বিশ্বাস করতেন তিনটি জিনিস যদি মানুষের কাছে থাকে তবে গবেষণার মাধ্যমে মানুষ পৃথিবীকে বদলে ফেলতে পারে। এ তিনটি জিনিস হল- কাগজ, কলম আর চিন্তাশক্তি। এর মানে হচ্ছে, মানুষ যদি চিন্তাশক্তিকে ব্যবহার করতে পারে তবে সে নতুন নতুন উপাদান সৃষ্টি করতে পারে। মানুষ যখন বিভিন্ন আইডিয়া বা ধারণা নিয়ে ভাবতে থাকে, তখন তার চিন্তাশক্তি গড়ে ওঠে।

এ আইডিয়া কারও কারও কাছে রূপকথার গল্প মনে হতে পারে। কারও কাছে হাস্যকর বিষয় হতে পারে। কিন্তু পরনিন্দার ভয়ে মানুষ যদি আইডিয়া তৈরি করা বন্ধ করে দেয়, তবে গবেষণার মাধ্যমে পৃথিবীর সমৃদ্ধি সম্ভব হবে না।

আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় আইডিয়া তৈরির মাধ্যমে কীভাবে চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগানো যায়, সেটি নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। আমরা যদি প্রকৃতির দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকাতে পারি তবে প্রকৃতি থেকে আমরা নতুন নতুন ধারণা তৈরি করতে পারব। যেমন একটি গাছকে চিকিৎসাবিজ্ঞান, বায়োফুয়েল, সেলুলোজ, কাগজ, বায়োলুব্রিকেন্ট, ন্যানোফাইবার, ম্যাটেরিয়ালসহ বিভিন্ন কাজে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। কেবল দরকার একটার পর একটা আইডিয়া তৈরি করে সেটাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে বলব, তোমরা তোমাদের সৃষ্টিশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে উদ্ভট কিংবা বাস্তব যে কোনো ধরনের ধারণা তৈরি করার মনোভাব গড়ে তোলো। কারণ ভাবনাটা উদ্ভট না হলে সৃষ্টিটাও নতুন হয় না। আজ যেটা নতুন ভাবনা, সেটা আগামী দিনের গবেষণার সম্ভাবনা। পাখি নিয়ে না ভাবলে উড়োজাহাজ কিংবা রকেট তৈরি হতো না। মনের টানকে অনুভব না করলে মানুষ তথ্য, প্রযুক্তি ও যোগাযোগের আধুনিক ধারণা তৈরি করতে পারত না। টিকটিকির দেওয়াল বেয়ে চারপাশে ঘুরতে না দেখলে মানুষ রোবট কিংবা নিজেদের চারপাশে ঘোরানোর প্রযুক্তি তৈরি করতে সক্ষম হতো না। মানুষ চাঁদকে ভালো না বাসলে চাঁদে ও বিভিন্ন গ্রহে যাওয়ার মতো প্রযুক্তি গড়ে তুলতে পারত না। মানুষ পারে না, এমন কিছু পৃথিবীতে নেই। যে যেভাবে পারি সেভাবে ভাবতে থাকি। হয়তো এ কাল্পনিক ভাবনাগুলো একদিন কালজয়ী বিজ্ঞান ও আবিষ্কার হয়ে সভ্যতাকে এগিয়ে নেবে।

লেখক : ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী, অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও গাজীপুর।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029768943786621