নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়কাগজ কেনায় কারসাজি, কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক |

পরীক্ষায় ব্যবহারের জন্যে কাগজের পরিমাণ নির্ভর করে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যার উপর। সেখানে চাহিদা জানায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তর। এই চাহিদা ও কেনার প্রক্রিয়া ঘিরে অনিয়ম এবং অসাধু বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের বিরুদ্ধে। যার সত্যতাও মিলেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, খাতার চাহিদা প্রেরণ, টেন্ডার প্রক্রিয়া, ক্রয় থেকে মজুতকরণ ও বিতরণের হিসাব নিয়ে সংঘবদ্ধ কয়েকজন কর্মকর্তার সম্পৃক্ততার অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনিয়ম খতিয়ে দেখতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত শেষে প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে সেই কমিটি। বছরের পর বছর ধরে কাগজ ক্রয়ের এমন কারসাজি করে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।

তদন্তে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি চাহিদা প্রেরণ, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা, ক্রয়, ছাপা, মজুতকরণ, বিতরণ ও সংরক্ষণে সংশ্লিষ্টদের অবেহলা ও অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে কমিটি। শুধু তাই নয়, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুসরণ করে সংশ্লিষ্টদের থেকে তথ্য জানতে চাইলে সেখানেও মিলেছে গড়মিল।

২০২১ সালের ২৮ জুন ৭০ হাজার মূল উত্তরপত্র ও ৭০ হাজার অতিরিক্ত উত্তরপত্রসহ আরও ২৩টি উপাদান চাহিদাপত্র অনুযায়ী গ্রহণ ও মজুত করেন সাবেক পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নির্মল চন্দ্র সাহা। একই বছরের ৫ সেপ্টেম্বর নির্মল চন্দ্র সাহার চাকরিকাল শেষ হওয়ায় ভারপ্রাপ্ত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হিসেবে যোগদান করেন আবদুল হালিম। যোগদানের ৩ মাসের মাথায় ৮ ডিসেম্বর ২০২১ সালে ১ লাখ উত্তরপত্রসহ ২০টি উপাদান চেয়ে নমুনা ছাড়া চাহিদা প্রেরণ করেন তিনি। যেখানে চাহিদা প্রেরণের ৬ মাস পূর্বে ৭০ হাজার উত্তরপত্র মজুত করে দপ্তরটি।

বিশ্ববিদ্যালয়টির ২৪টি বিভাগের চাহিদা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বছরে ৩৫ হাজারের কাছাকাছি উত্তরপত্রের প্রয়োজন পড়ে। যেখানে প্রতিবছর দপ্তরটি সর্বনিম্ন ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ পর্যন্ত চাহিদা প্রেরণ করে এবং তা ক্রয়েরও অনুমোদন পায়। কিন্তু সেই উত্তরপত্রের ব্যবহার ও মজুতের সঠিক হিসাব দেখাতে পারেনি দপ্তরটি।

পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ভারপ্রাপ্ত) আবদুল হালিম বলেন, ‘আমি পূর্বের আহ্বান কিংবা মজুতের বিষয়ে জানতাম না। আমাকে জানানোও হয়নি। চাহিদা সৃষ্টি হওয়ায় ক্রয়ের জন্যে ব্যবস্থা নিতে বলেছি। আমি দায়িত্ব পাওয়ার পর তা সংরক্ষণের সঠিক হিসাব রাখতে কাজ করছি।’

তবে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ভারপ্রাপ্ত) আবদুল হালিমের এমন মন্তব্যের সত্যতা পায়নি তদন্ত কমিটি, যা তাদের (তদন্ত কমিটি) প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

এদিকে, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ও বিভাগগুলোর চাহিদা অনুযায়ী, ৭ হাজার ২৩২ জন শিক্ষার্থীর পরীক্ষার জন্যে সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার উত্তরপত্রের দরকার। যেখানে প্রয়োজনের চেয়ে কখনো দ্বিগুণ ও কখনো ৩ গুণ চাহিদা প্রেরণ করে তা ক্রয় করে বিশ্ববিদ্যালয়টি। এই প্রক্রিয়াটিকে অনিয়ম ও দুর্নীতি হিসেবে আখ্যা দিয়েছে তদন্ত কমিটি। যেখানে রেজিস্ট্রার, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও প্রকিউরমেন্ট অফিসারকে এই কার্যক্রমের জন্য দায়ী করেছে তদন্ত প্রতিবেদন।

শুধু তাই নয়, উত্তরপত্র ক্রয় ও মুদ্রণ কাজে অর্থনৈতিক অস্বচ্ছতার প্রমাণও মিলেছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, কর্ণফুলী পেপার মিল থেকে পেপার ক্রয়ের পর তা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনা-নেওয়া, লোডিং-আনলোডিং দেখিয়ে প্রত্যেকবারই ৫০ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। কিন্তু নথিতে লোডিং-আনলোডিং বাবদ ব্যয় দেখানো হলেও তা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে দেখা যায়নি। এমনকি নথিভুক্ত করা হয়নি স্টোরেও।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পেপার আনার কথা বলেন প্রকিউরমেন্ট অফিসার আহসানউল্লাহ রাসেল এবং পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. লিয়াকত হাসান। তবে স্টোর অফিসার নাজমুল হাসান এই পেপার আসার কথা অস্বীকার করেছেন। কাগজ পরিবহন খরচের হিসাব জানতে চাইলে মো. লিয়াকত হাসান একেকবার একেক পরিমাণ অর্থের কথা বলেন। পরিবহন বাবদ ব্যয়ের ৫০ হাজার টাকার গরমিলে সহকারী রেজিস্ট্রার মো. লিয়াকত হাসান ও প্রকিউরমেন্ট অফিসার আহসানউল্লাহ রাসেলের সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলেছে। অভিযোগ রয়েছে এ অর্থ তাদের মধ্যেই ভাগাভাগি হয়ে থাকে।

সম্প্রতি ইন্সপেকশনে অনিয়ম এবং দায়িত্বে অবহেলার কারণ দেখিয়ে সেই কমিটির প্রধান কাজী মাহবুব ইলাহী চৌধুরীকে কমিটি থেকে অব্যাহতি দেয় বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়টির স্টোরে খাতা পড়ে নষ্ট হতে দেখা যাবার দৃশ্যও দেখা গেছে। সেটি রক্ষণাবেক্ষণে তৎপর হোননি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক থেকে স্টোর পরিচালক।

পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরের বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ড. একেএম শামসুদ্দিন চৌধুরীর কাছে তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়টির রেজিস্ট্রার কৃষিবিদ ড. হুমায়ুন কবীর বলেন, অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সংযুক্ত ইবতেদায়ি শিক্ষকদের কপাল খুলছে - dainik shiksha সংযুক্ত ইবতেদায়ি শিক্ষকদের কপাল খুলছে মধ্যরাতে ববি-বিএম কলেজ শিক্ষার্থীদের সংঘ*র্ষ, আহত ২৫ - dainik shiksha মধ্যরাতে ববি-বিএম কলেজ শিক্ষার্থীদের সংঘ*র্ষ, আহত ২৫ সরকার পরিচালনায় ভুলত্রুটি থাকলে ধরিয়ে দিন, সম্পাদকদের ড. ইউনূস - dainik shiksha সরকার পরিচালনায় ভুলত্রুটি থাকলে ধরিয়ে দিন, সম্পাদকদের ড. ইউনূস এইচএসসি ফল তৈরি: পরীক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় তথ্য চেয়েছে বোর্ড - dainik shiksha এইচএসসি ফল তৈরি: পরীক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় তথ্য চেয়েছে বোর্ড শিক্ষায় বন্যার ক্ষত, চিন্তিত অভিভাবকরা - dainik shiksha শিক্ষায় বন্যার ক্ষত, চিন্তিত অভিভাবকরা শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য ও হেনস্তা নয়: শিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য ও হেনস্তা নয়: শিক্ষা উপদেষ্টা স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের আগস্ট মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের আগস্ট মাসের এমপিওর চেক ছাড় এনটিআরসিএর চেয়ারম্যান পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ডিজি হলেন - dainik shiksha এনটিআরসিএর চেয়ারম্যান পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ডিজি হলেন দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0052170753479004