কারাগারে গেলে পাবেন বাড়ির সুবিধা, খসড়া চূড়ান্ত

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

দেশের কারাগারগুলোকে ‘সংশোধনাগার’-এ রূপান্তর করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। কয়েদিদের কক্ষে থাকবে মানসম্মত বিছানাপত্র, পর্যাপ্ত আলো ও নির্মল বায়ু প্রবেশের ব্যবস্থা। আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত পোশাক-পরিচ্ছদ এবং বিছানাপত্র। মিলবে স্বাস্থ্যসম্মত পয়োনিষ্কাশনের সুযোগ। বন্দির শয়ন কক্ষের মেঝে সপ্তাহে অন্তত একবার জীবাণুনাশক দিয়ে ধোয়ামোছা করতে হবে। বন্দিদের জন্য থাকবে প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক ও নার্স।

থাকবে কাউন্সেলিংসহ উন্নত স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ। বন্দিদের নৈতিকতা শেখাতে থাকবে প্রয়োজনীয় সংখ্যক লাইব্রেরি ও কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও। গুরুত্ব পাবে বন্দির চিন্তা-চেতনা ও ধর্মানুভূতি। কারাবন্দিদের শরীরচর্চা, খেলাধুলা ও বিনোদনমূলক কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ রেখে ‘বাংলাদেশ কারা ও সংশোধন পরিষেবা আইন-২০২৩’ এর খসড়া চূড়ান্ত করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ। অনুমোদনের জন্য প্রস্তাবিত আইনের খসড়াটি শিগগিরই মন্ত্রিসভা বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। এটি কার্যকর হলে দেশের কারাগারগুলোতে মিলবে নিজ বাড়িঘরের সুযোগ-সুবিধা। বন্দিরা কারাগারেই ভোগ করবেন নাগরিক সুবিধাও।

খসড়ায় যা রয়েছে : প্রস্তাবিত কারা ও সংশোধন পরিষেবা আইনে বলা হয়েছে, বন্দির চিন্তা-চেতনা ও ধর্মানুভূতির প্রতি যথাযথ সম্মান দেখাতে হবে। কারা কর্তৃপক্ষ কারা ব্যবস্থাপনার দৈনিক কর্মসূচি এমনভাবে নির্ধারণ করবেন, যাতে বন্দিরা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান প্রতিপালন করতে পারেন। বন্দিরা যেন কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত স্ব-স্ব ধর্মীয় পুস্তকাদি পাঠের সুবিধার্থে নিজ হেফাজতে রাখতে পারেন। বিধি মোতাবেক বন্দিরা ব্যাংক চেক ও অন্যান্য আইনগত দলিলে স্বাক্ষর, টিপসই প্রদান করতে পারবেন। নারী বন্দিদের জন্য পরিবেষ্টনীসহ আলাদা ভবনে আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের প্রবেশ ও বহির্গমন পথ এমন হতে হবে, যাতে কারাগারের অন্য অংশ থেকে দেখা না যায়। নারী বন্দিদের বেষ্টনীতে তল্লাশির জন্য কোনো পুরুষ প্রবেশ করতে পারবে না।

মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত, দন্ডপ্রাপ্ত, বিচারাধীন, নারী, পুরুষ, কিশোর ও বিদেশিসহ কারাগারের ১৭ ধরনের বন্দির আলাদা আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে আইনের খসড়ায়। বলা হয়েছে-শিশু বন্দির জন্য আলাদা আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। কিশোর ও প্রাপ্তবয়স্ক বন্দিদের আলাদা রাখতে হবে। তাদের ন্যূনতম পরিমাপে ও আদর্শ মানসম্পন্ন শয়নস্থল ও বিছানাপত্র দিতে হবে। যেখানে স্বাভাবিক বা কৃত্রিম আলো ও নির্মল বায়ু প্রবাহের জন্য পর্যাপ্ত বায়ু সঞ্চালনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। বন্দির পোশাক-পরিচ্ছদ এবং বিছানাপত্র স্বাস্থ্যসম্মতভাবে রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থার পাশাপাশি পোশাক ধোয়ার জন্য সাবান ও সেলাইয়ের উপকরণ দিতে হবে। কর্তৃপক্ষের সম্মতিসাপেক্ষে বিচারাধীন বন্দিরা কারাগারের বাইরের অতিরিক্ত পোশাক-পরিচ্ছদ কেনার সুযোগ পাবেন। প্রত্যেক কারাগারে নির্ধারিত পদ্ধতিতে এক বা একাধিক ক্যান্টিন পরিচালিত হবে। বন্দিরা ব্যক্তিগত অর্থে খাবার ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কিনতে পারবেন।

স্বাস্থ্যসেবা প্রসঙ্গে খসড়ায় বলা হয়েছে, বন্দির মধ্যে গর্ভবতী নারী, নবজাতক কিংবা মায়ের সঙ্গে অবস্থানরত শিশু তাদের বিশেষ স্বাস্থ্য চাহিদা অনুসারে স্বাস্থ্যসেবা পাবেন। কারা স্বাস্থ্যসেবার মান জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ও মানদন্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। প্রত্যেক কারাগারে হাসপাতাল থাকবে। সেখানে সব সময় প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসকসহ অন্যান্য চিকিৎসা সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকবেন। নারী বন্দিদের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক নারী চিকিৎসক ও সহায়ক কর্মচারী থাকবেন। বন্দির কল্যাণ, মানসিক ও শারীরিক উৎকর্ষ এবং দক্ষতা উন্নয়নে কারাগারের নিরাপত্তা নিশ্চিত রেখে নানা ধরনের সুযোগ দিতে হবে।

শিক্ষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, বন্দির উন্নয়ন ও পুনর্বাসনের জন্য কারা অভ্যন্তরে শিক্ষা, কারিগরি দক্ষতা ও আইনগত সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালিত হবে। প্রত্যেক কারাগারে একটি করে পাঠাগার থাকবে। প্রয়োজনে কারা কর্তৃপক্ষ স্থানীয় গণগ্রন্থাগারের সহযোগিতা এবং সরকারি গণগ্রন্থাগার থেকে বই সংগ্রহ করতে পারবে। কারাগারে প্রশিক্ষণ শুরু করা বন্দির মেয়াদ শেষ হলে মুক্তির পরও তিনি প্রশিক্ষণ কোর্স শেষ করার সুযোগ পাবেন। এই কোর্স বন্দির অভিজ্ঞতা ও  ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থানের যোগ্যতা হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে কারাগারে কাউন্সেলিং করা তো দূরের কথা, চিকিৎসার জন্য-ই নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসক। কারা অধিদফতরের অধীনে দেশে ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার এবং ৫৫টি জেলা কারাগার রয়েছে। কারাগারগুলোর ধারণক্ষমতা ৪২ হাজার ৪৫০ জন। অথচ সেখানে রাখা হয়েছে ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ ৮০ থেকে ৮৫ হাজার বন্দি। তাদের জন্য মাত্র পাঁচজন চিকিৎসক রয়েছেন। ডিপ্লোমা নার্স ও ফার্মাসিস্টের ১৭৩টি পদের মধ্যে ১২২টিই শূন্য। কারা অধিদফতর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে সিভিল সার্জনের মাধ্যমে ১০৫ জন চিকিৎসক ডেপুটেশনে সংযুক্ত করেছে। তাদের সবাই ইন-হাউস নন। অনেকেই সিভিল সার্জন অফিস থেকে সকালে এসে ডিউটি করে বিকালে চলে যান। ফলে বন্দিদের বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার অভিযোগও একেবারে কম নয়।

বিভিন্ন কারাগারের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে নানা পর্যায়ে সরকারিভাবে তদন্ত হয়েছে। এসব তদন্তে কারা ক্যান্টিনের অনিয়ম, বন্দি বেচাকেনা, সাক্ষাৎ-বাণিজ্য, সিট-বাণিজ্য, খাবার-বাণিজ্য, চিকিৎসা, পদায়ন, জামিন-বাণিজ্যের মতো দুর্নীতির বিষয় উঠে এসেছে। এসবের সঙ্গে কিছু অসাধু কারা কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য জড়িত থাকার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। এই অনিয়ম-দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট খাত চিহ্নিত করে কারা ব্যবস্থাপনার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করার উদ্যোগ নেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আইন ও পরিকল্পনা) শওকত মোস্তফার নেতৃত্বে একটি কমিটিও করা হয়। ২০১৪ সালের ৬ আগস্ট কমিটির প্রথম বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে ডিজিটাল পদ্ধতি প্রবর্তনের গৃহীত সাক্ষ্যকে আইনের স্বীকৃতি প্রদানের ব্যবস্থা, প্রযুক্তিনির্ভর কারাগার মনিটরিং চালুর অংশ হিসেবে সিসিটিভি ক্যামেরা চালু, কারাগারের নাম সংশোধনাগার করা এবং দুর্ধর্ষ জঙ্গিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ প্রার্থীদের এনআইডির সত্যায়িত ফটোকপি, মোবাইল নম্বর ও ছবিসহ পূর্ণাঙ্গ বায়োডাটা নিয়ে সাক্ষাতের ব্যবস্থাসহ ১৫ দফা সুপারিশ করা হয়। সেই সুপারিশগুলোর আলোকেই প্রণয়ন করা হয়েছে প্রস্তাবিত বাংলাদেশ কারা ও সংশোধন পরিষেবা আইনটি।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষক লাঞ্ছিত ও পদত্যাগে বাধ্য করার প্রতিবাদ, কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি বিটিএর - dainik shiksha শিক্ষক লাঞ্ছিত ও পদত্যাগে বাধ্য করার প্রতিবাদ, কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি বিটিএর মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি - dainik shiksha মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি আন্দোলনে অসুস্থ ১১ নার্সিং শিক্ষার্থী - dainik shiksha আন্দোলনে অসুস্থ ১১ নার্সিং শিক্ষার্থী প্রধান শিক্ষককে জোর করে পদত্যাগপত্রে সই - dainik shiksha প্রধান শিক্ষককে জোর করে পদত্যাগপত্রে সই জলবায়ু পরিবর্তন মারাত্মক প্রভাব ফেলছে শিক্ষা খাতে - dainik shiksha জলবায়ু পরিবর্তন মারাত্মক প্রভাব ফেলছে শিক্ষা খাতে বয়স ৩৫ করার দাবিতে শাহবাগে চাকরি প্রত্যাশীদের মহাসমাবেশ - dainik shiksha বয়স ৩৫ করার দাবিতে শাহবাগে চাকরি প্রত্যাশীদের মহাসমাবেশ এমপিওভুক্তি: দীপু মনির ভাই টিপুচক্রের শতকোটি টাকার বাণিজ্য - dainik shiksha এমপিওভুক্তি: দীপু মনির ভাই টিপুচক্রের শতকোটি টাকার বাণিজ্য অধ্যক্ষকে পদত্যাগে বাধ্য, আওয়ামী লীগ নেতাকে স্থলাভিষিক্ত করার চেষ্টা - dainik shiksha অধ্যক্ষকে পদত্যাগে বাধ্য, আওয়ামী লীগ নেতাকে স্থলাভিষিক্ত করার চেষ্টা ভুয়া নিয়োগে এমপিও: এক মাদরাসার ১৫ শিক্ষকের সনদ যাচাই করবে অধিদপ্তর - dainik shiksha ভুয়া নিয়োগে এমপিও: এক মাদরাসার ১৫ শিক্ষকের সনদ যাচাই করবে অধিদপ্তর বার্ষিক পরীক্ষার উদ্দীপকসহ ও উদ্দীপক ছাড়া প্রশ্ন - dainik shiksha বার্ষিক পরীক্ষার উদ্দীপকসহ ও উদ্দীপক ছাড়া প্রশ্ন একসঙ্গে তিন প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন তুলতেন মাদরাসা কর্মচারী - dainik shiksha একসঙ্গে তিন প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন তুলতেন মাদরাসা কর্মচারী কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0031001567840576