দীর্ঘ ২৮ বছরের অচলাবস্থা কাটিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচন হওয়ায় শিক্ষার্থীরা নিজেদের অধিকার আদায়ের বিষয়ে আশাবাদী হয়ে ওঠেন। কিন্তু নির্বাচনের পর ছয় মাস অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত অভিষেক অনুষ্ঠানও করতে পারেননি ডাকসুর নতুন নেতৃত্ব। শিক্ষার্থীরা মনে করছেন, এ সংসদ তাদের প্রত্যাশা পূরণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। প্রত্যাশা-প্রাপ্তির খতিয়ানে অপ্রাপ্তির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডাকসুর ভিপির সঙ্গে জিএস-এজিএসের সমন্বয়হীনতা, অসহযোগিতা ও বৈরী সম্পর্ক। এক বছর মেয়াদের ছয় মাস চলে গেলেও শিক্ষার্থীদের আবাসন-সংকট নিরসনের কোনোই উদ্যোগ নেই। উল্টো এই সমস্যাকে পুঁজি করে নবীন শিক্ষার্থীদের গণরুমে রাখার বিনিময়ে কর্মসূচিতে ব্যবহার এবং হলের অতিথি কক্ষে দুর্ব্যবহারের মতো সমস্যাগুলো এখনও বহাল আছে। বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) দৈনিক সংবাদ প্রত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
ডাকসুর বিভিন্ন সম্পাদকের প্রচেষ্টায় শিক্ষার্থীদের জন্য বিচ্ছিন্ন কয়েকটি প্রোগ্রাম হলেও মূল নেতৃত্ব এখন পর্যন্ত ডাকসুর উদ্যোগে কোন প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করতে পারেননি। নির্বাচনের সময় ছাত্রদের আবাসন সমস্যার সমাধান, হল থেকে বহিরাগতদের বের করা, শিক্ষার বাণিজিকীকরণ বন্ধ, স্বাস্থ্যবীমা চালু, ক্যাম্পাসে বহিরাগত যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ, কেন্দ্রীয় ও হল লাইব্রেরিতে আসন সংখ্যা বাড়ানোসহ বিভিন্ন আশ্বাস দেয়া হলেও কার্যত কোন উন্নয়ন হয়নি।
ডাকসু নির্বাচনের প্রাক্কালে অনেকেই আশা প্রকাশ করেছিলেন যে, নির্বাচনটি হলে দেশে ছাত্র রাজনীতির বন্ধাত্ব ঘুচবে, নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ প্রশস্ত হবে, ছাত্রদের অধিকার আদায়ে ছাত্র সংগঠনগুলো ডাকসুর নেতৃত্বে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু বিষয়টা যে এত সহজ নয়, রাজনীতির গুণগত মান ঠিক না করে শুধু লোক দেখানো নির্বাচন করেই যে ছাত্র রাজনীতির সুস্থধারা ফেরানো যায় না ডাকসু নির্বাচনের মধ্যদিয়ে তাই যেন প্রমাণিত হলো। ডাকসু নির্বাচনের পর ভিপি নুরুল হক এ পর্যন্ত আটবার দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের হামলার শিকার হয়েছেন।
ডাকসু ভিপির পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানিত। অথচ সেই গুরুত্বপূর্ণ ছাত্র প্রতিনিধিকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছে ক্ষমতাসীন দল এবং তার সহযোগী ছাত্র সংগঠনের পরিচয়বহনকারী ছাত্রলীগ। ছাত্র প্রতিনিধির ওপর হামলা চালিয়ে ছাত্রলীগ গণরায়ের প্রতি অশ্রদ্ধা জানাচ্ছে, ছাত্রদের মতামতকে পদদলিত করছে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ শুধু ডাকসু ভিপিকেই পেটাচ্ছে না, কোন জবাবদিহিতা ছাড়া ডাকসুর বাজেটের অর্থ খরচ করছে, হলে গেস্টরুম কালচারের নামে অনাচার করছে, সাধারণ ছাত্রদের পেটাচ্ছে, জোর করে কর্মসূচিতে নিচ্ছে। এসব দেখার যেন কেউ নেই। অন্যদিকে সাধারণ ছাত্ররা যখন ডাকসুর ব্যাপারে হতাশার কথা শোনাচ্ছে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি একচেটিয়া বলে যাচ্ছেন ডাকসু ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। তিনি মুগ্ধ অর্থাৎ ডাকসুর ভূমিকা শিক্ষার্থীদের পক্ষে না গেলেও ভিসির পক্ষেই যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, ভিসি ডাকসুর এই দ্বন্দ্বদীর্ণ বাস্তবতা এবং শিক্ষার্থীদের দুরবস্থা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছেন। বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক।
আমরা মনে করি, এই অসঙ্গতির অবসান জরুরি। ডাকসুকে সুসংগঠিত করে এর অতীত ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হবে। গেস্টরুমে গুন্ডা-পান্ডা লালন নয়, বরং হল সংসদে সাংস্কৃতিক চর্চা, ক্রীড়া, বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে হবে। ছাত্রদের অধিকার আদায়ের পথে বাধা দেয়া যাবে না। ডাকসু ভিপিসহ কোন ছাত্র প্রতিনিধির গায়ে হাত তোলা যাবে না। এ অপরাধে কঠোর সাজা দিতে হবে। ডাকসু ভিপিকে তার স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে। সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতির পথ প্রশস্ত করতে হবে। সহনশীলতা আর উদারতার বিকাশ ঘটাতে হবে। মনে রাখা জরুরি, ডাকসু যদি সত্যিকার অর্থেই ছাত্র সংসদের ভূমিকা না রাখে তবে ডাকসুর নামে ‘সরকারি আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান’ কিংবা ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ পুষে লাভ নেই।