কিছু দুষ্টু লোকের অপতৎপরতায় শিক্ষাব্যবস্থা চরম চ্যালেঞ্জের মুখে

আমিরুল আলম খান |

সন্তানের মঙ্গলের জন্য বাবা-মা সব ত্যাগ স্বীকারে সব সময় রাজি থাকেন। বাবা-মার একমাত্র স্বপ্ন তাদের সন্তান যেন  পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্য কাজ করতে পারে। এজন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গুরুত্ব চরম দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসকারীরাও বোঝেন। তাই নিজেরা শত দুঃখ কষ্টের মধ্যে হাবুডুবু খেয়ে হলেও সন্তানের লেখাপড়ায় নিজের সর্বস্ব পণ করেন। এক সময় এদেশে গরীব মানুষদের শিক্ষার গুরুত্ব বোঝাবার জন্য শত শত কোটি টাকার প্রকল্প নিতে দেখেছি। প্রকল্পের মূল বার্তা ছিল আমাদের সমাজের মানুষ সন্তানের লেখাপড়ার গুরুত্ব বোঝে না। 

আমি ব্যক্তিগতভাবে সমাজের উচ্চকোটির মানুষদের এমন ধারণাকে মতলববাজি বলে মনে করি। আমার শৈশব-কৈশোরে, ষাটের  দশকে অজগাঁয়ের গরীব মানুষদের সন্তানের লেখাপড়া শেখানোর প্রাণান্ত প্রচেষ্টা দেখেছি। স্বীকার করতেই হবে, তখন তাদের সারাদিনে একবেলা ভাত জোটানো ছিল রীতিমত কষ্টকর। তাই প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানদের বাবা-মায়ের পেশায় কাজ করতে হতো। চাষীর সন্তান মাঠে, তাঁতীর সন্তান তাঁতে, শ্রমিকের সন্তান কষ্টকর শ্রমে নিয়োজিত হতো। মেয়েরা মাকে কাজে সহায়তা করত, অথবা পরের বাসাবাড়িতে গৃহস্থলী কাজ করে দুটো খেয়েপরে বেঁচে থাকার চেষ্টা করত।

স্বাধীনতার পরবর্তী প্রায় পঞ্চাশ বছরে দেশের অর্থনৈতিক খাতে বিপুল উন্নতি সাধিত হয়েছে। বৈষম্য পর্বতপ্রমাণ না হলে জনগণ তার সুফল ভোগ করত। দেশের খেটে খাওয়া মানুষ কঠোর পরিশ্রম করেই অর্থনীতির পালে জোর হাওয়া লাগিয়ে তাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। এই পরিবর্তনে বাবা-মা এখন আপন সন্তানের পিছনের লগ্নি বাড়িয়েছে। এখন বাবা-মা সন্তানের লেখাপড়ার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে তৈরি। 

মাত্র তিন দশক আগেও এদেশে প্রাথমিক শিক্ষার্থীকে পাঠ্যপুস্তক কিনে পড়তে হতো। তার চেয়ে বড় বিড়ম্বনা ছিল বছরের অর্ধেক কেটে গেলেও সব পাঠ্যবই কিনতে পাওয়া যেত না। ২০১০ সাল থেকে অবস্থার গুণগত পরিবর্তন ঘটে। বছরের প্রথম দিনই দেশের প্রথম থেকে নবম-দশম শ্রেণী পর্যন্ত সব শিশুর হাতে বিনামূল্যে বই পৌঁছে দিচ্ছে সরকার। কাজটি এক সময় প্রায় অসম্ভব বলে মনে হতো। কিন্তু সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা সেই দুরূহ কাজটিই সম্পন্ন করেছে। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সাফল্য সমগ্র জাতি কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ রাখবে। 

গত এক দশক ধরে শিক্ষাক্ষেত্রে এই প্রাথমিক ও অতি জরুরি কাজটি সাফল্যের সাথে সম্পন্ন করা সম্ভব হলেও শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন কিছু উৎপাত বা দুষ্টু লোকের অপতৎপরতা শিক্ষাব্যবস্থাকে চরম চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। সরকারের বিপুল বিনিয়োগ ও প্রচেষ্টা বানচাল করতে একটি স্বার্থান্বেষী মহল উঠেপড়ে লেগেছে বলে মনে হয়। তারা সমাজে এটা প্রতিষ্ঠা করতে চায় যে, বাংলাদেশে কোনও স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেখানো হয় না। স্কুল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় শুধুই সনদ বিতরণের হাট। লেখাপড়া শিখতে হলে যেতে হবে অন্য কোনও খানে, অন্য কোথাও। সেই অন্য কোথাও হলো কোচিং সেন্টার। সেখানে শিক্ষার্থী পাবে উপযুক্ত শিক্ষা। নিরন্তর প্রচারে তা সমাজে এমন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে যে, সন্তানের মঙ্গলের জন্য সর্বস্ব বাজি রাখতে রাজি; বাবা-মা হ্যাতা-খ্যাতা সর্বস্ব বিক্রি করে কোচিং সেন্টারের বিদ্যাবাণিজ্যের বণিকদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

দেশে কোচিং বাণিজ্য এতদূর বিস্তৃত হয়েছে যে, সদ্য সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর সময়ে একটি বেসরকারি সংস্থার গবেষণায় বলা হয়েছিল, বছরে নাকি দেশে ৩২ হাজার কোটি টাকার কোচিং বাণিজ্য হয় । চলতি বছর (২০১৮-১৯) জাতীয় বাজেটে মোট বরাদ্দ ৪ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা; আর শিক্ষাখাতে বাজেট বরাদ্দ ৫৩ দশমিক ৫৪ হাজার কোটি টাকা। এই বরাদ্দ জাতীয় বাজেটের মাত্র ১১ দশমিক ৫ শতাংশ। অন্যদিকে কোচিংখাতে আমাদের অভিভাবকদের বার্ষিক ব্যয় দাঁড়াচ্ছে জাতীয় বাজেটের তুলনায়  প্রায় ৭ শতাংশ এবং শিক্ষা বাজেটের ৫৯ শতাংশ! মাথা ঘুরে যাবার মতো তথ্য! কিন্তু প্রকৃত অবস্থা হয়তো আরও ভায়াবহ। আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি, বর্তমান বরাদ্দের সাথে আরও অভিভাবকের পকেট থেকে লুটে নেয়া ৩২ হাজার কোটি যোগ করা গেলে কোচিং সেন্টারের কোনোই দরকার হতো না! আর সেটা সত্যিই অসম্ভব!

দেশের স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন শিক্ষাদান যে সর্বকালের নিম্নগামী, এ অভিযোগ কিন্তু মিথ্যা নয়। তাই শিক্ষার্থীরা কোচিং সেন্টারে ভিড় করতে বাধ্য হচ্ছে। সরকারের জন্য এর চেয়ে গুরুতর চ্যালেঞ্জ আর কিছু হতে পারে না। এই ব্যর্থতার জবাব দেবার শ্রেষ্ঠ উপায় হল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যথোপযুক্ত শিক্ষাদান নিশ্চিত করা, শিক্ষকের ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনা। অর্থাৎ, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি যথোপযুক্ত শিক্ষা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে কোনও বাবা-মা তার প্রাণাধিক সন্তানকে শেষ কপর্দক ব্যয় করে কেন কোচিং সেন্টারে পাঠাবে?

তাহলে প্রধান সমস্যা হচ্ছে, স্কুল কলেজ  যথোপযুক্ত শিক্ষাদান না হওয়া। এর অন্যতম কারণ, উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগে ব্যর্থতা, শিক্ষকতাকে আকর্ষণীয় ও সম্মানজনক পেশা হিসেবে স্বীকৃতি না দিতে পারা, লক্ষাধিক শিক্ষককে এমনকি মাসিক বেতন না দিয়ে বেগার দিতে বাধ্য করা (দেশে প্রায় নয় হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিও বঞ্চিত), শিক্ষকদের পেশাগত মানোন্নয়নে কার্যকর আইন প্রণয়ন করতে না পারা, এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গড়ে তোলায় ব্যর্থতা ইত্যাদি, ইত্যাদি। 

এবার আমরা বিষয়টি ভিন্নভাবে ব্যাখ্যার চেষ্টা করব। শিক্ষাখাতে মোট জাতীয় উৎপাদন জিডিপির ৬ শতাংশ এবং জাতীয় বাজেটের অন্তত ২০ শতাংশ বরাদ্দ করার জন্য ইউনেস্কোর সুপারিশ আছে। আমাদের সীমিত আর্থিক সামর্থ্যের কারণে ২০১০ খ্রিস্টাব্দের জাতীয় শিক্ষা নীতিতে সরকার জিডিপির ৪ শতাংশ বরাদ্দের অঙ্গীকার করে। কিন্তু আমরা দেখছি, সরকার শিক্ষাখাতে মোট বরাদ্দ দিয়েছে জাতীয় বাজেটের মাত্র ১১দশমিক ৫ শতাংশ এবং জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৮ শতাংশ। এই বরাদ্দ আফ্রিকা, এমন কি, সার্কভুক্ত যে কোনও দেশের তুলনায় সর্বনিম্ন!

মনে রাখতে হবে, কোচিং বাণিজ্য হল দেশের দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থা ও জনগণের শিক্ষা গ্রহণের আকাঙ্খার মধ্যে যে সুবিধা তা আত্মসাতের এক শ্রেণির অর্থলোভীচক্রের অশুভ তৎপরতা। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যথোপযুক্ত শিক্ষাদান সম্ভব হলে এই চক্রের বাণিজ্য বন্ধ হতে বাধ্য।

কীভাবে তা করা সম্ভব? আমরা নিশ্চিত, এবারের জাতীয় বাজেট ৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু আমরা সে বৃদ্ধি আমলে না নিয়েও যদি কল্পনায় উড়াল দিতে চাই তাহলে কী ঘটতে পারে? ধরা যাক, ২০১৯-২০ খ্রিস্টাব্দের জাতীয় বাজেটে শিক্ষাখাতে টাকার অংকে বর্তমান বরাদ্দ শতকরা ৫০ ভাগ বৃদ্ধি করা হবে। টাকার অংকে তাহলে তার পরিমাণ দাঁড়াবে ৮১ হাজার ২৫ কোটি টাকা, যা কোচিং সেন্টারগুলো জনগণের কাছ থেকে যে পরিমাণ অর্থ লুটে নিচ্ছে তার চেয়ে কম। আমরা জানি, টাকার অংকে বরাদ্দ মাত্র ৬০ হাজার কোটি টাকা করে দেশের মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত এবং বরাদ্দ ৮০ হাজার কোটি টাকা হলে দেশের স্নাতক পর্যন্ত জাতীয়করণ সম্ভব। আর সেটা করা গেলে বাংলাদেশে শিক্ষকদের বঞ্চনার অবসান হয়।

প্রসঙ্গত স্মরণ করতে পারি, শ্রীলংকায় স্বাধীনতার পর থেকেই গোটা শিক্ষাব্যবস্থাই রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে পরিচালিত হয় এবং তার ফলে, সার্কভুক্ত অঞ্চলে শ্রীলংকার শিক্ষাব্যবস্থা সবচেয়ে উন্নত এবং সুশৃঙ্খল। অথচ, এই দেশটি দুই দশক ধরে ধ্বংসাত্মক গৃহযুদ্ধের শিকার হয়েছিল। 

আর আমরা যদি বর্তমান বরাদ্দ দ্বিগুণ অর্থাৎ ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা করতে পারি (তখন কিন্তু এই বরাদ্দ জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশের নীচে নেমে যাবে), তাহলে বাংলাদেশে শিক্ষকদের বেতন ও অন্যান্য সুবিধাদি ভারতের পশ্চিম বাংলা/কেরালা রাজ্যের মানে উন্নীত করতে পারব। সেটা করা গেলে, যুব আধিক্যের (পপুলেশন ডিভিডেন্ট) এই মাহেন্দ্রক্ষণে আমরা এশিয়ার যে কোনও উন্নত দেশের সমকক্ষতা অর্জনের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারব। এ জন্য প্রয়োজন আমাদের সদিচ্ছা, দক্ষতা বৃদ্ধি ও দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা।

আর এটা করা গেলে, সবার আগে শিক্ষায় বিপুল লুণ্ঠন ক্ষেত্র, কোচিং সেন্টারগুলো আপনা আপনিই নিষ্প্রয়োজনীয় হয়ে বন্ধ হয়ে যাবে। কোচিং সেন্টারগুলো আমাদের গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করার দুঃসাহস দেখাচ্ছে তার সমুচিত জবাবও দেয়া যাবে।

লেখক: যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান - dainik shiksha সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা - dainik shiksha লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক কেনো বদলি চান - dainik shiksha শিক্ষক কেনো বদলি চান ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে - dainik shiksha ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0085878372192383