কিন্ডারগার্টেনে কী পড়ানো হচ্ছে!

নিজস্ব প্রতিবেদক |

কিন্ডারগার্টেন নামের শিক্ষার ভিন্ন ধারার প্রতিষ্ঠানে শিশুদের কী পড়ানো হচ্ছে—এ নিয়ে একটি তদন্ত করেছে জাতীয় নাগরিক কমিশন। সম্প্রতি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত বিতর্কিত বিষয় নিয়ে কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদনে এক ধরনের চিত্র পাওয়া গেছে, যাতে বলা হয়েছে যে কিন্ডারগার্টেনের পাঠ্য বইয়ে যা পড়ানো হচ্ছে, সেটা শিশুমনে বিরূপ প্রভাব তৈরি করছে।

মার্চের শুরুর দিকে দেওয়া এ প্রতিবেদনে কিছু উদাহরণও তুলে ধরা হয়েছে। যেমন—‘অ’-তে ‘অজু করে পাক হও’, ‘আ’-তে ‘আজান শুনে জামাতে যাও’, ‘ই’-তে ‘ইসলাম চায় শান্তি’, ‘ঈ’-তে ‘ঈমান বাড়ায় শক্তি’, ‘এ’-তে ‘এক হও মুসলমান’, ‘ঐ’-তে ‘ঐশী বাণী আল কোরআন’।

ফ্রেন্ডস বুক সেন্টার প্রকাশিত ‘হিমেলের বাল্যশিক্ষা’ বইতে এগুলোই শিশুদের শেখানো হচ্ছে। প্রকাশকের ঠিকানা লেখা হয়েছে, ৩৮/২-খ, বাংলাবাজার, ঢাকা।

বছরের প্রথম দিকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানোর পর পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর অভিযোগ ওঠে নানা মহল থেকে। একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি সরকারের কাছে এ বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করে। সরকার কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় নির্মূল কমিটি বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানীকে চেয়ারম্যান করে জাতীয় নাগরিক কমিশন গঠন করে। এ কমিশন পাঠ্যপুস্তকের বিতর্কিত বিষয় তদন্তের পাশাপাশি কিন্ডারগার্টেনে পড়ানো বইও পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন দেয়।

জাতীয় নাগরিক কমিশনের সদস্যসচিব অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন  বলেন, ‘সাম্প্রদায়িকীকরণের এ ধারা শুধু জাতীয় শিক্ষা পাঠক্রমেই নয়, এর বাইরে কিন্ডারগার্টেনসহ বিভিন্ন ধরনের স্কুলে সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী শিক্ষা গুরুত্ব পাচ্ছে। কোমলমতি শিশুদের বর্ণশিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষার বই ধর্মশিক্ষার বইয়ে পরিণত হয়েছে। আর শিশুদের যেভাবে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, তাদের মনমানসিকতাও সেভাবে তৈরি হচ্ছে। তবে এসব ব্যাপারে কোথায়ও কোনো আলোচনা হচ্ছে না। ’

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় শত বছর ধরে প্রচলিত সীতানাথ বসাক প্রণীত বর্ণ পরিচয়ের ‘আদর্শ লিপি’ বইটি সবার কাছে একটি গ্রহণযোগ্য বই।

এর কোথায়ও সাম্প্রদায়িক শব্দ ব্যবহার করা হয়নি। তবে এ বইটি খুব কম প্রকাশিত হচ্ছে। বর্তমান সময়ে বাজারের বেশির ভাগ বর্ণ পরিচয়ের বই বের হচ্ছে ধর্মীয় শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করে। সীতানাথ বসাকের ‘অ’-তে ‘অলি নাচে ফুলে ফুলে’-এর পরিবর্তে লেখা হচ্ছে ‘অজু করে নামাজ পড়ো’। ‘গ’-তে ‘গান শোনা ভালো নয়’ বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে। এভাবে শিশুদের কোমল মনে ধর্মীয় অনুভূতি ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

নাগরিক কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, যে শিশুকে পড়ানো হচ্ছে ‘গান শোনা ভালো নয়’, সে শিশু স্বাভাবিকভাবেই জাতীয় সংগীত গাওয়াকে ইসলামবিরোধী মনে করবে।

প্রতিবেদনে এ ধরনের বেশ কিছু বইয়ের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। ফ্রেন্ডস বুক সেন্টার, হিউম্যান পাবলিকেশনস, শিশুসাহিত্য সেন্টার, সাজু পাবলিকেশনস আছে এসব বইয়ের প্রকাশকের তালিকায়। বইগুলো সাধারণত কিন্ডারগার্টেনের প্লে শ্রেণিতে পড়ানো হয়। আবার অভিভাবকরা বাসায় নিয়েও প্রথম পাঠ হিসেবে এসব বই শিশুদের হাতে তুলে দেন।

কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৬/১৭, বাংলাবাজার থেকে প্রকাশিত ‘শিশুসাহিত্য সেন্টার’ প্রকাশনীর ‘একের ভিতর পঁচিশ’ নামের বইয়ের প্রায় সব বাক্যই ধর্মভিত্তিক। বইটিতে মূলত বিভিন্ন বর্ণ দিয়ে একই কথা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলা হয়েছে। বইটিতে নামাজ পড়ার কথা বলা হয়েছে পাঁচবার। ৫০টি বর্ণের মধ্যে ২৯টি দিয়ে ধর্মীয় বাক্য গঠন করা হয়েছে। যেসব স্কুলে এ বইটি পাঠ্য সেখানে শুধু মুসলমান ছাত্রছাত্রীরাই নয়, অমুসলিম শিশুরাও পড়তে বাধ্য হয়। সাজু পাবলিকেশনস ও হিউম্যান পাবলিকেশনসের বইতেও এ ধরনের বাক্য লেখা হয়েছে।

ফ্রেন্ডস বুক সেন্টারের ‘বাল্যশিক্ষা’ বইয়ের ১৮ পৃষ্ঠায় রয়েছে ইংরেজি বর্ণ দিয়ে বাক্য গঠন। সেখানে ‘জেড’ বর্ণ দিয়ে শব্দ গঠন করা হয়েছে ‘জু’। আর বাক্য গঠনে লেখা হয়েছে, ‘চিড়িয়াখানাতে আল্লাহর কুদরত দেখো’। এই বইয়ের বাংলা ও ইংরেজি ছড়াগুলোও ধর্মীয় শিক্ষাভিত্তিক। তবে এসব ছড়ায় লেখকের নাম নেই। ‘এমন হলে কেমন হয়’ ছড়ায় বলা হয়েছে, ‘ফজর না পড়ে; যোহর না পড়ে দুপুরের খাবার নয়; আসর না পড়ে খেলা নয়; মাগরিব না পড়ে পড়া নয়; এশা না পড়ে ঘুম নয়; এমন হলে কেমন হয়। ’ এমন আরো ছড়া আছে বইটিতে।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর দে বলেন, ‘আমরা সংবিধানে যে নিয়ম বা মূলনীতি রেখেছি তার সঙ্গে এ ধরনের লেখাপড়া সাংঘর্ষিক। মূলত এসব সাম্প্রদায়িক শিক্ষার মাধ্যমে শিশুদের মনেও মৌলবাদের বীজ বপন করা হচ্ছে। ’ তিনি মনে করেন, প্রাক-প্রাথমিকে যদি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বাইরের বই পড়াতে হয় তাহলে শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটি কমিটি করতে পারে মন্ত্রণালয়। এ কমিটির অনুমোদনের পরই শিশুদের জন্য বই প্রকাশের সুযোগ পাবেন প্রকাশকরা। আর কিন্ডাগার্টেনগুলোকেও অনুমোদিত বই পড়ানোর বাধ্যবাধকতা দিতে হবে।

এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নজরুল ইসলাম খান  বলেন, ‘কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোকে এখনো আমরা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে পারিনি। তাদের নিবন্ধনের জন্য টাস্কফোর্স করা হয়েছে। কিন্তু সেই টাস্কফোর্স তাদের কাজ শেষ করতে পারছে না। কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনার পর বইয়ের অনুমোদনসহ অন্যান্য বিষয়ে ভাবা হবে। ’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0022261142730713