কিন্ডারগার্টেন থাকবে না, সব বেসরকারি বিদ্যালয় হবে

দৈনিকশিক্ষা প্রতিবেদক |

কয়েকজন বেকার মিলে হঠাৎ একটা দোকান খুলে কেজি স্কুল নাম দিয়ে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো চালানোর দিন শেষ হচ্ছে। মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়া কেজি স্কুলসহ কোনো ধরনের বেসরকারি বিদ্যালয় পরিচালনা করা যাবে না। শিশুদের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া যাবে না বইয়ের বোঝা। নেওয়া যাবে না ইচ্ছেমতো ফি। খাত ও ফি’র হার থাকবে নির্দিষ্ট। চলমান ৫৭ হাজার প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেকটিকে নিবন্ধন নিতে হবে। ভবিষ্যতে কোনো প্রতিষ্ঠান পূর্ব অনুমোদন ছাড়া পরিচালনা করা যাবে না।

এমন সব বিধান রেখে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম) নিবন্ধন বিধিমালা তৈরি করছে সরকার।  বর্তমানে এটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আছে। প্রক্রিয়া শেষে যাবে মন্ত্রিসভায়।

প্রস্তাবিত বিধিমালায় শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতোই হতে হবে। থাকতে হবে একই ধরনের প্রশিক্ষণ। পঞ্চম শ্রেণির বিদ্যালয়ে কমপক্ষে ৬ জন শিক্ষক থাকতে হবে। নিয়োগের জন্য জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি দিতে হবে। এরপর একটি বোর্ড নিয়োগ দেবে এবং এ বোর্ডে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার একজন প্রতিনিধি থাকবেন। কোনো প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা শিক্ষাবর্ষ শেষের ৩০ দিনের মধ্যে জানাতে হবে। শিক্ষকের বেতন-ভাতাদি এসব বিদ্যালয়ই বহন করবে, সরকার নয়।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, বিধিমালা আপডেট প্রয়োজন। নতুন বিধিমালা কেউ প্রতিপালন না করলে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।

জানা যায়, প্রস্তাবিত এই বিধিমালার আওতায় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদানকারী নার্সারি, কেজি ও প্রিপারেটরি স্কুল এবং অন্যান্য বেসরকারি বিদ্যালয় পরিচালনা করতে হবে। উপজেলা/থানা শিক্ষা কর্মকর্তার (টিইও) মাধ্যমে আবেদন করতে হবে। আবেদন ফি মেট্রোপলিটন ও অন্য বিভাগীয় শহরে ৫ হাজার, জেলায় ৩ হাজার, উপজেলায় ২ হাজার টাকা জমা দিতে হবে। তিনি যাচাই শেষে তা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার (ডিপিইও) কাছে পাঠাবেন। তিনিই প্রতিষ্ঠান স্থাপন বা চলমান প্রতিষ্ঠান চালু রাখার চূড়ান্ত অনুমতি দেবেন। আবেদন করার ৬০ দিনের মধ্যে সব প্রক্রিয়া শেষ করে অনুমোদন বা বাতিল করতে হবে। প্রাথমিক অনুমতির মেয়াদ হবে সনদ দেওয়ার পর থেকে এক বছর। এই মেয়াদ শেষ হলে নবায়নের আবেদন ৩০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। আর পূর্ব তদন্ত ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান নবায়ন করা যাবে না।

প্রাথমিক অনুমোদনের পর নিতে হবে নিবন্ধন। শহরাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত স্কুল নিবন্ধন ফি ১৫ হাজার টাকা। জেলায় ১০ হাজার এবং উপজেলায় ৮ হাজার টাকা। নিবন্ধন দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ভর্তি, উপস্থিতি এবং শিক্ষা সমাপনের হার বিবেচনায় নেওয়া হবে। অনুমোদন বা অনুমতি কর্তৃপক্ষ ডিপিইও হলেও নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ হবেন বিভাগীয় উপপরিচালক (ডিডি)। নিবন্ধনের মেয়াদ হবে ৫ বছর। নিবন্ধন সনদে নানা শর্ত উল্লেখ থাকবে। পাঠদান অনুমতি পাওয়ার এক বছরের মধ্যে নিবন্ধন না নিলে অনুমতি বাতিল হয়ে যাবে। নিবন্ধন সনদ প্রতিষ্ঠানকে সংরক্ষণ করতে হবে।

মেয়াদ শেষে নবায়ন করতে হবে। মেয়াদ শেষ হওয়ার ৬০ দিন আগেই আবেদন দাখিল করতে হবে। নবায়নের মেয়াদ ৫ বছর। আর এজন্য নতুন নিবন্ধনের জন্য নির্ধারিত ফি’র ৫০ শতাংশ দিতে হবে। কোনো কারণে নিবন্ধন বাতিল হলে ফের আবেদন করা যাবে। এ বিধিমালার আগে কোনো প্রতিষ্ঠান নিবন্ধনের আবেদন করে থাকলে তা এই বিধির আলোকেই নিষ্পন্ন হবে। ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ও এই বিধিমালার অধীনে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসাবে গণ্য হবে। আগে নিবন্ধিতগুলো এই বিধিমালার আলোকে নবায়ন করতে হবে। আর আগে নিবন্ধিত কিন্তু পাঠদান শুরু করেনি, সেসব বিদ্যালয়কেও এই বিধিমালার অধীনে কাজ করতে হবে।

বর্তমানে কেজি স্কুল খেয়ালখুশী মতো পরিচালনা করছেন প্রতিষ্রঠাতারা। কিন্তু প্রত্যেক স্কুলের একটি ব্যবস্থা কমিটি থাকবে। কমিটিই চালাবে প্রতিষ্ঠান। এতে প্রধান শিক্ষক, একজন শিক্ষক প্রতিনিধি, একজন অভিভাবক প্রতিনিধি, উদ্যোক্তা বা প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে ২ জন থাকবেন। প্রতিষ্ঠাতা পাওয়া না গেলে ইউএনও বা ডিসির ২ জন প্রতিনিধি থাকবেন। এছাড়া থাকবেন নিকটতম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন প্রধান শিক্ষক। প্রতিনিধি নির্বাচনে ভূমিকা রাখবেন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা।

নির্বাচিত সদস্যরা সভাপতির কাছে পদত্যাগ করতে পারবেন। এভাবে কোনো পদ শূন্য হলে ১৫ দিনের মধ্যে বিধান অনুসরণ করে পূরণ করতে হবে। এভাবে কমিটি গঠনের পর প্রথমসভায় প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষক প্রতিনিধি বাদে বাকিদের মধ্য থেকে একজন সভাপতি ও সহসভাপতি নির্বাচন করতে হবে। উচ্চ মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে প্রাথমিক শাখা থাকলে তার জন্য আলাদা ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করতে হবে। এই কমিটি ইউএনও বা ডিসি অনুমোদন দেবেন। ব্যবস্থাপনা কমিটির মেয়াদ হবে ৩ বছর। এ কমিটিতে থানা শিক্ষা কর্মকর্তা, প্রধান শিক্ষক ও একজন অভিভাবক প্রতিনিধি সদস্য থাকবেন। কমিটির বৈঠক স্কুলেই করতে হবে। প্রতি ২ মাসে অন্তত একটা সভা হবে। তিনজন সদস্য ছাড়া কোরাম পূর্ণ হবে না।

ব্যবস্থাপনা কমিটির ৫ ধরনের কাজ আছে। এগুলো হলো-শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ, তাদের বেতন-ভাতাদি নির্ধারণ, শৃঙ্খলার ব্যবস্থা, বিদ্যালয়ের আয়-ব্যয়ের হিসাব নিরীক্ষা এবং বিদ্যালয়ের অবকাঠামো, শিক্ষার মান ও পরিবেশ উন্নয়নে কাজ করা। বিদ্যালয়ের সংরক্ষিত ও সাধারণ নামে দুটি তহবিল থাকবে। সংরক্ষিত তহবিলে এলাকা অনুযায়ী স্থায়ী আমানত বা সঞ্চয়পত্র আকারে থাকতে হবে। এরমধ্যে আছে- মেট্রোপলিটনে ১ লাখ, জেলায় ৭৫ হাজার, উপজেলা ও পৌরসভায় ৫০ হাজার এবং ইউনিয়নে ২৫ হাজার টাকা।

ব্যবস্থাপনা কমিটির পূর্বানুমোদন ছাড়া এই টাকা তোলা যাবে না। আর সাধারণ তহবিলে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অনুদানের অর্থ থাকবে। সভাপতি ও সদস্য সচিবের যৌথ স্বাক্ষরে উভয় তহবিল পরিচালিত হবে। ব্যক্তির নামে বিদ্যালয় স্থাপন করতে হলে ৫ লাখ টাকা স্থায়ী আমানত করতে হবে। আর এই তহবিলের লাভের টাকা নিয়ম মেনে বিদ্যালয়ের উন্নয়নে ব্যয় করা যাবে। সঞ্চয়পত্র, আমানত ও অনুদানের অর্থ বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনায় ব্যয়ের পর অবশিষ্ট থাকলে বিদ্যালয়ের অবকাঠামো, শিক্ষার মানোন্নয়ন ও ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের কল্যাণে ব্যয় করা যাবে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর আয়-ব্যয়ের হিসাবসংক্রান্ত পদ্ধতি নির্ধারণ করে দেবে।

এ ধরনের প্রত্যেক বিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত হবে ৩০:১। এই অনুপাত পূরণ করা হলেই শুধু জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার অনুমোদন সাপেক্ষে শাখা খোলা যাবে। আর স্কুল পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত খুলতে হবে। কিন্তু কমপক্ষে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান থাকতেই হবে। একাধিক ক্যাম্পাস খোলা যাবে না। ইচ্ছেমতো টিউশন ফি নির্ধারণ করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে উপজেলা/থানা/মহানগর শিক্ষা কমিটির সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। পুনঃভর্তি বা নবায়নের নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অনুদান আদায় করা যাবে না। আর সহপাঠ কার্যক্রম, বিশেষ সুবিধা ও উন্নতমানের যন্ত্রপাতি বা প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য ফি আদায় করা যাবে। তবে আয়-ব্যয় বিবরণী অভিভাবকদের জানাতে হবে।

বিদ্যালয় ভাড়া কিংবা স্থায়ী বাড়িতে হোক, মেট্রোপলিটন এলাকায় অন্যূন দশমিক ৮ একর, পৌরসভায় দশমিক ১২ এবং অন্য এলাকায় দশমিক ৩০ একর ভূমিতে হতে হবে। ভবন ও ভূমি ভাড়া নেওয়া যাবে। তবে এ বিধিমালার আগে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের ভূমির পরিমাণ কম হলে সে ক্ষেত্রে কার্যকর হবে না। বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, প্রধান শিক্ষকের কক্ষ এবং শিক্ষকদের কক্ষ থাকতে হবে।

বিদ্যালয়ে এনসিটিবির পাঠ্যবই অবশ্যই পড়াতে হবে। পাশাপাশি অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ বা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পাঠ্যবই পড়ানো যাবে। তবে এ ধরনের সর্বোচ্চ ২টি বই অন্তর্ভুক্ত করা যাবে। আর নিজের ইচ্ছামতো বই পাঠ্যভুক্ত করা যাবে না। পাঠ্যবই নির্বাচনে শিশুদের ধারণ ক্ষমতার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। পাশাপাশি বই নির্বাচনে দেশের সংস্কৃতি ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ববিরোধী কিছু না থাকে সেদিকে নজর রাখতে হবে। বিভিন্ন ধরনের সহশিক্ষা কার্যক্রম থাকতে হবে। ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দেরর জাতিসংঘ শিশু সনদের আলোকে শিশুর অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগার, বিশুদ্ধ পানি ও টয়লেট থাকতে হবে। শিক্ষা সফর, চিকিৎসা, খেলার ব্যবস্থা থাকতে হবে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ বছরের দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে কমিটি - dainik shiksha জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ বছরের দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে কমিটি স্কুলে ভর্তির আবেদন করবেন যেভাবে - dainik shiksha স্কুলে ভর্তির আবেদন করবেন যেভাবে এইচএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের ফল বৃহস্পতিবার, জানবেন যেভাবে - dainik shiksha এইচএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের ফল বৃহস্পতিবার, জানবেন যেভাবে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা শুরু ২ জানুয়ারি - dainik shiksha অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা শুরু ২ জানুয়ারি কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে গণঅভ্যুত্থানে আহতদের তোপের মুখে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা - dainik shiksha গণঅভ্যুত্থানে আহতদের তোপের মুখে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা দপ্তরসহ সাবেক শিক্ষাপ্রতিমন্ত্রীকে চালাতেন পিয়ন! - dainik shiksha দপ্তরসহ সাবেক শিক্ষাপ্রতিমন্ত্রীকে চালাতেন পিয়ন! ৬১০ ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর শিক্ষা অধিদপ্তরে নিয়োগ চূড়ান্ত! - dainik shiksha ৬১০ ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর শিক্ষা অধিদপ্তরে নিয়োগ চূড়ান্ত! গণভবন, ভিকারুননিসার বোন ও আইডিয়ালের কলোনি কোটা বাতিল - dainik shiksha গণভবন, ভিকারুননিসার বোন ও আইডিয়ালের কলোনি কোটা বাতিল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে ভাসানী, শেরেবাংলা-সোহরাওয়ার্দীকেও জাতির পিতা করার পরামর্শ - dainik shiksha ভাসানী, শেরেবাংলা-সোহরাওয়ার্দীকেও জাতির পিতা করার পরামর্শ সমন্বয়কদের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই, সাবধান: সারজিস - dainik shiksha সমন্বয়কদের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই, সাবধান: সারজিস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025098323822021