কিশোরদের আলোর পথে ফিরিয়ে আনতে রাষ্ট্র দায়বদ্ধ

এম আরিফুজ্জামান |

আধুনিক বিশ্বের অসংগঠিত সমাজ ব্যবস্থায় দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়নের নেতিবাচক ফল হলো কিশোর অপরাধ। বর্তমানে দেশজুড়ে ভয়ংকর যেসব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে এর অধিকাংশের সঙ্গে জড়িত রয়েছে উঠতি বয়সের কিশোর। ছিনতাই, মাদক বিক্রি ও অস্ত্রবহনসহ নানা অপরাধমূলক কাজে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরের পরিবার বিচ্ছিন্ন কিশোরদের লিপ্ত থাকার উদ্বেগজনক তথ্য পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। এর পেছনে কাজ করে এক শ্রণির শক্তিশালী সন্ত্রাসী ও অপরাধী চক্র। একদিকে যেমন সন্ত্রাসী চক্রের সদস্যরা দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে নিম্নবিত্ত, ছিন্নমূল পরিবারের কিশোরদের অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে নিজেদের দলে টানছে। আবার, একইভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারা তাদের দলভারী করার জন্য স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করছেন। বুদ্ধি-বিবেকহীন তরুণ সমাজ নেতাদের পিছনে সময় দিতে দিতে নিজেদের পড়াশোনার যেমন ক্ষতি করছে, ঠিক তেমনি মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে, কিশোর গ্যাং এ নিজেদের অবস্থানও তৈরি করে নিচ্ছে। অর্থের প্রলোভনে পড়ে ধীরে ধীরে কিশোররা আজ অপরাধ জগতের স্থায়ী সদস্য হয়ে যাচ্ছেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- ‘তেরো চৌদ্দ বছরের মতো এমন বালাই আর নেই’। এ বয়সের ছেলেমেয়েদের সামনে থাকে অদম্য আশা আর জীবন জগৎ সম্পর্কে থাকে অতি কৌতূহল। সমাজ জীবনে বিরাজমান নৈরাজ্য ও হতাশা এবং কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে কিশোর সমাজ আজ ধীরে ধীরে অপরাধপ্রবণ হয়ে পড়ছে। 

কিশোর অপরাধী হলো সেই সব কিশোর কিশোরী যারা সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় সামাজিক রীতিনীতি ও প্রথা অনুকরণ করতে না শিখে সমাজ বিরোধী চিন্তা ও কাজে অংশ নেয়। বয়সের দিক থেকে সাধারণ ৭ থেকে ১৬ বছর বয়সী কিশোর কিশোরী দ্বারা সংঘটিত অপরাধই কিশোর অপরাধ। তবে বিভিন্ন দেশে বয়সের তারতম্য রয়েছে। কোনো কোনো দেশে ১৩ থেকে ২২ বছর আবার কোনো দেশে ১৬ থেকে ২১ বছর বয়সী কেউ অপরাধ করলে কিশোর অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হয়। জাপানে ১৪ বছরের, ফিলিপাইনে ৯ বছরের এবং ভারত, শ্রীলংকা ও মিয়ানমারে ৭ বছরের কম বয়সী শিশুদের অপরাধ শাস্তিযোগ্য নয়। বাংলাদেশে ১৮ বছরের কেউ অপরাধ করলে কিশোর অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবে। কিশোর অপরাধীদের আচরণ ও কাজকে কম অপরাধমূলক ভাবা হয় ও অপরাধের কারণকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। কৃত অপরাধের জন্য শাস্তিপ্রদান না করে সংশোধনের ব্যবস্থা করা হয়।

শিশুকাল থেকে মা-বাবার স্নেহ-মমতা বঞ্চিত হয়ে এসব কিশোররা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। প্রতিকূল পরিবেশে অবহেলা, বঞ্চনা এবং নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করে এক সময় অপরাধ জগতের অন্ধকারের দিকে পা বাড়ায়। কখনো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে হয়ে ওঠে বেপরোয়া। দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত শিশু-কিশোররাই প্রথমে অপরাধ জগতের নবীন সদস্য হয়ে কালক্রমে শীর্ষস্থানে চলে যায়। উচ্চবিত্তের পরিবারের কিশোরদেরও বর্তমানে ভয়ংকর অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। ধনী মা-বাবার কর্মব্যস্ততার কারণে তারা সন্তানের প্রতি যথাযথ খেয়াল রাখতে ব্যর্থ হচ্ছেন। বাবা-মায়ের স্নেহ-আদর ও উপযুক্ত পরিচর্যাবঞ্চিত শিশু-কিশোররা ভোগে একাকিত্বে। এ সুযোগে তাদের মনে স্থান করে নেয় বাইরের বন্ধুবান্ধব। আর সেই সঙ্গী অনেক সময় তাকে বিপথে ঠেলে দেয়। নেশাদ্রব্য গ্রহণ থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে নানা অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হতে থাকেন। 

আকাশ সংস্কৃতির অবাধ প্রবাহের এ যুগে অশ্লীল ভিডিও, ফেসবুক, ইন্টারনেটের অপব্যবহার তাদের বিপথগামী করে তোলে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি থেকে শুরু করে জঙ্গি তৎপরতায়ও তাদের জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। কখনো কিশোর ধর্ষকের রূপে আবির্ভূত হয়। পারিবারিক বন্ধন ক্রমশ শিথিল হয়ে যাওয়া, সামাজিক অবক্ষয়, অস্থিরতা কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত। আজকাল মা-বাবা, অভিভাবক ঘরের শিশুর-কিশোরদের প্রতি যথেষ্ট খেয়াল রাখেন না। নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্তের পরিবারের প্রায় সবাই জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে এত ব্যস্ত থাকেন যে ঘরে তাদের সন্তানের দেখভালের যথেষ্ট সময় পান না। উচ্চবিত্তের পরিবারের সন্তানরা নামিদামি স্কুলে পড়ার বাইরের সময়টা কেমন করে কাটায়, কার সঙ্গে মেলামেশা করে এ খবর কে রাখে। স্কুল শিক্ষক, প্রাইভেট টিউটরের কাছেও তারা কতটুকু মানবিক শিক্ষা গ্রহণ করছে এর হিসাব নেই। মোবাইল ফোন আর কম্পিউটার ব্যবহারে ব্যস্ত কিশোর সময় কাটায় এক পরিবার বিচ্ছিন্ন জগতে। তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রভাবে পরিবর্তিত বর্তমান সমাজে কিশোরদের অপরাধপ্রবণতা বাড়িয়ে তুলছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আবার, আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতারা তাদের দলীয় কিংবা নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য কিশোরদের ব্যবহার করছে, যেটা কিশোর গ্যাং তৈরির অন্যতম কারণ বলে মনে করছি। ধীরে ধীরে আমাদের কিশোর সমাজ চলে যাচ্ছে অন্ধকার জগতে, এক নিরুদ্দেশ যাত্রায়।

আজকের কিশোর আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। কিশোরদের সঠিক পরিচর্যা করতে পারলেই সম্ভব হবে সুন্দর এক বাংলাদেশ বিনির্মাণের। কিশোর গ্যাং বর্তমানে বড়ই চিন্তার বিষয়। প্রতিনিয়ত এদের সদস্য বেড়েই চলছে। সরকারও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নির্মূলের। কিন্তু, রাজনৈতিক নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতা থেকে যতদিন কিশোরদের বের করে আনা না যাবে, ততদিন এর সুফল আশা করা যায় না। আমাদের কিশোররা অনুকূল পরিবেশ পেলে ধীরে ধীরে তাদের মনে চিন্তা-চেতনার বিকাশ ঘটবে। বিদ্যা-বুদ্ধি-মননে, প্রগতিশীলতায় সমৃদ্ধি লাভ করবে। দেশ পরিচালনার নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা অর্জনেও সক্ষম হবে। সমাজ গঠনে রাখতে পারবে সক্রিয় ভূমিকা। দেশের অসংখ্য শিশু-কিশোরদের অপরাধ জগৎ থেকে বের হয়ে আলোর পথে ফিরে আনতে রাষ্ট্র দায়বদ্ধ। 

কিশোর অপরাধের ভয়াবহ পরিণতি উপলব্ধি করে আমাদের সবার উচিত কিশোরদের অন্ধকার থেকে আলোর জগতে ফিরিয়ে আনা। এ বিষয়ে  সরকারের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের আশু পদক্ষেপ একান্ত কাম্য।

লেখক:  সিনিয়র শিক্ষক, ইন্দুরকানী মেহেউদ্দিন মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পিরোজপুর।

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
৪০ দিনের মধ্যেই এইচএসসির ফল প্রকাশ - dainik shiksha ৪০ দিনের মধ্যেই এইচএসসির ফল প্রকাশ বন্যা: ৮ জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত ২৯ লাখ, নিহত ২ - dainik shiksha বন্যা: ৮ জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত ২৯ লাখ, নিহত ২ উপবৃত্তি দিতে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তথ্য আহ্বান - dainik shiksha উপবৃত্তি দিতে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তথ্য আহ্বান এমপিওর দাবিতে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা শিক্ষকদের মানববন্ধন - dainik shiksha এমপিওর দাবিতে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা শিক্ষকদের মানববন্ধন দুর্নীতিবাজ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের বদলির আল্টিমেটাম: মর্যাদা রক্ষা কমিটি - dainik shiksha দুর্নীতিবাজ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের বদলির আল্টিমেটাম: মর্যাদা রক্ষা কমিটি বন্যা পরিস্থিতি ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসায় চালু রয়েছে ৪৪৪টি মেডিক্যাল টিম - dainik shiksha বন্যা পরিস্থিতি ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসায় চালু রয়েছে ৪৪৪টি মেডিক্যাল টিম একদিন ছুটি নিলেই মিলবে চার দিনের ছুটি - dainik shiksha একদিন ছুটি নিলেই মিলবে চার দিনের ছুটি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0022721290588379