কী অপরাধ করেছিল আবরার

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ। গত ৫ অক্টোবর কুষ্টিয়ার কুমারখালীর নিজ বাড়ি থেকে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে ফিরেছিল। সংবাদমাধ্যমের খবর, গভীর রাতে তাকে একই হলের দোতলায় একটি কক্ষে ডেকে নেওয়া হয়। সেটি ছাত্রলীগ নেতাদের বিশেষ কক্ষ। এখানে সাধারণ ছাত্র ও সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে শাস্তি দেওয়া হতো। কিল-থাপ্পড়, পেটানোর ঘটনা অহরহ ঘটত। এটি সাধারণ ছাত্রদের কাছে টর্চার রুম বলেই পরিচিত। এই রুমেই আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। কী অপরাধ করেছিল ছেলেটি? বুধবার (৯ অক্টোবর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। 

আবরার ফেসবুকে বাংলাদেশ ও ভারত সম্পর্কের ওপর একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিল। সে লিখেছিল- "১. ৪৭ এ দেশভাগের পর দেশের পশ্চিমাংশে কোন সমুদ্রবন্দর ছিল না। তৎকালীন সরকার ৬ মাসের জন্য কলকাতা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ করল। কিন্তু দাদারা নিজেদের রাস্তা নিজেদের মাপার পরামর্শ দিছিলো। বাধ্য হয়ে দুর্ভিক্ষ দমনে উদ্বোধনের আগেই মংলা বন্দর খুলে দেওয়া হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ ইন্ডিয়াকে সে মংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য হাত পাততে হচ্ছে।

২. কাবেরি নদীর পানি ছাড়াছাড়ি নিয়ে কানাড়ি আর তামিলদের কামড়াকামড়ি কয়েকবছর আগে শিরোনাম হয়েছিল। যে দেশের এক রাজ্যই অন্য রাজ্যকে পানি দিতে চাই না সেখানে আমরা বিনিময় ছাড়া দিনে দেড়লাখ কিউবিক মিটার পানি দিব।

৩. কয়েকবছর আগে নিজেদের সম্পদ রক্ষার দোহাই দিয়ে উত্তরভারত কয়লা-পাথর রপ্তানি বন্ধ করেছে অথচ আমরা গ্যাস দিব। যেখানে গ্যাসের অভাবে নিজেদের কারখানা বন্ধ করা লাগে সেখানে নিজের সম্পদ দিয়ে বন্ধুর বাতি জ্বালাব।"

এ স্ট্যাটাসে কারও প্রতি অবমাননাকর কিছু নেই, গালি নেই, অশালীন কিছু নেই। এটি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ও চুক্তি নিয়ে অভিমত। বুদ্ধিদীপ্ত স্ট্যাটাস। আর অন্য কিছু থাকলেও তা দেখার দায়িত্ব ছাত্রলীগের নয়। দুই দেশের সমঝোতা স্মারক নিয়ে মতামত দেওয়ার অধিকার সবার আছে। এটি কারও অপছন্দ হলে পাল্টা বক্তব্য, যুক্তি দিতে পারে। তর্ক-বিতর্ক হতে পারে; কিন্তু কাউকে পিটিয়ে হত্যা করা যায় না। গণতন্ত্রের মর্মবাণী হচ্ছে- তোমার কথা শুনলে আমার গা জ্বালা ধরে, খুন চড়ে যায়- তবু তোমার কথা শুনব, তোমার কথা বলার অধিকার রক্ষায় যদি প্রাণ দিতে হয়, তাও দেব।

বলা হচ্ছে, আবরার শিবিরকর্মী। এর কোনো প্রমাণ মিলছে না। তার পরিবারও অস্বীকার করেছে। যদি শিবিরকর্মীও হয়, তাই বলে তাকে হত্যা করা যাবে- এই লাইসেন্স ছাত্রলীগকে কে দিয়েছে?

এ প্রসঙ্গে বলতে চাই যে, জামায়াত-শিবির যুদ্ধাপরাধী দল। যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে জামায়াতের বিচার চাই। জায়ায়াত ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করছে, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি। এ জন্য জামায়াতের রাজনীতিও নিষিদ্ধ করার দাবি জানাই। তাই বলে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা সমর্থন করতে পারি না। হত্যাকাণ্ড হত্যাকাণ্ডই। কোনো বিবেচনায় তা সমর্থন করা যায় না।


আশার কথা যে, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে এবং তদন্তসাপেক্ষে ছাত্রলীগ বুয়েট শাখার ১১ জন নেতাকমীকে বহিস্কার করেছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বলেছেন, ভিন্নমতাবলম্বীদের হত্যা করার অধিকার কারও নেই। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের এ অবস্থানকে স্বাগত জানাই। তবে অপরাধীদের 'বিচার' সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সুখকর নয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাকাণ্ড এই প্রথম নয়। মনে পড়ে, কয়েক বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছিল দিনমজুর বাবার সন্তান আবু বকর। অটোরিকশাচালকের সন্তান হাফিজুরও দূষিত রাজনীতির নির্মম শিকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হলের গেস্ট রুমে ছাত্রলীগ নেতাদের বদৌলতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। শর্ত অনুযায়ী রাতে তাকে ডিউটি করতে হতো। অসুস্থ শরীরে অনেক মিনতির পরও তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয় না। কনকনে শীতের মধ্যে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা মাঠে ডিউটি করতে হয়। এর ফলে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তবে কাউকে ডেকে নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় খুনের ঘটনা এই প্রথম। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিক্ষাঙ্গনে আরও কয়েকজনের জীবন ঝরেছে। এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে বলে মনে পড়ে না। ব্যতিক্রম শুধু স্বাধীনতা-উত্তর ৭ খুনের মামলা। শফিউল আলম প্রধানসহ তার সহযোগী কয়েকজনের যাবজ্জীবন সাজা হয়েছিল। যদিও '৭৫-এর পট পরিবর্তনের পর তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। সে যাই হোক, ছাত্রনেতাদের ধারণা হয়েছে- মানুষ খুন করেও পার পাওয়া যায়।

বিচারহীনতার সংস্কৃতি তরুণদের বেপরোয়া করে তুলেছে। তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। তাই প্রয়োজন আবরার হত্যাকাণ্ডের বিচার ও দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। সবার কাছে যেন বার্তা যায়- কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।

এটি মনে রাখা দরকার, বুয়েটের এই তরুণরা হঠাৎ ফ্রাঙ্কেনস্টাইনে পরিণত হয়নি। এর পেছনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রাধ্যক্ষ কি জানতেন না- শেরেবাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষটি টর্চার সেলে পরিণত হয়েছে? বিলক্ষণ জানতেন। এ ঘটনার পর অনেক শিক্ষার্থী সংবাদমাধ্যমের কাছে বলেছে, তারা লাঞ্ছিত, প্রহূত হয়ে কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিল; কোনো প্রতিকার হয়নি। কারণ সবার বোধগম্য। অনেক শিক্ষক ক্ষমতাসীনদের অনুগত; ছাত্রনেতাদের মতো একইভাবে দলকানা। তাই সতীর্থদের কোনো অপরাধই তাদের কাছে অপরাধ মনে হয়নি। আবার এমনও হতে পারে, কেউ কেউ পদ-পদবি-পদোন্নতির জন্য ছাত্রনেতাদের ব্যবহার করছেন। এমন কিছু একটা হবে। নইলে কেন নির্বিকার ছিলেন?

দায় এড়াতে পারে না রাজনৈতিক নেতৃত্ব। প্রচলিত রাজনীতিই ছাত্রনেতা-কর্মীদের লাঠিয়ালে পরিণত করেছে। লাঠির ধর্ম লাঠিবাজি। তা থেকে তারা কী করে বিরত থাকবে? তাই তারা কখনও দলের জন্য লাঠিবাজি করছে, নিজেদের জন্য করছে; কখনও ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য করছে।

রাজনীতি এখন একরৈখিক। এ রাজনীতিতে সহঅবস্থানের কথা নেই। বাকযুদ্ধের কথা নেই। বর্তমান রাজনীতির নীতি- পথের কাঁটা রাখতে নেই। তাই যে দলই ক্ষমতায় যাক, বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করে ক্ষমতা স্থায়ী করতে চাইছে। বিরোধী দলও ক্ষমতার বাইরে কিছু ভাবছে না। ক্ষমতার জন্য সন্ত্রাসের পথ অবলম্বনে দ্বিধা করছে না। ক্ষমতায় থাকা আর ক্ষমতায় যাওয়ার লড়াই। এ লড়াইয়ের বহিরাঙ্গে ভোট, ভেতরে পেশি ও কালো টাকা, যা ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যেও সংক্রমিত। শুধু বর্তমান সরকারের আমলেই নয়, অতীতেও ছিল। বিএনপি আমলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু ছাত্রদলেরই একক কর্তৃত্ব ছিল। বর্তমানে ছাত্রলীগের আধিপত্য। এই আধিপত্য পেশিশক্তির দাপটে; ছাত্রদের সমর্থনে বা ডাকসু, ইউকসু, চাকসুতে নির্বাচিত হয়ে নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যার যত সমর্থন, তার তত শক্তি। এই সমর্থন পেতে নেতৃত্বকে শিক্ষার্থীদের কাছে যেতে হয়, বিনয়ী হতে হয়, যুক্তিতর্ক দিতে হয়। এভাবেই পরমতসহিষুষ্ণতা গড়ে ওঠে। কিন্তু যেখানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না, যুক্তিতর্কের ধার ধারতে হয় না; সেখানে কী করে পরমতসহিষুষ্ণতা গড়ে উঠবে? বরং আজ উল্টোটাই হচ্ছে। পেশির দাপট বাড়ছে। সেটিকে রাজনীতির হাতিয়ার মনে করছে। পেশির দাপট না থাকলে ছাত্রনেতাদের কর্তৃত্ব থাকে না, সিট বণ্টন-ভর্তিবাণিজ্য চলে না, মোটা অঙ্কের চাঁদাও মেলে না। তারা মনে করে, পেশি ছাড়া আখেরে উন্নতিও হবে না।

বুয়েট ছিল ব্যতিক্রম। এখানে মেধার চর্চাই ছিল আসল। সেখানেও যখন পচন ধরেছে, তখন আশার আলো দেখব কোথায়! তবে আশার আলো জ্বালাতে পারে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ইতিমধ্যে বুয়েটের ছাত্রছাত্রীরা সাত দফা দাবিতে মাঠে নেমেছে। এর মধ্যে অপরাধীদের সুষ্ঠু বিচার ও তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কারের দাবি করেছে। কেউ কেউ ছাত্র রাজনীতির বন্ধের দাবিও তুলেছে। আমি ছাত্র রাজনীতির বিরোধী নই। তবে ছাত্র রাজনীতির নামে যে দস্যুবৃত্তি চলছে, তা বন্ধের বিকল্পও নেই।


লেখক: আবু সাঈদ খান, সাংবাদিক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ - dainik shiksha সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ - dainik shiksha নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বেসরকারি শিক্ষকদের বদলির উদ্যোগ স্থগিতের নেপথ্যে - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষকদের বদলির উদ্যোগ স্থগিতের নেপথ্যে শিক্ষাখাতে অপপ্রচারে ভূয়া অভিভাবক ফোরাম, জাল সনদের অধ্যক্ষ - dainik shiksha শিক্ষাখাতে অপপ্রচারে ভূয়া অভিভাবক ফোরাম, জাল সনদের অধ্যক্ষ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0023560523986816