কুবি অধ্যাপকের বিরুদ্ধে এবার নম্বর টেম্পারিংয়ের অভিযোগ

কুবি প্রতিনিধি |

অভিযোগ-বিতর্ক পিছু ছাড়ছেনা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) ইংরেজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. বনানী বিশ্বাসের। নিজের পদোন্নতি বোর্ডে নিজেই সভাপতিত্ব করা, সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ, শিক্ষার্থী দিয়ে বাজার করানো, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) আইন না মেনে একই সঙ্গে দুই পদে বহাল থাকাসহ নানা বিতর্কের পর এবার নম্বর টেম্পারিংয়ের অভিযোগ ওঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। 

ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করছেন, সর্বশেষ স্নাতকোত্তর ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের থিসিস এবং ভাইভাতে নম্বর টেম্পারিং করেছেন এই অধ্যাপক। এসব বিষয়ে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইংরেজি বিভাগের একজন শিক্ষক ও বিভিন্ন শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরাও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাছাড়া গত কয়েক দিন ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে নম্বর টেম্পারিং-এর রেজাল্ট শীটসহ বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা ও ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে।

শিক্ষার্থীরা জানান, স্নাতকে ভালো ফলাফলধারীরা স্নাতকোত্তর ২য় সেমিস্টারে থিসিস করার সুযোগ পেয়ে থাকেন। যেখানে সর্বনিম্ন সিজিপিএ ৩.২৫ হলে শিক্ষার্থী তার পছন্দ শিক্ষকের অধীনে থিসিস করতে পারবেন। একজন শিক্ষকের অধীনে সর্বোচ্চ তিনজন শিক্ষার্থী এই থিসিস পেপার করার নিয়ম রয়েছে।

স্নাতকোত্তর ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে বনানী বিশ্বাসের অধীনে ৩ জন, অধ্যাপক ড. এমএম শরীফুল করিমের অধীনে ২ জন, সহকারী অধ্যাপক আবুল হায়াতের অধীনে ৩ জন ও সহকারী অধ্যাপক শারমিন সুলতানার অধীনে ২ জনসহ মোট ১২ জন থিসিস  করার সুযোগ পেয়েছিলো।

আরও পড়ুন : নিজের পদোন্নতি সভায় নিজেই সভাপতিত্ব করলেন কুবি শিক্ষক

এতে চূড়ান্ত ভাইভা বোর্ডে বনানী বিশ্বাস এবং শারমিন সুলতানার বিরূপ আচরণের শিকার হন আবুল হায়াত ও শরীফুল করিমের অধীনে থিসিস করা শিক্ষার্থীরা। হায়াত ও শরিফুলের অধীনে থিসিস করা শিক্ষার্থীদের ‘সি+’ ও ‘বি-’ গ্রেডে নম্বর দেয়া হয়, যেখানে বনানী ও শারমিনের অধীনে থিসিস করা শিক্ষার্থীরা পেয়েছে ‘এ’ এবং ‘এ+’ গ্রেডে। এতে ফল বিপর্যয় ঘটে শিক্ষার্থীদের।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় নামের একটি গ্রুপে লিখেছেন, আমাদের স্বপ্ন ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার। কিন্তু ইংরেজি বিভাগে পড়ে আমার জীবন শেষ।

স্নাতকে আমার রেজাল্ট অনেক ভালো ছিলো। কিন্তু স্নাতকোত্তরে এক ঘষেটি বেগমের বদ নজর পড়েছে আমাদের ওপর। এর কারণ হচ্ছে আমরা অন্য শিক্ষকদের অনুসরণ করি। যাকে আমরা অনুসরণ করি বনানী ম্যাম তাকে একদম সহ্য করতে পারেন না। আর বলি হলাম আমরা। আমাদের এমনভাবে আটকানো হলো, যাতে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক নিয়োগে আবেদন না করতে পারি।

শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, এর আগে স্নাতকোত্তর ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের দুইজন শিক্ষার্থী ১ম সেমিস্টারে অন্যান্য কোর্সে ‘এ’ এবং ‘এ-’ পেলেও বনানীর কোর্সে পায় ‘বি’ ও ‘বি-’।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, তারা যেন পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে আবেদন করতে না পারে সেজন্য কোর্স শিক্ষক ইচ্ছাকৃতভাবে নম্বর কমিয়ে দিয়েছেন। একই ব্যাচের দুইজন শিক্ষার্থী পরবর্তী সেমিস্টারে শরিফুল করীমের অধীনে থিসিস করায় নম্বর কমিয়ে দেয় বনানী বিশ্বাসের ঘনিষ্টজন শিক্ষক শারমিন সুলতানা। ফলে তারা পেয়েছেন ‘বি-’। এটা কোনভাবে গ্রহণযোগ্য না বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক।

স্নাতকোত্তর ২০১৯-২০ সেশনের এক শিক্ষার্থী বলেন, একাধিক সেমিস্টারে ১ম, ২য় হওয়ার শিক্ষার্থীরা কিভাবে ভাইবাতে ‘সি’ এবং ‘সি+’ পায়! আমরা রেজাল্ট প্রকাশ হওয়ার আগে জানতাম যারা বনানী ম্যামের অধীনে থিসিস করবে তারা ভাইভাতে ‘এ+’ বা ‘এ’পাবে। রেজাল্ট প্রকাশের পর সেটাই হয়েছে। কারণ আমরা জানি তিনি পছন্দের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এটা করেন।

ভুক্তভোগী আরেক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা অন্যান্য কোর্সে ভালো করলেও ম্যামের কোর্সে ভালো করতে পারিনা। কারণ উনি নির্দিষ্ট কয়েকজনকে নম্বর দেন। এছাড়া ওনার অধীনের থিসিস না করায় তিনি আরও ক্ষুব্ধ। যার ফলে এর প্রভাব পরীক্ষার রেজাল্টে দেখতে পাচ্ছি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিভাগটির একাধিক এমন ঘটনাকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁরা বলছেন, শিক্ষক শিক্ষকরা নম্বর টেম্পারিং করলে উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। একজন শিক্ষকের নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে এরকম কাজ করা উচিত নয়। শিক্ষার্থীরা যেকোনো শিক্ষকের অধীনে থিসিস করতেই পারে। এটা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। সেক্ষেত্রে কেন শিক্ষককের ব্যক্তিগত আক্রোশ শিক্ষার্থীদের ফলাফলের উপর পড়বে? এটা কোনভাবে কাম্য নয়।

কেন বিশ্ববিদ্যালয়ে নাম্বার টেম্পারিং হচ্ছে? এবিষয়ে একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং ছাত্র পরামর্শক ও নির্দেশনার পরিচালক ড. মোহা. হাবিবুর রহমান বলেন, শিক্ষকদের দ্বন্দ্বের কারণে কেন শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্থ হবে? এটা এক ধরণের অপরাধ। একজন শিক্ষকের নৈতিকতা থাকলে এই কাজ করা সম্ভব না।

তবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে গেলে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে কল কেটে দেন অধ্যাপক ড. বনানী বিশ্বাস। এরপর তার সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো সাড়া মেলেনি।

এদিকে, সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা না বললেও ফেসবুকে তার বিরুদ্ধে করা নম্বর টেম্পারিংয়ের অভিযোগকে মিথ্যা ও উস্কানিমূলক দাবি করে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন বিভাগটির অধ্যাপক বনানী বিশ্বাস।

গত রোববার কুমিল্লা সদর দক্ষিণ মডেল থানায় করা জিডিতে বনানী বিশ্বাস সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্নের হাত থেকে রক্ষা পেতে এবং সুষ্ঠু তদন্তের আবেদন করার পাশাপাশি নিরাপত্তাহীনতার কথাও উল্লেখ করেন। এর আগে গত ৩০ মার্চ ফেসবুকের একটি গ্রুপে করা বেনামি একাধিক পোস্টের সূত্র ধরে থানায় জিডি করেন তিনি।

আর নম্বর টেম্পারিং ও নিজের বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ অস্বীকার করেন বিভাগটির সহকারী অধ্যাপক শারমিন সুলতানা। তিনি জানান, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যাচার, আমার অধীনে থিসিস করা শিক্ষার্থীরা 'এ' এবং 'এ+' পায় নি। থিসিসের ভাইভায় আমার সুপারভিশনে যারা থিসিস করেছে তাদের মধ্যে 'বি-' পাওয়া শিক্ষার্থীও আছে। সুতরাং আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এসেছে, তা বানোয়া এবং ভিত্তিহীন।

সার্বিক বিষয়ে  উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈনের কাছে জানতে চাইলে তিনি  বলেন, আমি বনানী বিশ্বাস ও শারমিন সুলতানার বিরুদ্ধে স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের নম্বর টেম্পারিং এর বিষয়ে অবগত ছিলাম না। এখন যেহেতু জানলাম, শিক্ষার্থীরা লিখিত অভিযোগ করলে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিব। সেটা যেই হোক, প্রমাণ পেলে আমরা বিষয়টি দেখবো।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
চলতি মাসে টানা ৪ দিনের ছুটি মিলবে যেভাবে - dainik shiksha চলতি মাসে টানা ৪ দিনের ছুটি মিলবে যেভাবে সিইসিসহ পাঁচ কমিশনারের পদত্যাগ - dainik shiksha সিইসিসহ পাঁচ কমিশনারের পদত্যাগ রাষ্ট্রপতি যেকোনো সময় পদত্যাগ করতে পারেন - dainik shiksha রাষ্ট্রপতি যেকোনো সময় পদত্যাগ করতে পারেন বাতিল কারিকুলামে শিক্ষার্থীরা আরও একবছর ভুগবেন কেন? - dainik shiksha বাতিল কারিকুলামে শিক্ষার্থীরা আরও একবছর ভুগবেন কেন? ডিআইএতে টাকার খেলা, অভিযুক্তরাই স্কুল অডিটে - dainik shiksha ডিআইএতে টাকার খেলা, অভিযুক্তরাই স্কুল অডিটে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নতুন অ্যাডহক কমিটি হবে - dainik shiksha সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নতুন অ্যাডহক কমিটি হবে প্রাথমিকে স্বতন্ত্র ক্যাডার সার্ভিস চালুর দাবি - dainik shiksha প্রাথমিকে স্বতন্ত্র ক্যাডার সার্ভিস চালুর দাবি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0033800601959229