কুয়েট শিক্ষকের মৃত্যু : অফিস কক্ষে নিয়ে কী বলেছিল ছাত্রলীগ

খুলনা প্রতিনিধি |

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. সেলিম হোসেনের মৃত্যু মানসিক নির্যাতনেই- এমন দাবি তার সহকর্মী ও পরিবারের সদস্যদের। যুক্তি হিসেবে তারা গত ৩০ নভেম্বরের বেশকিছু ভিডিও ফুটেজ উপস্থাপন করছেন। ছাত্রলীগের অনৈতিক প্রস্তাব তিনি মেনে নেননি। কিন্তু ওই চাপ দিন দিন বাড়তে থাকে।

ঘটনার দিনের ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজানের নেতৃত্বে বেশ কয়েকজন কর্মী ক্যাম্পাসের রাস্তায় ড. সেলিম হোসেনের গতিরোধ করেন এবং কথা বলেন। পরে ছাত্রলীগ নেতারা শিক্ষককে নিয়ে তড়িৎ প্রকৌশল ভবনে শিক্ষকের কক্ষে প্রবেশ করেন। তারা প্রায় আধা ঘণ্টা ড. সেলিম হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখান থেকে বাড়ি ফিরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন ড. সেলিম হোসেন। বৈঠকের সময় ওই কক্ষে কী ঘটেছিল- সে প্রশ্নই এখন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শুক্রবার সকালে কুয়েটে গিয়ে দেখা যায়, তড়িৎ প্রকৌশল ভবনের প্রধান ফটকে তালা ঝোলানো। সিন্ডিকেটের বৈঠক, ছাত্রলীগের অবস্থান নিয়ে ক্যাম্পাসে তখন উত্তেজনা বিরাজমান। ছুটির কারণে তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কেউই ক্যাম্পাসে নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ক্লাস শেষে ড. সেলিম হোসেনের সঙ্গে একাডেমিক ভবন থেকে বের হন সহকারী অধ্যাপক আলমগীর হোসেন। আলমগীর হোসেন বলেন, ‘বের হওয়ার পর কিছু ছাত্র এসে সেলিম হোসেনকে সালাম দিল। সালাম দেওয়ার ভঙ্গিটাই অস্বাভাবিক ছিল। একজন ছাত্র কখনও একজন শিক্ষককে ওইভাবে সালাম দেয় না। ওদের ভঙ্গিটা আমার পছন্দ হয়নি। ওরা বললো, স্যার আমাদের কিছু কথা আছে। তখন ড. সেলিম বলেছিলেন, যেহেতু হলের বিষয়ে কথা, সন্ধ্যায় হলের অফিসে আসো। তখন তারা বলল- না, স্যার। আমরা সবাই এসেছি, এখনই বলতে হবে। তখন সেলিম হোসেন বলেন, তাহলে এখানেই বলো। তখন ওই ছাত্ররা সেলিম হোসেনকে বলল, এখানে বলা যাবে না, আপনার অফিসে চলেন। সেলিম হোসেনের অনিচ্ছায় অনেকটা জোর করে ওই ছাত্ররা তাকে অফিসে নিয়ে যায়।’

আলমগীর হোসেন বলেন, এই কথাগুলো রাস্তায় আমার সামনেই হয়েছিল। এরপর আমি ব্যাংকে চলে যাই। ওরা সেলিম হোসেনকে নিয়ে তার অফিসে চলে যায়। ওদের অঙ্গভঙ্গি ভালো না থাকায় আমি ব্যাংক থেকে বের হয়ে সেলিমকে আবার ফোন দেই। তখন সব ঠিক আছে কিনা জানতে চাই। ওরা এখনও আছে কিনা জানতে চাইলে সেলিম হ্যাঁ সূচক জবাব দেন।

ড. সেলিম হোসেনকে নিয়ে ছাত্ররা যে কক্ষে প্রবেশ করে সেখানে সর্বোচ্চ ৫-৬ জন বসা যায়। কিন্তু ছাত্রলীগের প্রায় ২০-২৫ জন নেতাকর্মী ওই কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করে। কক্ষের সামনে দাঁড়িয়েছিল আরও বেশ কয়েকজন। দুপুরের খাবার সময় হওয়ায় বিভাগের অন্য শিক্ষক, অফিস সহকারী কেউই ভবনে ছিলেন না। যার কারণে কক্ষে ঠিক কী হয়েছিল তা জানা যায়নি। কক্ষ থেকে বের হয়ে ড. সেলিম হোসেন বাসায় চলে যান।

ড. সেলিম হোসেনের স্ত্রী সাবিনা খাতুন এখন কুষ্টিয়ায় বাবার বাড়িতে অবস্থান করছেন। মোবাইল ফোনে তিনি বলেন, 'কেন সবাই বার বার ফোন করে বিরক্ত করছেন। আমার তো সব কিছু শেষ হয়ে গেছে। আপনারা সিসি টিভি ক্যামেরার ভিডিও দেখেন। সিসি ক্যামেরা দেখলে সবকিছু পরিস্কার হয়ে যাবে।'

কুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রতীক চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ওই দিনের ভিডিও ফুটেজ, ঘটনার পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে সেলিম হোসেনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত শিক্ষকদের বক্তব্য শুনে আমাদের মনে হয়েছে ড. সেলিম হোসেনের মৃত্যু কোনো অবস্থাতেই স্বাভাবিক নয়। তাকে কিছু বিপথগামী ছাত্র মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে।

মুখ খুলছেন না ছাত্রলীগ নেতারা: কুয়েটে শিক্ষকের সঙ্গে ঠিক কী ঘটেছিল তা নিয়ে মুখ খুলছেন না ছাত্রলীগ নেতারা। ওই দিনের ঘটনার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে শুক্রবার বেলা ১১টায় খুলনা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছে কুয়েট ছাত্রলীগ। সেখানে লিখিত বক্তব্যে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজান বলেন, মঙ্গলবার দুপুর ১২টার সময় প্রভোস্ট নিজ অফিস কক্ষে ছাত্রকল্যাণ কমিটির মিটিং নির্ধারণ করেন। শিক্ষার্থীদের একাডেমিক কার্যক্রম শেষ করে পূর্বনির্ধারিত মিটিংয়ে যোগ দিতে আনুমানিক ৪০ মিনিট বিলম্ব হয়। ঘটনাক্রমে আমাদের দেরি হওয়ায় পথে স্যারের সঙ্গে দেখা হয় এবং তাকে বিলম্বের কারণ জানানো হয়। তখন তিনি আমাদের তার কক্ষে যেতে বলেন। এরপর স্যার কক্ষের তালা খুললে শিক্ষার্থীরা তার অনুমতিসাপেক্ষে ভেতরে প্রবেশ করে। সব শিক্ষার্থীর বসার জায়গা সংকুলান না হওয়ায় সিনিয়রদের ভেতরে বসতে এবং জুনিয়রদের কিছুক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করতে বলেন। সিনিয়রদের সঙ্গে তার শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর স্যার বাইরে অপেক্ষমাণ ছাত্রদের ডেকে নেন এবং বলেন আমার তো আড়াইটায় ল্যাব আছে আমি সন্ধ্যায় হলে গিয়ে তোমাদের সঙ্গে পরিচিত হব।

সেজান বলেন, এরপর স্যার সবাইকে চা অফার করেন কিন্তু পর্যাপ্ত কাপ না থাকায় এবং লাঞ্চ আওয়ার চলায় স্যারের অসুবিধার কথা ভেবে শিক্ষার্থীরা কিছু না খেয়ে চলে আসে। তখন স্যার তার রুমের দরজায় পাশে থাকা টেবিলে এক বোতল মধু দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের সেখান থেকে মধু খেয়ে যেতে বলেন। তখন জুনিয়র শিক্ষার্থীরা ভেতরে প্রবেশ করে মধু খায় এবং রুম থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়।

তবে ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে ওই দিন ড. সেলিমের কক্ষে গিয়েছিলেন এমন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই ছাত্রলীগ নেতার কাছে পৃথকভাবে আলোচনার বিষয় জানতে চাওয়া হয়। তারাও পুরো বিষয়টি এড়িয়ে যান। এর মধ্যে কুয়েট ছাত্রলীগের উপ-গণযোগাযোগ ও তথ্য সম্পাদক জামিউর রহমান হাসিব বলেন, ক্লাস শেষ করে শুনি বড় ভাইরা স্যারের সঙ্গে দেখা করতে যাবে। তখন আমিও সঙ্গে যাই। কিন্তু স্যারের সঙ্গে কী কথা হয়েছে, আমি শুনিনি।

শুক্রবার সকালে কুয়েটের প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি ও ৫ দফা দাবিতে উপাচার্যকে স্মারকলিপি দেয় ছাত্রলীগ। এই কর্মসূচিতে মঙ্গলবার ড. সেলিমের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া ছাত্রলীগের ৪২ নেতাকর্মীর কেউ উপস্থিত ছিলেন না।

এ ব্যাপারে কুয়েট ছাত্রলীগের সহসভাপতি নিবিড় রেজা ও খন্দকার তরিকুল ইসলাম তিলক বলেন, যেহেতু তাদের বিরুদ্ধে শিক্ষকরা ইতোমধ্যে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন, সে কারণে তাদের এই কর্মসূচিতে আনা হয়নি। নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটির মাধ্যমে তদন্ত করে যদি তাদের মধ্যে কেউ দোষী সাব্যস্ত হয় তাহলে তারা ওই নেতাকর্মীদের পক্ষে অবস্থান নেবেন না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে যে সিদ্ধান্ত নেয় তারা তা মেনে নেবেন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0034949779510498