কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়ার লাশ উদ্ধারের ঘটনা নানা রহস্যের জন্ম দিয়েছে। গুলশানের লাখ টাকা ভাড়ার বাসায় ওই কলেজছাত্রী একাই থাকতেন। ঘটনার পর তার পরিবারের দায়ের করা মামলায় আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগ আনা হয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের বিরুদ্ধে। মামলা দায়েরের পর আনভীরের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন আদালত। তবে, এ ঘটনায় আরও একটি নাম উঠে আসছে। সেটি হলো পিয়াসা। যা নতুন প্রশ্নের সৃষ্টি করছে। তবে, পিয়াসাকে নিয়ে পুলিশ, নিহতের পারিবারের পক্ষ থেকে কোন তথ্য গণমাধ্যমকে দেয়া হয়নি।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার এজাহারে নাম ছিল ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসার। প্রথমে মামলা করতে ভুক্তভোগীদের সহযোগিতা করেছিলেন পিয়াসা। কিন্তু সেই পিয়াসার বিরুদ্ধেই আবার মামলা তুলে নেয়ার হুমকির অভিযোগে জিডি করেছিলেন ভুক্তভোগী। চার বছর পর আবারও আলোচানায় সেই পিয়াসা।
আরও পড়ুন : দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব ও ফেসবুক পেইজটি ফলো করুন
জানা যায়, এই পিয়াসা হলেন ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসা, যিনি চার বছর আগেও রেইনট্রি হোটেলে দুই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের ঘটনায় আলোচনায় এসেছিলেন। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ জুয়েলারি শপ আপন জুয়েলার্সের কর্ণধার দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদ ছিলেন ওই ধর্ষণ মামলার অন্যতম আসামি। পিয়াসা ছিলেন সাফাত আহমেদের সাবেক স্ত্রী। রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের ওই ঘটনার কিছুদিন আগেই সাফাতের সঙ্গে পিয়াসার ডিভোর্স হয়েছিল। ওই ঘটনার পর দিলদার আহমেদ তার সাবেক পুত্রবধূ পিয়াসার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। পিয়াসাও সাবেক শ্বশুর দিলদার আহমেদের বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা দায়ের করেছিলেন।
সেসময় আপন জুয়েলার্সের কর্ণধার তার ছেলের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার নেপথ্য কারিগর হিসেবে পিয়াসাকে অভিযুক্ত করেছিলেন। পরে অবশ্য তাদের মধ্যে সমঝোতা হয় বলে খবর প্রকাশ পায়। ধর্ষণের শিকার দুই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে সহায়তার কথা স্বীকার করলেও কয়েকদিনের মাথায় পিয়াসা তাদের মীমাংসা করার জন্য চাপ দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী। এজন্য পিয়াসার বিরুদ্ধে দুটি সাধারণ ডায়েরিও করেন তিনি।
দৈনিক শিক্ষা পরিবারের নতুন সদস্য ‘দৈনিক আমাদের বার্তা’
এদিকে মুনিয়ার লাশ উদ্ধারের মামলার এজহারে ‘ফারিয়া মাহবুব পিয়াসার’ নাম উল্লেখ করেছেন মামলার বাদি ও কলেজছাত্রী মুনিয়ার বোন নুসরাত জাহান। নুসরাত জাহান জানিয়েছেন, তার বোন মিরপুর ক্যান্ট. পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। ঢাকায় থাকাকালেই আনভীরের সঙ্গে পরিচয়। পরিচয় থেকে প্রায়ই ফোনে কথা হতো। দেখা হতো বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে স্ত্রী পরিচয়ে বনানীর একটি বাসা ভাড়া নিয়ে মুনিয়াকে নিয়ে থাকতেন আনভীর। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে আনভীরের পরিবার এক নারীর মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পারে। ওই সময় ফারিয়া মাহবুব পিয়াসাকে দিয়ে মুনিয়াকে নিজেদের বাসায় ডেকে নেন আনভীরের মা। বাসায় নিয়ে তাকে হুমকি-ধমকি দেন। আনভীরের সঙ্গে মেলামেশা করলে পরিণতি হবে কঠিন। শর্ত দেন বেঁচে থাকতে চাইলে ঢাকা ছেড়ে চলে যেতে হবে।
পুলিশ ও নিহতের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ওই সময়ে আনভীরও তাকে কুমিল্লা চলে যেতে বলেন। ওই সময়ে করোনার প্রকোপ দেখা দেয়। অবস্থা প্রতিকূল দেখে ঢাকা ছেড়ে কুমিল্লা চলে যান মুনিয়া। এরমধ্যে আবার আনভীর তাকে ডাকেন। বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দেন। যেহেতু তার পরিবার এটি মানছে না তাই বিয়ে করে বাইরের কোনো দেশে মুনিয়াকে সেটেল করবেন বলে জানান। এক পর্যায়ে গত ১ মার্চ গুলশানের ওই বাসা দুই বছরের জন্য ভাড়া নেন মুনিয়া। সম্পর্ক ভালোই চলছিল তাদের। প্রায়ই ওই বাসায় আসা-যাওয়া করতেন আনভীর। দেয়ালে ঝুলানো ছিল তাদের অন্তরঙ্গ বিভিন্ন ছবি। কিন্তু মুনিয়াকে নিয়ে বাইরে প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করতেন না আনভীর।
এজাহারের এ অংশের এসেছে পিয়াসার নাম। বলা হয়েছে, গত ২৩ এপ্রিল ওই বাড়ির মালিকের বাসায় ছিল ইফতার পার্টি। ওই পার্টিতে গিয়েছিলেন মুনিয়া। সেসব ছবি ফেসবুকে আপলোড করেন বাড়ির মালিকের মেয়ে। এটি নজরে পড়ে পিয়াসার। পিয়াসার মাধ্যমে জানতে পারেন আনভীরের মা। এ নিয়ে আনভীরের সঙ্গে কথা হয় তার মায়ের। তারপর আনভীর ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুনিয়ার ওপর। এ বিষয়ে মামলার এজাহারে মুনিয়ার বোন নুসরাত জাহান উল্লেখ করেছেন, মুনিয়া তাকে ফোন করে বলেছে আনভীর তাকে বকা দিয়েছেন। বলেছেন, মুনিয়া ফ্ল্যাটের মালিকের বাসায় গিয়ে ইফতার করেছে কেন, কেন ছবি তুলেছে। এসব ছবি? পিয়াসা দেখেছে। পিয়াসা তার (আনভীর) মাকে সবকিছু জানিয়ে দিয়েছে। এজাহারে বলা হয়, আসামি মোসারাতকে বলে, তিনি দুবাই চলে যাচ্ছেন, সে যেন কুমিল্লায় চলে যায়। আসামির মা জানতে পারলে তাকে (মুনিয়া) মেরে ফেলবেন। এজাহারে নুসরাত আরও উল্লেখ করেছেন, দু’দিন পর ২৫ এপ্রিল মুনিয়া তাকে ফোন করেন। ওই সময় কান্নাকাটি করে মুনিয়া বলেন, আনভীর তাকে বিয়ে করবেন না, শুধু ভোগ করেছেন।
মুনিয়া তাকে আরও বলেছেন, আনভীর বলেছেন, মুনিয়া তার শত্রুর সঙ্গে দেখা করেছেন। মুনিয়াকে তিনি ছাড়বেন না। মুনিয়া চিৎকার করে বলেন, আসামি তাকে ধোঁকা দিয়েছে। যেকোনো সময় তার বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তারা (বাদী নুসরাতের পরিবার) যেন দ্রুত ঢাকায় আসেন।
এদিকে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ঘটনা তদন্তে ফারিয়া মাহবুব পিয়াসাকে জিজ্ঞেসাবাদ করা হবে।
ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসা নতুন করে আলোচনায় আসার পর তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন সংবাদিকরা। তিনি জানান, ‘হ্যাঁ, আমি। আমিই বিষয়টি আনভীর ভাইয়ের মাকে বলেছি। আনভীর ভাইয়ের আগের সংসার রয়েছে। সেটি বাঁচানোর জন্য আমি উদ্যোগ নিয়েছিলাম। এতে কি আমার অপরাধ হয়েছে?’
ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসা আরও বলেন, ‘এই ঘটনার নেপথ্যে আরও অনেক কাহিনী আছে। এই মেয়ে (মুনিয়া) তো একটা সাইকো ছিল। আনভীর ভাই বিবাহিত জানা সত্ত্বেও কেন তার দেয়া ফ্ল্যাটে থাকা শুরু করেছিল? তাকে তো আগে আমরা কুমিল্লায় পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। সে লোভী। সে একটা... (প্রকাশযোগ্য নয়)।’
এই ঘটনায় চট্টগ্রামের হুইপপুত্র শারুণের যোগসাজস রয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।