কোচিং সেন্টার ট্রেড লাইসেন্স, শিক্ষা বাণিজ্যিকীকরণের চূড়ান্ত ধাপ

জীবন কৃষ্ণ সরকার |

সদ্য চূড়ান্তকৃত শিক্ষানীতিমালায় সকল প্রকার প্রাইভেট-কোচিং বন্ধ ঘোষণা করলেও অনুমতি দেয়া হয়েছে বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টার। যেটাকে শিক্ষা বাণিজ্যিকীরণেরই চূড়ান্ত ধাপ হিসেবেই দেখছেন দেশের শিক্ষাপ্রেমী সমাজ। তাও আবার কোনো স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা ওখানে শিক্ষকতা করতে পারবেন না। তার মানে দাঁড়ালো, অশিক্ষক দ্বারাই পরিচালিত হবে এসব কোচিং সেন্টার। আর এখানেই আমার প্রশ্ন- একজন মানুষ যত বড় শিক্ষিতই হোক, পেশাগত দক্ষতাকে কি তিনি ডিঙ্গাতে পারবেন?

মনে রাখা উচিত ‘শিক্ষিত হওয়া আর শিক্ষক হওয়া এক নয়’। কারণ অনেক সাধনা করে একজন শিক্ষক পেশাগতভাবে দক্ষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেন। তাই যদি না হতো তাহলে মাননীয় কর্তা ব্যক্তিদের কাছে আমার প্রশ্ন- অশিক্ষকরাই যোগ্য হয়ে যায় তাহলে হাজার হাজার শিক্ষককে কোটি কোটি টাকা খরচ করে প্রশিক্ষণের দরকার আছে?

তাছাড়া, সরকারে দ্বিমুখী নীতিতে বিভ্রান্ত হচ্ছে সকলেই। যেমন, একদিকে বলা হচ্ছে- সকল প্রকার প্রাইভেট কোচিং বন্ধ; অপরদিকে বলা হচ্ছে- বাণিজ্যিক কোচিং চলবে। তাও আবার বলা হচ্ছে- পেশাদারি কোনো শিক্ষক ওখানে শিক্ষকতা করতে পারবেন না। তাহলে জনগণ কোনটা বুঝবে? হয় এটা বলা হোক- কোচিং বৈধ, চলবে, তবে স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা থাকতে পারবেন না। কারণ ওদের কোনো উন্নতি হোক, সামাজিক সম্মান পাক তা আমরা চাই না; নতুবা বলা হোক- কোচিং অবৈধ, এটা সস্পূর্ণ রূপে বন্ধ। মাঝখানে আবার নাকো নাকোভাবে চলবে, চলবে না এই দ্বৈত নীতির কি দরকার বলুন?

আমি একজন শিক্ষক হিসেবে বলতে চাই, কোচিং সেন্টার বন্ধ হলেই ভালো। কারণ কোচিং করে সব শিক্ষক লাভবান নয়, গুটি কয়েক ছাড়া। অধিকন্তু প্রশ্নফাঁস, ছাত্রদের নম্বর কম দেয়া, মানসিক হেনস্থা করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে কোচিং ও কোচিংবাজ শিক্ষকদের  বিরুদ্ধে। অতএব সরকারের কোচিং নিষিদ্ধের ব্যাপারটিকে আমি ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি। এমনকি কোচিংয়ে জড়িত থাকার সম্ভাবনা যে সব শিক্ষক যেমন গণিত, বিজ্ঞান ও ইংরেজি বিষয় সংশ্লিষ্ট, আমি তাঁদেরই একজন (গণিত শিক্ষক) হিসেবে বলছি কোচিং নিষিদ্ধ হোক (শিক্ষকতা করতে আসছি, মহৎ পেশায় আসছি ব্যবসা করতে নয়)। কারণ কোচিং নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মাঝে অন্তঃকোন্দল পর্যন্ত দেখা দেয়। যার চড়া মূল্য দিতে হয় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। তাই বলে বাণিজ্যিক কোচিং চলবে এটা মেনে নিতে পারি না। আমাদের ছাত্রগুলো কোনো অশিক্ষকের হাতে নিরাপদ মানতে বা ভাবতেই পারি না।

এর প্রধান কারণগুলো হলো-

১. বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টারে শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে ভাই বলে। যেটা শিক্ষা জগতের কলঙ্ক। শিক্ষার্থীদের বেয়াদব হওয়ার জন্য এটাই প্রধান ধাপ। ওইখানে ভাইয়ের সাথে আড্ডা দিয়ে বিদ্যালয়ে এসেও একই আচরণ করে বা করতে চায়।

২. ওই সব কোচিং এ শিক্ষার্থীদের পড়ার বদলে বিনোদনের ব্যবস্থা রাখা হয় বেশি, যাতে করে শিক্ষার্থীরা আকৃষ্ট হয়। কারণ তারা শিক্ষার্থীদেরকে ক্লায়েন্ট হিসেবে দেখে, শিক্ষার্থী হিসেবে নয়। কে শিক্ষিত হলো আর হলো না এটা তাদের বিবেচ্য নয়। শেষ হিসেব, তাদের উপর ম্যানেজিং কমিটি বা শিক্ষা কর্মকর্তা কেউ চাপ প্রয়োগ করবে না।

৩.পাঠ্য পুস্তক না পড়িয়ে কেবল পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয় ফলে পাঠ্যবই বিমুখ হয়ে পড়ে শিক্ষার্থীরা।

৪. কোচিং আসক্ত ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থীই স্কুল বিমুখ হয়। কারণ সময় মেইন্টেইন করতে পারে না। যা বিদ্যালয়গুলো নৈমিত্তিক কার্যকলাপে বিরূপ প্রভাব পড়ে।

৫. কোচিংয়ে কৌশল করে গার্ডিয়ান খুশি করতে সব বিষয় পড়াতে গিয়ে গণিত ও ইংলিশ দুটি বিষয়েই শিক্ষার্থীরা দুর্বল হয়ে পড়ে। যে কারণে দুটো বিষয়েই খারাপ ফল করে।

৬. কোচিংয়ের শিক্ষকরা টেম্পরারি হওয়ায় পাসের দায়বদ্ধতা তারা নিতে চায় না। ফলে অনেকটা গাঁ ছাড়াভাবে শিক্ষাদান করেন তারা।

৭. কোচিংয়ের কারণে শিক্ষার্থীরা  নিয়মিত স্কুলে না আসায় ছাত্র-শিক্ষককের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। ফলে স্কুলে আন্তরিক ক্লাস নেয়া সম্ভব হবে না।

৮. শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির দরুন শিক্ষক ক্লাসে নিরুৎসাহবোধ করে। ফলে উপভোগ্য পাঠদান সম্ভব হয় না।

৯. এমন অনেক নজির রয়েছে কোচিং সেন্টার দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। কয়েক বছর পর অধিক লাভের আশায় একাডেমি খুলে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান করে ফেলেছে। কোচিংয়ের ট্রেড লাইসেন্স পেলে ওরা আরও বেপরোয়া হয়ে প্রচার-প্রচারণা চালাবে এবং পূর্বের কাজটি আরও করবে। ফলে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের ষোলকলা পূর্ণ হবে। সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজগুলো ছাত্র শূন্যতায় বন্ধের উপক্রম হবে। ফলে শিক্ষানীতিসহ সকল পরিকল্পনা বঙ্গোপসাগরে পতিত হবে।

১০. বর্তমানে শিক্ষকদের যা বেতন স্কেল তাতে অধিক লাভের আশায় অনেক দক্ষ শিক্ষক চাকরি ছেড়ে কোচিং ব্যবসা শুরু করতে পারেন। ফলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ১২টা বাজার পথ দ্রুত সুগম হতে পারে।

১১. কোচিং পড়ুয়া স্টুডেন্টরা ক্লাসে অমনোযেগী হয়। কারণ তারা মনে করে, কোচিংয়ে সব শিখে ফেলবে। এই ধান্দায় স্যারের কথা সে শুনতে চায় না। অন্যদের সাথে গল্পগুজব করে। ফলে নিজে তো নষ্ট হয়ই বরং আরও ১০ জনকে নষ্ট করে।

১২. কোচিংয়ের অদক্ষ শিক্ষকরা অনেক সময় ভুল শিক্ষা দেন। বর্তমান সৃজনশীল বইগুলো বেশ দুর্বোধ্য। আর প্রশিক্ষণবিহীন এসব শিক্ষক নিজে না বুঝে বাচ্চাদের অনেকাংশে ভুল শেখান যা জাতিকে অন্ধকারে ঠেলে দেবার জন্য যথেষ্ট।

অতএব, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আমার আকুল আবেদন, কোচিংকে যদি বৈধতাই দিতেই হয় তাহলে শিক্ষক সংশ্লিষ্ট কোচিংকেই দেন। প্রয়োজনে যেটা করতে পারেন- কোনো শিক্ষক কোচিংয়ে নিজের বিদ্যালয়ের একটি ছাত্রকেও পড়াতে পারবেন না, এমন নিয়ম করতে পারেন। তাহলেই শিক্ষার্থী হয়রানির মতো অভিযোগগুলোও আসবে না এবং সামগ্রিক ফলাফল আপগ্রেড হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। তা না হলে অশিক্ষক দিয়ে কোচিং বৈধতা দিলে হয়তো সরকার কিছু টাকা ট্যাক্স পেতে পারে, তবে শিক্ষার্থীদের কোনো উপকার তো হবেই না, অধিকন্তু অভিভাবকরাও টাকা গুনতে গুনতে দিশেহারা হতে হবে। সেই সাথে অতি শখের শিক্ষানীতির স্থান হবে ভাগারে।

লেখক : জীবন কৃষ্ণ সরকার, কবি ও প্রাবন্ধিক।

[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন।]


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি - dainik shiksha রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী - dainik shiksha গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট - dainik shiksha জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ - dainik shiksha আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0031709671020508