চাকরির কোটা বাতিলের ঘোষণায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। ঘোষণা অনুযায়ী চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা এবং নারী কোটা বাতিল, তবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও দুস্থদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে। অভিনন্দন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের। যদিও আন্দোলনকারীরা কোটা সংস্কার চেয়েছিলেন; বাতিল নয়। কিন্তু আমি মনে করি, যৌক্তিক কারণেই কোটা সম্পূর্ণ বাতিল হওয়া দরকার ছিল। প্রথম থেকেই আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান-নাতি-নাতনিদের কোটার বিপক্ষে। কারণ, সাধারণভাবে কোটা পদ্ধতি অধিক মেধাবীদের বঞ্চিত করে সমাজে বৈষম্যের সৃষ্টি করে। পেশাদারিত্বে মেধাবীদের তুলনায় কোটায় নিয়োগপ্রাপ্তরা দুর্বল হয়। এতে জনপ্রশাসনে মানসম্পন্ন সেবার ঘাটতি দেখা দেয়। এসবের ফলাফল, দীর্ঘমেয়াদে দেশ ও সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে বিভিন্নভাবে বৈষম্য বিরাজমান। যেমন নারী-পুরুষ, পেশা, অর্থনৈতিক অবস্থা, ধর্ম-বর্ণ ইত্যাদি। এ অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধার পোষ্যদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা অযৌক্তিক এবং বৈষম্যমূলক। অথচ একটা স্বাধীন, বৈষম্যহীন দেশ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র। একই মূল্যবোধ কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের কণ্ঠে উচ্চারিত। যেমন 'বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই'। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি জাতি কৃতজ্ঞ ও দায়বদ্ধ। তারা দেশ ও জাতির জন্য উল্লেখযোগ্য বিশেষ অবদান রেখেছেন এবং সে জন্যই তারা বিশেষ সুবিধার অধিকারী।
বিশেষ ক্ষেত্রে তাদের সন্তানরাও বিশেষ সুবিধা পেতে পারে। যেমন দুস্থ, অভাবী, শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের বিনা খরচায় স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ও বাসস্থানের সুযোগ; তাদের শিক্ষাজীবনে বই, পোশাক, যাতায়াত ভাতার ব্যবস্থা ইত্যাদি। কিন্তু নিয়োগ ও শিক্ষাক্ষেত্রে ভর্তি পরীক্ষায় মুক্তিযোদ্ধা পোষ্যদের অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে হবে। কারণ যথাযথ প্রতিযোগিতা, জীবনের চ্যালেঞ্জ মানুষের কর্মদক্ষতাকে শানিত করে। এর ফলে ব্যক্তি নিজে ও সমষ্টিগতভাবে সমাজ লাভবান হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের মতো তাদের সন্তান, নাতি-নাতনিরাও আদর্শ, মূল্যবোধে দেশ ও জাতির প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবে এবং মেধা-শ্রমে আত্মনির্ভরশীল হয়ে সমাজে অবদান রাখবে, সেটাই কাম্য।
কথায় বলে- 'স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন।' মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন এবং দেশকে স্বাধীন করেছেন। পরবর্তীকালে এ দেশকে রক্ষা করার কঠিন কাজটি করছেন মুক্তিযোদ্ধাসহ এ দেশের কৃষক-শ্রমিক, সৈনিকসহ সব পেশাজীবী। একসময় আমাদের দেশকে বলা হতো 'তলাবিহীন ঝুড়ি'। সম্প্রতি দেশ স্বল্পোন্নত দেশের অবস্থান থেকে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে। এই অগ্রযাত্রায় কমবেশি সবার অবদান আছে। ব্যবসায়ী-চাকরিজীবীদের দেওয়া আয়করে সরকারি কোষাগার পূর্ণ হয়। মাঠে-ঘাটে ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে কৃষক ফসল ফলায় বলেই দেশ খাদ্যে প্রায় স্ব্বয়ংসম্পূর্ণ। পোশাক কর্মীদের শ্রমের বিনিময়ে দেশ বৈদেশিক মূদ্রা আয় করে। আত্মীয়-স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন প্রবাসী শ্রমিকদের প্রেরিত অর্থে দেশ বিপুল বৈদেশিক মুদ্রায় সমৃদ্ধ।
দেশ গড়ার এসব কারিগরের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রবাসী শ্রমিকরা দেশান্তরিত হয়। দুর্ভাগ্যক্রমে কেউ কেউ লাশ হয়ে দেশে ফেরে। এমন একজন প্রবাসী শ্রমিকের সন্তানকে যদি প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষা বা নিয়োগ পরীক্ষায় কোটার ফাঁদে পড়তে হয়, তা রীতিমতো অন্যায্য। একই কথা প্রযোজ্য একজন কৃষক, একজন পোশাক কর্মীর সন্তানের ক্ষেত্রেও। এমতাবস্থায় সরকার মুক্তিযোদ্ধার পোষ্যদের কোটা বাতিলের ঘোষণা দিয়ে একটি সময়োপযোগী কাজ করেছে। উল্লেখ্য, সরকারের আয়ের উৎস এই প্রবাসী, কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ীসহ সব পেশাজীবীর কঠোর পরিশ্রম। এই আয়ের একটা অংশই সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে ব্যবহার করে।
বলাই বাহুল্য, জাতি হিসেবে আমাদের কর্মদক্ষতা ও পেশাদরিত্বে ঘাটতি রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেশের সরকারি সেবার মান সন্তোষজনক নয়। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে নিয়োগ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে লিখিত-অলিখিত কোটা ব্যবস্থা। নির্দিষ্টভাবে বলা যায়, আমাদের সরকারি প্রাথমিক শিক্ষার নিম্নমানের জন্য বিদ্যমান নারী কোটা অনেকটাই দায়ী, আমার মতে। সে জন্য নারী কোটার বিলুপ্তিতে প্রধানমন্ত্রীকে সাধুবাদ জানাই। বর্তমানে নারীদের জন্য কোটার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। নিয়োগে নারী কোটা প্রচলনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের সংস্কৃৃতি তৈরি করা, নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, নারীদের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো, অন্য নারীদের সামনে আদর্শ সৃষ্টি করা; সর্বোপরি কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সংখ্যায় সমতা আনা। আমাদের দেশে সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার উদ্যোগে নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সংস্কৃতি ইতিমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে শহর- সর্বত্র বিভিন্ন পেশায় পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণ লক্ষণীয়। সার্বিকভাবে জনসমক্ষে নারীদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে দৃশ্যমান। যেমন নির্বাচনে বিপুল সংখ্যক নারী ভোটারের অংশগ্রহণ। আদর্শ হিসেবে মেয়েদের সামনে এখন নারী পোশাক কর্মী থেকে শুরু করে নারী শিক্ষক, ডাক্তার, জেলা প্রশাসক, বিচারক, স্পিকার, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রীসহ অনেক উদাহরণ আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীর অধিক অংশগ্রহণ লক্ষণীয়।
যেমন প্রাথমিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য বিভাগ, পোশাক কারখানা। যদিও প্রায় সব কর্মস্থলে উচ্চপদে নারীর সংখ্যা এখনও সীমিত। কিন্তু উচ্চ অবস্থান অর্জন করতে মেয়েদের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় নিজ মেধা, যোগ্যতা প্রমাণ করেই সেখানে যেতে হবে। গত কয়েক দশক থেকে সরকারি ও বেসরকারিভাবে নারীদের শিক্ষা-প্রশিক্ষণে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ মেয়েদের ইতিমধ্যে অগ্রগতির মইয়ে আরোহণের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এখন মেয়েরা মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতা দিয়ে সেই মইয়ের সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছাবে; সেটাই প্রত্যাশিত। একটা সময় কর্মক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা বাড়িয়ে নারী-পুরুষ কর্ম-সংস্কৃতি সৃষ্টির প্রয়োজন ছিল। কোটার মাধ্যমে তা অর্জিত হয়েছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আমাদের সমাজ প্রকটভাবে পুরুষতান্ত্রিক। অন্যদিকে অধিকাংশ নারী আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তায় দুর্বল। ফলে কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত একজন নারীর পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো দ্বারা ব্যবহূত হওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং এতে সব নারীর অধিকার ও মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যথাযথ প্রতিযোগিতায় নিয়োগপ্রাপ্ত অনেক নারীও কর্মক্ষেত্রে অযাচিত কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণের শিকার হয়। সেখানে কোটা সুবিধা ভোগকারী একজন নারী নিজে থেকেই হীনমন্যতায় ভুগতে পারে অথবা অন্যরা তাকে 'কোটাধারী' হিসেবে কটাক্ষ বা হেয় দৃষ্টিতে দেখতে পারে। কোটা মানেই বিশেষ সুবিধা এবং বিশেষ সুবিধা নেওয়া; মানে গ্রহীতার দুর্বলতার প্রকাশ। তাই বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত একজন নারীর (পুরুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য) দুর্বলতার সুযোগে অন্যরাও তার কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা আদায় করতে বা চাপে রাখতে পারে। অন্যদিকে কোনো কোনো নারী পরিস্থিতির সঙ্গে আপস করে নিজে নারী হয়েও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একজন প্রতিনিধির ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে, যা সার্বিকভাবে নারীদের জন্য মঙ্গলজনক নয়। তবে সব কর্মস্থলে লিঙ্গবৈষম্য দূর করে জেন্ডার ভারসাম্য আনার প্রয়োজনীয়তা এখনও আছে। তবে তা কোটার মাধ্যমে নয়, বরং পেশা গঠনে নারীদের উৎসাহ ও অগ্রাধিকার দেওয়ার মাধ্যমে এ বৈষম্য দূর করা সম্ভব।
আমাদের দেশেই দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সেভাবেই করা হয়েছে। যেমন, নারী-পুরুষের মধ্যে প্রতিযোগিতায় সমযোগ্যতাসম্পন্ন নারীকে অগ্রাধিকার দেওয়া। একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জন পর্যন্ত এই নীতিমালা চলতে পারে। তবে এই নীতিমালা সরকারকেই ঘোষণা করতে হবে এবং এর কার্যকারিতা তদারকি করতে হবে। লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলে এই নীতিমালা শিথিল করা হবে। কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের ভারসাম্য আনতে আরও প্রয়োজন নারীবান্ধব কর্ম-পরিবেশ সৃষ্টি করা। অনেক শিক্ষিত মেয়েই গৃহস্থালি কাজ, বাচ্চা লালন-পালনের দায়িত্বের কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পেশাজীবনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারে না। এ ছাড়া জনসমক্ষে, কর্মস্থলে যৌন হয়রানির কারণেও অনেকের কর্মজীবন অধরা থেকে যায়। এসব বাধা দূর করে একটি সত্যিকার নারীবান্ধব সমাজ ও কর্ম-পরিবেশ তৈরি করা গুরুত্বপূর্ণ। তাহলেই অধিক সংখ্যক নারী নিজ যোগ্যতায় কর্মস্থলে নিজেদের অবস্থ্থান তৈরি করতে পারবে।
পরিশেষে, কিছু ব্যক্তি এই কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে অসম্মান করছেন, যা নিন্দনীয়। অনেকে এ আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন, যা কাম্য নয়। কারণ এতে একটা যৌক্তিক আন্দোলনে যুক্ত তরুণ প্রজন্মকে অসম্মান করা হয়। শিক্ষিত তরুণরা এই কোটা সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত এবং ইস্যুটা একান্তই তাদের নিজস্ব। তবে এমন একটা আন্দোলনে নানা আদর্শ, মূল্যবোধে বিশ্বাসী তরুণদের সমাবেশ অস্বাভাবিক কিছু নয়। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের এ আন্দোলনে পানি ঘোলা করে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। স্বস্তির বিষয়, শেষ পর্যন্ত সরকার এটা অনুধাবন করেছে। যে কোনো রাজনৈতিক ফাঁদ থেকে আন্দোলনকারীদের দূরে রাখা সরকারের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। প্রধানমন্ত্রীর কোটা বাতিলের ঘোষণা সেই দায়িত্বের অন্যতম অংশ। বলাই বাহুল্য, ঘোষণা ও বাস্তবায়ন সমার্থক নয়। আন্দোলনকারীরা এখন এই ঘোষণা বাস্তবায়নের সুস্পষ্ট তৎপরতা দেখতে চায়। সরকারও এ বিষয়টি নিয়ে যত কম রাজনীতি করবে, ততই মঙ্গল।
সমাজবিদ ও প্যারেন্টিং পেশাজীবী, যুক্তরাজ্য
সূত্র: সমকাল