শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড, এমন কথা প্রচলিত আছে বহুকাল ধরেই। আর জাতি গঠনের সূতিকাগার হলো বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিংশ শতাব্দীতে পূর্ব বাংলার শিক্ষা, সংস্কৃতি, আন্দোলন ও রাজনীতি আবর্তিত হতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান সৃষ্টির পর ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৬২ খ্রিষ্টাব্দের শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থান এবং ৭১ খ্রিষ্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকের ভূমিকা ছিলো অপরিসীম। স্বাধীনতার পরে বিভিন্ন সময়ে জাতির সংকটে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছে। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে স্বৈরাচার পতন আন্দোলন এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে উল্ল্যেখ করা যেতে পারে।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালে আমাদের হতাশ হতে হয়। যে উদ্দেশ্য এবং কর্মপরিকল্পনা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেই উদ্দেশ্য ও কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে অনেক পিছিয়ে আছে। ১৮১০ খ্রিষ্টাব্দে ভিলহেম ভন হামবোল্ট বিশ্ববিদ্যালয় নামক প্রতিষ্ঠানের জন্য তিনটি অপরিহার্য শর্তের কথা বলেন। তার প্রথম শর্তটিই ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। গবেষণালব্ধ জ্ঞান শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট কাঠামোগত ভিত্তি পাবে। আরো সহজভাবে বললে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য হলো গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি করা। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের মান যতো ভালো, সেই বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে ততো বেশি অগ্রসর।
একজন গবেষক কতোটা ভালো তা কিছু সূচকের ওপর নির্ভর করে। মূলত গবেষণার মান এবং তা ঠিক কতোটা মানসম্মত জার্নালে প্রকাশিত হলো সেটাই একজন গবেষকের মান নির্ধারণ করে থাকে। বর্তমান সময়ে অনেক গবেষক টাকার বিনিময়ে প্রিডেটরি জার্নালে ‘মানহীন’ লেখা ছাপিয়ে থাকেন। তারা এটি করে থাকেন মূলত প্রমোশন এবং উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য স্কলারশিপ পেতে।
অনেক সময় শিকারী বা প্রিডেটরি জার্নাল সম্পর্কে না জানার কারণেও এমন মানহীন জার্নালে গবেষকরা তাদের লেখা ছাপিয়ে থাকেন। ভালো এবং শিকারী জার্নালের মধ্যে পার্থক্য করা অনেক সময় খুবই কঠিন হয়ে যায়। তবে কিছু বৈশিষ্ট্য দেখে খুব সহজেই বোঝা সম্ভব কোনটি ভালো জার্নাল এবং কোনটি শিকারী জার্নাল। ভালো জার্নালগুলো একটি আর্টিকেল প্রকাশ করতে কমপক্ষে দুই থেকে তিন মাস সময় নিয়ে থাকে। কিন্তু ভুয়া জার্নালগুলো আর্টিকেল প্রকাশ করতে তূলনামূলক কম সময় নিয়ে থাকে। ভুয়া জার্নালগুলোতে আর্টিকেলের কোয়ালিটি কনট্রোল হয় না।
অনেক সময় জার্নালের এডিটোরিয়াল মেম্বার লিস্ট দেখেও বোঝা যায় কোনগুলো ভালো জার্নাল। ভালো জার্নালের এডিটোরিয়াল মেম্বাররা বিশ্ববিখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়ে থাকেন। অনেক বড় বড় জার্নালে তাদের গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়ে থাকে। কোনো জার্নাল কতোটা ভালো কিংবা মন্দ তা বোঝা যায় সেই জার্নালের ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর দেখে। যেই জার্নালের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর যতো বেশি, সেই জার্নাল ততো ভালো। কিছু ভালো ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর বিশিষ্ট জার্নাল হলো ন্যাচ্যার, ল্যানসেট, জার্নাল অফ দ্যা আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন ইত্যাদি। এ ছাড়া এলসেভিয়ার, পাবমেডের মতো পাবলিশার যেই সকল জার্নাল প্রকাশ করে থাকে সেগুলোও ভালো মানের জার্নাল।
গবেষকের মান নির্ধারণের জন্য বর্তমানে বহুল প্রচলিত সূচক হলো এইচ-ইনডেক্স। যার এইচ-ইনডেক্স যতো বেশি, তার গবেষণার মান ও গ্রহণযোগ্যতা ততো বেশি বলে ধরে নেয়া হয়। এইচ-ইনডেক্সের পাশাপাশি গবেষকদের মোট সাইটেশনকেও তার গবেষণা কর্মের মান নির্ণয়ের আরেকটি প্রভাবক হিসেবে ধরা হয়ে থাকে।
তবে মোট সাইটেশন সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে গবেষকদের র্যাঙ্কিং করলে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। এতে করে গবেষকদের সঠিক র্যাঙ্কিং হয় না। অনেক সময় দেখা যায়, গবেষক নিজেই তার গবেষণাপত্র সাইট করছেন। অথবা তার সহযোগীদের দিয়ে সাইট করিয়ে নিচ্ছেন। এতে করে অনেক সময় মানহীন গবেষণাপত্রের সাইটেশন সংখ্যা বেড়ে যায় বহুগুণে।
অনেক সময় দেখা যায়, কিছু প্রিডেটরি সংস্থা গবেষকদের র্যাঙ্কিং প্রকাশ করে থাকে। মূলত অর্থের বিনিময়ে সংস্থাগুলো এই ধরনের কাজ করে থাকে। তথ্য এবং জ্ঞানের স্বল্পতা থাকার কারণে অনেক পত্রিকা সেগুলো ফলাও করে প্রচার করে থাকে। অতি সম্প্রতি এডি সায়েন্টিফিক ইনডেক্স নামক একটি সাইট ‘ওয়ার্লড সায়েন্টিস্ট র্যাঙ্কিং-২০২৪’ প্রকাশ করে। যেখানে বাংলাদেশের ১০,০৩৩ জন গবেষক স্থান করে নিয়েছেন। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে এই তালিকায় স্থান পেয়েছিলেন ৯ হাজার ২৬২ জন।
ওই সংস্থাটি এই র্যাঙ্কিং করতে যেয়ে যেসব ক্রাইটেরিয়ার কথা উল্লেখ করেছে সেগুলো হলো- অবশ্যই গবেষকের গুগোল স্কলারে একাউন্ট থাকতে হবে এবং কমপক্ষে ৩০০ সাইটেশন থাকতে হবে, সেই সঙ্গে প্রোপার অ্যাড্রেস থাকতে হবে। এ ছাড়া ৯টি প্যারামিটারের কথা বলা আছে যা তারা প্রকাশ করবে না, বা তাদের ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে পরিষ্কার কিছু বলা নেই।
ইতিমধ্যে আমরা জেনেছি, সাইটেশনের ওপর ভিত্তি করে গবেষকদের র্যাঙ্কিং করলে কিছু সমস্যার উদ্ভব হয়ে থাকে। এতে করে গবেষকদের সঠিক র্যাঙ্কিং হয় না। এই সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জন পি. এ. ইওয়ানিডিসের নেতৃত্বে একদল গবেষক নতুন একটি সমন্বিত পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এই পদ্ধতি উদ্ভাবনে তারা একজন গবেষকের এইচ-ইনডেক্স ও সাইটেশন সংখ্যার পাশাপাশি আরো চারটি ইন্ডিকেটর ব্যবহার করেছেন। মোট ছয়টি ইন্ডিকেটরকে একসঙ্গে ব্যবহার করে প্রাপ্ত নতুন ইন্ডিকেটরের নাম দিয়েছেন সি-স্কোর। সি-স্কোর ব্যবহার করে প্রথিবীর যেসব বিজ্ঞান গবেষক কমপক্ষে পাঁচটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন, তাদের মধ্যে থেকে সেরা ২ শতাংশ গবেষকের একটি সমন্বিত তালিকা তৈরি করে থাকেন। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত তালিকায় বাংলাদেশের মোট ৯৭ জন স্থান পেয়েছিলেন। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের প্রকাশিত তালিকায় স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশের মোট ১৪২ জন গবেষক, যা ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৭৭ জনে উন্নীত হয়।
রিট্র্যাকশন ওয়াচ এর একটি প্রতিবেদনে উঠে আসে নর্থ ক্যারোলিনা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট ডক্টরেট করছেন তানভীর আহমেদ, তার ভাষ্যমতে ব্যক্তিগত র্যাঙ্কিংয়ের জন্য ৩০ ডলার করে গ্রহণ করে থাকে এডি সায়েন্টিফিক ইনডেক্স সাইটটি। এডি সায়েন্টিফিক ইনডেক্স যে র্যাঙ্কিং করে থাকে তা মূলত গবেষকদের শিকারে পরিণত করে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার। তিনি আরো বলেন, মূলত র্যাঙ্কিং সম্পর্কে জ্ঞান কম থাকা এবং মিডিয়ার কারণে লাইম লাইটে চলে আসছে এমন তালিকা। এই ধরনের র্যাঙ্কিং করার সময় সাইটটি পিআর রিভিউড জার্নাল আর্টিকেলের ব্যাপারে কোনো ধরনের গুরুত্ব দেয় না। যেটা র্যাঙ্কিংয়ের অন্যতম মানদণ্ড।
গবেষণার ক্ষেত্রে গবেষকদের তালিকার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো গবেষণার প্রতি তাদের একাগ্রতা। কোনো গবেষণা সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিবর্তনে কতোটুকু ভূমিকা রাখতে পারলো সেই বিষয়টিও বিবেচনাযোগ্য। গবেষণালব্ধ ফলাফল যদি কাজে না লাগানো যায়, সেক্ষেত্রে উক্ত গবেষণা কোনো ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে না।
বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো গবেষণাখাতে পিছিয়ে থাকার কারণ হলো- এই ক্ষাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ বরাদ্দ না থাকা। বরাদ্দের অভাবে অনেক গবেষণা মাঝপথে থেমে থাকে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে গবেষণাপত্র থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কিছুক্ষেত্রে পদোন্নতির জন্য গবেষণাপত্রের প্রয়োজন হয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের বেতন কম হওয়াতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের দৌঁড়াতে হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ক্লাস নিতে। এতে করে গবেষণার জন্য যে সময় প্রয়োজন তা থাকে না। এ ছাড়া গবেষণায় বরাদ্দ কম হওয়াতে অধিকাংশ শিক্ষক গবেষণা বিমুখতা দেখিয়ে থাকেন।
গবেষকদের তালিকা নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ। এই তালিকা গবেষকদের মধ্যে ইতিবাচক প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। কিন্তু ভুল তালিকা কিংবা আস্থাহীন কোনো ইনডেক্সের তালিকা বরং সেই পরিবেশ নষ্ট করবে। দেশের শিক্ষা ও গবেষণা খাতকে এগিয়ে নিতে জাতীয় পর্যায়ে প্রকৃত গবেষকদের মূল্যায়ন করতে হবে। শিক্ষা ও গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। আর এ কাজ করতে হলে প্রয়োজন এমন র্যাঙ্কিং যার ওপর আস্থা রাখা যায়।
লেখক: শিক্ষার্থী
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।