প্লাস্টিক ব্যবহার না করে আমাদের আধুনিক বিশ্বের একটি দিন কল্পনা করা কঠিন। প্লাস্টিক মানবজাতির জীবনযাত্রাকে সহজ করে তুলেছে। প্লাস্টিক মূলত এক ধরনের জৈব যৌগের পলিমার যা নমনীয় এবং প্রায় সবধরনের আকৃতি প্রদান করা সম্ভব। কম খরচ, সহজে উৎপাদন যোগ্যতা, বহুমূখিতা, পানির সাথে সংবেদনহীনতা ইত্যাদি কারণে প্লাস্টিক কাগজের ক্লিপ থেকে মহাকাশযানের বিভিন্ন ধরনের বহুমূখী পণ্যে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
প্লাস্টিকের বহুবিধ ব্যবহারের ফলে প্রতি বছর প্লাস্টিকের বিশ্বব্যাপী উৎপাদন ৪০০ মিলিয়ন মেট্রিক টন ছাড়িয়েছে। কিন্তু প্লাস্টিকের কিছু অপরিপূর্ণতা আমাদের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। এই সংকট বিকট রূপ ধারণ করেছে। প্লাস্টিক সৃষ্ট সমস্যা হলো প্লাস্টিকের বর্জ্যসমূহ। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় প্লাস্টিকের উপস্থিতি সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সম্প্রতি থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে ছোট্ট পাইলট তিমির পেটে প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিক দেখে আঁতকে উঠেছে সবাই। প্লাস্টিক থেকে ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক সংক্রমণ হয়ে যাওয়ায় ধীরে ধীরে মারা যায় তিমিটি। বর্তমান হারে প্লাস্টিক উৎপাদন চলতে থাকলে ওজনের হিসাবে বিশ্বের জলরাশিতে যে পরিমাণ মাছ আছে ২০৫০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ তার চেয়ে বেশি প্লাস্টিক থাকবে। প্লাস্টিক দূষণ পরিবেশের ওপর বিশেষ করে বন্যপ্রাণী, বণ্যপ্রাণীর আবাসস্থল এবং মানবজাতির উপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে।
নিয়মিত প্লাস্টিক পদার্থের ব্যবহার প্লাস্টিক দূষণের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। পলিথিন ব্যাগ, কসমেটিক প্লাস্টিক, গৃহস্থলির প্লাস্টিক এবং বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত বেশিরভাগ প্লাস্টিক পণ্যের রিসাইকেল বা পুনঃচক্রায়ন হয় না। প্লাস্টিক এমন এক রাসায়নিক পদার্থ যা পরিবেশে পচতে বা কারখানায় পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ করতে প্রচুর সময় লাগে। গ্লোবাল নমেডিক এর তথ্য অনুযায়ী শুধুমাত্র আমেরিকাতে প্রতিবছর ৫ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহৃত হয়। এগুলোর মধ্যে মাত্র ২৪ শতাংশ পুনঃচক্রায়ন করা হয়ে থাকে। ৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য আকারে মাটিতে ফেলে দেয়া হয়। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশেও উল্লেখযোগ্য হারে প্লাস্টিক বর্জ্য হচ্ছে।
এসব প্লাস্টিক বর্জ্যের বেশিরভাগ অপচনশীল ও অপ্রক্রিয়া যোগ্য। এসব ক্ষেত্রে ল্যান্ডফিল বা ভূমিভরাট করা হয়ে থাকে এই বর্জ্য দিয়ে, যা পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। পরিবেশের ক্ষতি আরও দীর্ঘায়িত হয়। কারণ প্লাস্টিক বর্জ্য শতবছর এমনকি হাজার বছর সময় নেয় পচে মাটির সাথে মিশতে। প্লাস্টিকের ব্যাগের কাঁচামালটি একটি পলিমার যৌগ, যা একটি স্থিতিশীল কাঠামোযুক্ত এবং প্রাকৃতিক মাইক্রোবিয়াল ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সহজে হ্রাস পায় না। অ-নবায়নযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যাগটি ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রাকৃতিকভাবে পচতে সময় নেয়। যদি বর্জ্য প্লাস্টিকের ব্যাগগুলি পুনর্ব্যবহারযোগ্য না হয় তবে তারা জমিতে মিশ্রিত হবে, যা মাটির সংকোচনের কারণ হবে, ফসলের দ্বারা পুষ্টি এবং পানির শোষণকে প্রভাবিত করবে, ফলস্বরূপ ফলন হ্রাস পাবে। জমি এবং জলে অব্যাহত বর্জ্য প্লাস্টিকের ব্যাগগুলি প্রাণী ও মাছকে খাদ্য হিসাবে গ্রাস করবে, ফলে মৃত্যু এবং প্রাণী ও মাছের বৃদ্ধি প্রভাবিত হবে। কিছু কিছু প্লাস্টিক বিষাক্ত হয় যা ধীরে ধীরে মাটি ভেদ করে ভূগর্ভস্থ পানির সাথে মিশে পানিকে ব্যবহার অযোগ্য করে।
এই প্লাস্টিক মানুষেরও মারাত্মক ক্ষতি করছে। খাদ্য চক্রের প্রক্রিয়ায় এই প্লাস্টিক মিশে যাচ্ছে, যা খেয়ে মানুষ ও প্রাণীকূল নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। প্লাস্টিক ব্যবহার পক্ষান্তরে প্লাস্টিক বর্জ্যের উৎপাদন কোনো ক্রমেই হ্রাস করা সম্ভব হচ্ছে না, এক্ষেত্রে টেকসই সমাধান হতে পারে প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে শক্তি উৎপাদন। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এটি একই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং শক্তির বিকল্প উৎস, এই দুটি সমস্যার কার্যকর সমাধান হতে পারে।
যেসব প্লাস্টিক বর্জ্যের পুনঃচক্রায়ন সম্ভব হয় না, সেসব ক্ষেত্রে আমরা ল্যান্ডফিলিং না করে প্লাস্টিক থেকে জ্বলানি তৈরি করতে পারি। এরকম একটি প্রক্রিয়ার নাম হলো পাইরোলাইসিস। এই প্রক্রিয়ায় প্লাস্টিক বা পলিমার যৌগগুলোকে পাইরোলাইসিস প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিয়ে গেলে সেগুলো না পুড়ে আনবিক বন্ধন শিথিল হয়ে স্রেফ তরলে পরিণত হবে। আর সেই তরল হবে উৎকৃষ্ট জ্বালানি। ব্যাস, সুপারভিলেইন প্লাস্টিক বর্জ্য তখন হয়ে পড়বে সুপারহিরোইন।
পাইরোলাইসিসে প্লাস্টিকগুলোকে অতিউত্তপ্ত করা হয়, কিন্তু তার ধারক বদ্ধ পাত্রে কোনো অক্সিজেন থাকে না। অক্সিজেন না থাকার কারণে হাইড্রোকার্বন যৌগ উত্তপ্ত হয় ঠিকই, কিন্তু কোনোভাবেই তাতে আগুন লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না, যৌগের পুড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। সুতরাং একটা বিশ্লেষিত তরল পদার্থ মেলে, এবং বলা হচ্ছে, সেটা নাকি আমাদের নিত্য ব্যবহার্য ডিজেলের চেয়ে রীতিমতো উত্তম জ্বালানি। তাহলে প্রতিবছর সারা বিশ্বে যে পরিমাণ প্লাস্টিকের পলিমার যৌগ উৎপন্ন হচ্ছে আর ডাস্টবিনের বোঝা বাড়াচ্ছে, ক্রমে নদী আর মাটিতে ক্ষতিকর গ্যাস মুক্ত করছে, পরিবেশ ধ্বংস করে পৃথিবীকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বাসের অযোগ্য করে তুলছে, সেই বিশাল পরিমাণটি শাপ না হয়ে হয়ে উঠবে বর। যে জ্বালানি তেলের দখল নিয়ে এত আন্তঃদেশীয় যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, সে যুদ্ধও রাতারাতি থেমে গিয়ে যুদ্ধবাজ নেতাদের হাতে হারিকেন ধরিয়ে দেবে।
প্লাস্টিকের পাইরোলাইসিসের মাধ্যমে এক কেজি পলিওলেফিন প্লাস্টিক থেকে ৬০০-৭০০ মিলি পেট্রোল অথবা ৮৫০ মিলি ডিজেল পাওয়া সম্ভব। কিংবা ৪৫০-৫০০ মিলি এরোমেটিক যার সাথে বাই প্রোডাক্ট হিসেবে কিছু পরিমাণ এলপি গ্যাস পাওয়া সম্ভব। তবে খরচ কিন্তু খুবই কম। মাত্র ৪০-৫০ টাকা। এই প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন তেলের গুণগত মান অনেক বেশি। এসব তেল আমরা গৃহস্থলি এবং বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করতে পারি। SRF এমন আরেকটি প্রক্রিয়া যেখানে প্লাস্টিক ও অন্যান্য বর্জ্য তাপ উৎপাদন করতে ব্যবহৃত হয়। এই পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় একে তাপ প্রদান করে অতি উচ্চ গুণগত মান সম্পন্ন গ্যাস, ডিজেল, কেরোসিন, কয়লা ও একটিভেটেড কার্বন এ পরিণত করা সম্ভব। এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, আমেরিকায় প্রতি বছর যে পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য ল্যান্ডফিলিং হয় তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে প্রায় ১৪ মিলিয়ন বাড়ির শক্তির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) সূত্রে জানা গেছে, প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ ২৩ হাজার ১১৮ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করে চসিক। শুধুমাত্র ঢাকাতেই ১৪ মিলিয়ন পিস পলিথিন ব্যাগ দৈনিক ব্যবহৃত হয়। পুরো বাংলাদেশে এই পরিসংখ্যন আরও ভয়াবহ। এক্ষেত্রে সমাধান হতে পারে প্লাস্টিক বর্জ্যের পুনরুদ্ধার বা পাইরোলাইসিস প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন তেল-গ্যাস। দেশের জ্বালানি সমস্যার টেকসই সমাধান হতে পারে প্লাস্টিক বর্জ্য শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহার করলে। প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন মারাত্মক পরিবেশ দূষণের হাত থেকে বাঁচাতে পারে, সেই সাথে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিক সমাধান হতে পারে।
লেখক : মো. বদিউজ্জামান লিমন, শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।
[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন।]