বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদে সদ্যই যোগ দিয়েছেন আহসান এইচ মনসুর। তবে ব্যাংকিংসহ খাতসহ অর্থনীতি বিষয়ক সব কিছু সম্পর্কেই পূর্ণভাবে ওয়াকিবহাল খ্যাতিমান এই অর্থনীতিবিদ। সম্প্রতি তার মুখোমুখি হয় দৈনিক আমাদের বার্তা। এ সময় বিদেশে পাচার হওয়া টাকা দেশে ফিরিয়ে আনা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সেবা সহজীকরণ, ঘুষ কমানো, ক্ষুদ্র ঋণের গতিপ্রকৃতি ও ভবিষ্যৎ ইত্যাদি বিষয়ে নিজের সুচিন্তিত মতামত তুলে ধরেন তিনি। তার সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন দৈনিক আমাদের বার্তার সিনিয়র রিপোর্টার রুমি আক্তার পলি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, মাইক্রো ফিনান্স এখনো আছে বাংলাদেশে, থাকবে আশা করি, কিন্তু এখানে পরিবর্তন হবে। কারণ কম্পিটিশন বাড়ছে। কম্পিটিশন বাড়ার কারণ এখন মোবাইল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিস। এখন নগদ, বিকাশ ঘরে ঘরে। এখানে কিন্তু টাকা রাখা যায়, এখান থেকে ধীরে ধীরে ন্যানো লোন দেয়া সম্ভব হয়। এই একটা টেকনোলজিক্যাল ইনোভেশনের কারণে মাইক্রো ফিনান্স একটা কম্পিটিশনের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে।
দৈনিক আমাদের বার্তার সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় তিনি এসব কথা বলেন।
গভর্নর বলেন, বড় বড় ব্যাংকগুলো ব্র্যাকব্যাংকসহ আরো অনেক ব্যাংক উদ্যোগ নিচ্ছে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের। এজেন্ট ব্যাংকিং এখন গ্রামে গ্রামে। প্রত্যেক ব্যাংকেরই হয়তো কয়েক হাজার এজেন্ট ব্যাংকিং আছে। এজেন্ট ব্যাংকিং থেকে কিন্তু লোন নিতে পারবে। আবার মাইক্রো ক্রেডিট আছে, থাকবে, অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিস্তৃতিও আছে, কিন্তু মোবাইল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিস খুব দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। প্রতি দিনে তারা মানি ট্রান্সফারই করছে শুধু সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। সাথে আছে এজেন্ট ব্যাংকিং এবং সাব ব্যাংকিং। আমি যেটা দেখছি ভবিষ্যতে কম্পিটিশন বাড়বে ফলে ঋণগ্রহীতা উপকৃত হবেন। তারা ঘরে বসেই ঋন পাবেন। এক্ষেত্রে ইন্টারেস্ট কমবে, যারা ২৫/২৬ শতাংশ ইন্টারেস্ট রেট রাখবে তারা হয়তো কম্পিটিশনে টিকতে পারবে না। তারা আউট হয়ে যাবে। ছোট ছোট যে ক্ষুদ্র ঋণ আছে সেগুলো হয়তো এই কম্পিটিশনে থাকতে পারবে না। যাদের টেকনোলজিক্যাল ইনোভেশনের সামর্থ্য নেই সেগুলো উঠে যাবে। থাকবে বড় কিছু মাইক্রো ফিনান্স যেমন ব্র্যাক, গ্রামীণ, প্রশিকা সহ ১০/১২টি প্রতিষ্ঠান। আগামী ১৫ বছর পরে এটাই হবে চিত্র।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে মুল সমস্যা ছিল সাবেক সরকারের সদিচ্ছার অভাব। আমরা জানতাম যে টাকা নিচ্ছে, কিন্তু সরকারের ইচ্ছে ছিলো না ফেরত আনার। একটা ইচ্ছা ছিলো খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর পাচার করা টাকা ফেরত আনার। এইক্ষেত্রে সাবেক সরকার সাকসেসফুল। কিন্তু আর কোনো দ্বিতীয় পদক্ষেপ ঐ সরকার নেয়নি। তারা তাদের কোনো স্বার্থের কারণে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। আমি মনে করি বর্তমান সরকার অবশ্যই উদ্যোগ নেবে। এই উদ্যোগটা দেশ থেকেই শুরু করতে হবে এবং যে দেশগুলোতে অর্থ পাচার হয়েছে সেই দেশের আইন অনুযায়ী ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় এটা করতে হবে।
বিশ্ব ব্যাংকেরও এখানে একটা রোল থাকতে পারে মন্তব্য করে তিনি বলেন, বিশ্ব ব্যাংক কিন্তু সরকারকে এই বিষয়ে সহায়তা করে এবং সরকার সহায়তা নিতে পারে। আমি মনে করি বর্তমান সরকার সব জায়গা থেকে এই বিষয়ে সহায়তা নেবে এবং সমন্বিতভাবে এই অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করা হবে।
অর্থ পাচার, শেয়ার বাজার লুট, ঋণ খেলাপির মতো বড় বড় ইন্সট্রুমেন্টের মাধ্যমে আর্থিক প্রতিষ্ঠান লুট বন্ধ করতে আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন বলেও মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর।
এ বিষয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, কিছু ব্যাংক আছে যেগুলোর মালিকানা পরিবর্তন করতে হবে। এরকম কিছু ব্যাংক আছে যেখানে বোর্ডে পরিবর্তন করতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই একমাত্র এটা করা সম্ভব। যদি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ নিজেদের একজন ব্যক্তিকে একসাথে ২০০ কোটি বা দুই হাজার কোটি টাকা রাতের অন্ধকারে দিয়ে দেয়, এটা ঠেকানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে সুশাসন, যাতে তারা এই কাজটা না করতে পারে। কিন্তু আমরা অতীতে দেখেছি এসব হয়েছে। রাত্রিবেলা ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে। ব্যাংকে রাতের বেলা হাজার কোটি টাকা লোন দেওয়া হয়েছে। ওই সব ব্যক্তিকে দেওয়া হয়েছে যাদের কোন ক্রেডিট হিস্ট্রি নেই। যারা কোম্পানি খুলেছে একমাস আগে। তারপর এক মাস পরে তাকে এক হাজার কোটি টাকার একটা ঋণ দেওয়া হয়েছে। এই ধরনের অনিয়ম তো হয়েছে। কিন্তু এটার কোন প্রতিকার হয় নাই। কারণ তারা রাজনৈতিকভাবে সুরক্ষিত ছিল। এখন রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছে। আমরা সুশাসন আশা করছি। আমরা আশা করছি যে এগুলার বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং এই অর্থ ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা চেষ্টা চালাবো।
বড় বড় দুর্নীতির নমুনা দেখে উৎসাহিত হয়ে ব্যাংক, বীমা, এনজিও, লীজ ফিন্যানসিং প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের নানাবিধ কার্যক্রমে মাঠপর্যায়ে প্রতিদিন হাজারো ছোট ছোট দুর্নীতি সংঘটিত হয়। দেশের আজকের সার্বিক পরিণতির জন্য বিগত ৫৩ বছরে সংঘটিত সেই সকল লাখো ছোট দুর্নীতিও তো যথেষ্ট বড় কারণ। ফিন্যানসিয়াল সেক্টরের মাঠ পর্যায়ে দুর্নীতি প্রবণতা রোধের জন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অন্তবর্তীকালীন সরকারকে গভর্নর হিসেবে কোনো প্রস্তাবণা দিবেন কিনা জানতে চাইলে আহসান এইচ মনসুর বলেন, যদি মাথাটা ঠিক থাকে, দুর্নীতিগ্রস্ত না হয়, তাহলে কিন্তু নিজের দিকে গুণগত পরিবর্তন করা সম্ভব বা হতে পারতো। আমি মনে করি যে সরকারকে একটা বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা নিতে হবে। ধরুন, ভূমি অফিসে গিয়ে আমি যেন পয়সা খরচ বা ঘুষ না দিয়ে, আমার যে ন্যায্য ফি তাই দিয়ে আমার দলিল সম্পাদন করে আমি আমার নাম জারি করতে পারি। একটা ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য যেন হয়রানি না করা হয়। দালালের মাধ্যমে আমার কাছে থেকে চাঁদা না নেওয়া হয়। যেন আন্যায্য মূল্যে সরকারি মূল্যে ও নির্দিষ্ট সময়ে দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে লাইসেন্স দিয়ে দেয়া হয়। পাসপোর্ট অফিসে গেলেও একই ধরনের হয়রানি হয়। এই ধরনের ৫০টি ক্ষেত্র আছে, ওখান থেকে পয়সা তোলা হচ্ছে, চাঁদাবাজি হচ্ছে। ব্ল্যাকমানির উৎপত্তি এভাবেই হচ্ছে। আবার এখান থেকেই কিন্তু টাকা পাচার হচ্ছে। এই জায়গাটা বন্ধ করতে পারলে জনগণ উপকৃত হবে, সেবাটা পাবে। এটা করাটা যে কঠিন তা আমি মনে করি না। এখন ছাত্ররাই যেটা বলছে যে, এখন যদি কেউ ঘুষ চায় তাহলে একটা ইমেইল নাম্বারে ইমেইল করলে ছয় ঘণ্টার মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই ধরনের তৎপরতাকে যদি আমরা দেশব্যাপী নিয়ে যেতে পারি, তাহলে কিন্তু এইটা কমিয়ে ফেলা এবং বন্ধ করে ফেলা অসম্ভব মনে করি না। সেটা ভূমি অফিস হোক বা পাসপোর্ট অফিসে হোক। আমি মনে করি ওটা করা সম্ভব। কিন্তু সরকারকে এ ব্যাপারে কাজ করতে হবে। এবং যারা এটাকে তত্ত্বাবধান করবে, তারাও যেন দুর্নীতিগ্রস্ত না হয়।