ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় বই : উদ্যোগ ভালো, সমস্যা পড়ানো নিয়ে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

২০১৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় পাঠ্যবই দিচ্ছে সরকার। চলতি বছর পর্যন্ত পাঁচটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত  নিজেদের মাতৃভাষায় লেখা পাঠ্যবই দেয়া হয়েছে। কিন্তু উদ্যোগটি ভালো হলেও এসব বিষয়ে আলাদা শিক্ষক নিয়োগ করা হয়নি। প্রশিক্ষণের পরিস্থিতিও নাজুক। ফলে শিক্ষার্থীরা মাতৃভাষায় ভালোভাবে পড়ালেখা শিখছে না। শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন মোশতাক আহমেদ।

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়,  ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের কেবল তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত নিজেদের মাতৃভাষায় বই দেয়া হচ্ছে। ফলে চতুর্থ শ্রেণিতে গিয়ে একজন শিশুকে আবারও সারা দেশের শিশুদের মতোই সাধারণ পাঠ্যবই পড়তে হচ্ছে। এর ফলে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির মধ্যে ‘সেতুবন্ধ’ (ব্রিজিং) তৈরিতে সমস্যা হচ্ছে।

মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষিক শিক্ষা (এমএলই) বিষয়ক কমিটির সদস্য মতুরা বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, মাতৃভাষায় বই দেয়াটি বড় পাওয়া। কিন্তু সীমাবদ্ধতা হলো যাঁরা পড়াঁচ্ছেন তাদের নিয়ে।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে পাঁচটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রাক্-প্রাথমিক স্তরের শিশুদের মাতৃভাষায় লেখা বই দিয়ে এ কার্যক্রম শুরু হয়। এই পাঁচটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী হলো, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা (ককবরক), গারো ও ওঁরাও (সাদরি)। প্রাক্- প্রাথমিকের পর ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম শ্রেণি, গত বছর দ্বিতীয় শ্রেণি এবং চলতি বছর তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বইও মাতৃভাষায় ছাপিয়ে বিনা মূল্যে বিতরণ করা হয়। এ বছর এসব বই ছাপার জন্য খরচ হয়েছে ৬৮ লাখ ১৯ হাজার ৮৩৯ টাকা।

দ্বিতীয় পর্যায়ে আরও ছয়টি মাতৃভাষায় বই দেয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে মণিপুরিদের জন্য দুটি ভাষায় বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈ এবং তঞ্চঙ্গ্যা, খাসি, বম ও ম্রো।

এনসিটিবির একাধিক শিক্ষা বিশেষজ্ঞ বলেছেন, মাতৃভাষায় বই দেয়া হলেও বিদ্যালয়গুলোতে ঠিকমতো পড়ানো যাচ্ছে না। তার বড় কারণ শিক্ষকের অভাব। এনসিটিবির একজন সদস্য গত মঙ্গলবার বলেন, তিনি নিজেই একবার খাগড়াছড়ির একটি বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখেন, বই থাকলেও তা পড়ানো হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত এসব ভাষায় পড়ানোর জন্য আলাদা শিক্ষক নিয়োগ দেয়া যায়নি। কিছু প্রশিক্ষণ দিয়ে চালানো হচ্ছে।

খাগড়াছড়ির ৯টি উপজেলায় ৭০৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। পানছড়ি উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় রহিন্দ্রপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কথা হয় তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী জুয়েল ত্রিপুরা ও মিথি ত্রিপুরার সঙ্গে। তারা শুনেছে, অন্য বিদ্যালয়গুলোতে মারমা ভাষায় বই পড়ানো হয়। কিন্তু তারা প্রাক-প্রাথমিক থেকে আজ পর্যন্ত বই চোখেও দেখেনি।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম বলেন, বিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী ত্রিপুরা। অথচ বিদ্যালয়ে এত দিন পর্যন্ত কোনো ত্রিপুরা শিক্ষক ছিলেন না। দুই দিন আগে একজন যোগ দিয়েছেন।

সদর উপজেলার  ভাইবোনছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শ্রেণিতে পড়ে কৃষক আনাই মারমার ছেলে ক্যাজরিং মারমা। আনাই মারমা নিজেও মাতৃভাষার বই পড়তে পারেন না। বাড়িতেও ছেলেকে পড়ানোর মতো কেউ নেই। শুনেছেন বিদ্যালয়েও মারমা ভাষায় পড়াতে শিক্ষক নেই। আনাই মারমা বলছিলেন, অবস্থা এমন যে ছেলের বই বাড়িতেই পড়ে থাকবে।

অবশ্য গত বুধবার সকালে খাগড়াছড়ি সদরের খাগড়াপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। এখানে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত সব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষিত শিক্ষকের মাধ্যমে পড়ানো হচ্ছে মাতৃভাষার বই।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে ১০০ জন শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারিভাবে জাবারাং উন্নয়ন সংস্থা থেকে এ পর্যন্ত চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা ভাষার ১৪৫ শিক্ষক ও উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।

এনসিটিবির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, দেশে কমবেশি ৪০টির মতো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী থাকলেও বেশির ভাগেরই নিজস্ব লিপি নেই। এমনকি সাঁওতালদের নিজস্ব লিপি না থাকায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের ক্ষেত্রে কোন লিপি গ্রহণ করা হবে, এ নিয়ে দ্বিধাবিভক্তির কারণে বই দেয়া যায়নি।

ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয় ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সৌরভ শিকদার বলেন, এটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে সংশ্লিষ্ট মাতৃভাষার শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে এবং শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে হবে। শিক্ষকদের আগে এসব ভাষায় পড়তে ও লিখতে শেখানো দরকার। তাঁর পরামর্শ, নতুন করে আরও মাতৃভাষায় বই দেয়ার আগে ইতোমধ্যে যেসব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠ শিশুকে বই দেয়া হয়েছে, তার সফলতা কতখানি, সেটা মূল্যায়ন হওয়া দরকার।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
একাদশে ভর্তিতে কলেজ পছন্দে যে বিষয়গুলো মনে রাখতে হবে - dainik shiksha একাদশে ভর্তিতে কলেজ পছন্দে যে বিষয়গুলো মনে রাখতে হবে ছাত্রীকে যৌন হয়রানি: জুতার মালা শিক্ষককের - dainik shiksha ছাত্রীকে যৌন হয়রানি: জুতার মালা শিক্ষককের ঢাকা বোর্ডের এসএসসি: অসন্তুষ্টদের খাতা চ্যালেঞ্জ ১ লাখ ৮০ হাজার - dainik shiksha ঢাকা বোর্ডের এসএসসি: অসন্তুষ্টদের খাতা চ্যালেঞ্জ ১ লাখ ৮০ হাজার থমকে আছে শিক্ষক বদলি কার্যক্রম - dainik shiksha থমকে আছে শিক্ষক বদলি কার্যক্রম প্রশিক্ষক হতে শিক্ষকদের আবেদন আহ্বান - dainik shiksha প্রশিক্ষক হতে শিক্ষকদের আবেদন আহ্বান কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0038378238677979