দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। গভীর নলকূপের পানিতে পাওয়া যাচ্ছে সহনীয় মাত্রার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি লবণের উপস্থিতি। মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের পানির স্তর ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের সংস্পর্শে আসায় এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে। পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে সুপেয় পানির সংকটে পড়ে উপকূলবর্তী জেলাগুলোর বাসিন্দারা। বিশেষ করে স্কুলগুলোতে থাকা গভীর নলকূপের পানি পানের অযোগ্য হওয়ায় বিপাকে পড়ে শিশুরা। ক্লাস চলাকালীন দীর্ঘ সময় পানি পান না করে বা সামান্য পানি পান করে কাটাতে হয় তাদের। যার ফলে শরীরে পানি শূন্যতার সৃষ্টি হয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা দেখা দেয়। যেসব এলাকার শিশুরা এ ঝুঁকিতে রয়েছে তার অন্যতম হলো খুলনা জেলার উপকূলবর্তী কয়রা উপজেলা।
শিক্ষা অফিসের সূত্র বলছে, এ উপজেলায় মোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৪২। এসব বিদ্যালয়ে ২২ হাজার শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে। স্কুলগুলোতে থাকা নলকূপ বা আশপাশের নলকূপের পানিতে লবণাক্ততা বেশি।
কোথাও কোথাও আর্সেনিকের মাত্রা বিপদসীমার উপরে, কোনোটির পানিতে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে রয়েছে আয়রন। যার ফলে এসব নলকূপের পানি পানের অযোগ্য। এসব এলাকার বাসিন্দারাও সুপেয় পানির তীব্র সংকটে ভোগেন। স্কুলগুলোর পানিতেও রয়েছে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি লবণ, আর্সেনিক ও আয়রন। খড়িয়া মঠবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাখন লাল মণ্ডল বলেন, তার বিদ্যালয়ে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে পানির ট্যাংকির ব্যবস্থা করা হয়েছে তবে আগামী বর্ষা মৌসুম ছাড়া পানি সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে কয়রা উপজেলার অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থাপিত নলকূপের পানিতে ক্লোরাইড, আর্সেনিক ও আয়রনের মাত্রা পরীক্ষা করা হয়। বাংলাদেশের বেশির ভাগ অঞ্চলের পানিতে লবণের সহনীয় মাত্রা প্রতি লিটারে ১৫০-৬০০ মিলিগ্রাম। উপকূলের জন্য এ মাত্রা প্রতি লিটারে এক হাজার মিলিগ্রাম।
পানি পরীক্ষাগারের তথ্য বলছে, কয়রা থেকে ২৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নলকূপের পানি পরীক্ষা করা হয়। এতে তিনটি নলকূপের পানিতে লিটারে এক হাজার মিলিগ্রামের কম লবণ পাওয়া যায়। তিনটি নমুনায় দুই হাজারের কম, ১০টিতে তিন হাজারের ৭টিতে তিন হাজারের বেশি, বাকিগুলোতে প্রতি লিটারে চার-পাঁচ হাজার মিলিগ্রাম লবণ পাওয়া গিয়েছে। কয়রার আমাদি ইউনিয়নের দক্ষিণ চান্নির চক শিশু মেলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শুষ্ক মৌসুমে সুপেয় পানির ব্যবস্থা নেই। স্কুলের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ৩শ’ লিটার ধারণক্ষমতার একটি ট্যাংকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা হয়। তবে তাতে বর্ষাকাল শেষে পরবর্তী এক মাসের জন্য পানির জোগান থাকে। বাকি সময় পুকুরের পানি ফিটকিরি দিয়ে শিশুদের পানের ব্যবস্থা করা হয়। প্রধান শিক্ষক জোছিমোন্নেছা জানান, তার বিদ্যালয়ে ১৯৩ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। বিদ্যালয় চলাকালে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরের পুকুর থেকে ১০ টাকার বিনিময়ে দুই কলস পানি এনে তা ফিটকিরি দিয়ে বিশুদ্ধ করে শিশুদের খাওয়ানো হয়। ১৯৩ শিশুর জন্য দুই কলস পানি খুবই অপ্রতুল হলেও তা দিয়েই কাজ চালিয়ে নিতে হচ্ছে। সুপেয় পানির সমস্যা সমাধানে নতুন একটি নলকূপ স্থাপন করা প্রয়োজন। উপজেলার অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যলয়ে নেই সুপেয় পানির ব্যবস্থা। ভাগবা বন ফুল বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, তার বিদ্যালয়ে কোনো পানির ব্যবস্থা নেই। গড়িয়াবাড়ি বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সুকুমার থান্দার বলেন, ছেলে মেয়েদের বাড়ি থেকে পানি এনে পান করতে হয়। উপজেলা শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় কিছু স্কুল নিজেদের উদ্যোগে স্বল্প ধারণক্ষমতার ট্যাংকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করছে। তবে তাতে শুষ্ক মৌসুমে চাহিদা পূরণ হয় না। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কয়রার উপ-সহকারী প্রকৌশলী ইসতিয়াক আহমেদ বলেন, গত দুই বছরে লজিক প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে ১৫ থেকে ২০টি বিদ্যালয়ের ছাদে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য ট্যাংক স্থাপন করা হয়েছে। তা থেকে কিছুটা হলেও উপকৃত হচ্ছে বিদ্যালয়ের শিশুরা। উপজেলা শিক্ষা অফিসার মো. হাবিবুর রহমান বলেন, অনেক বিদ্যালয়ে সুপেয় পানির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আর যে সকল স্কুলে পানির ব্যবস্থা নেই সে সকল বিদ্যালয়ে প্রকল্পের মাধ্যমে পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা চলছে। এ ছাড়া কিছু এলাকায় শিক্ষার্থীরা স্কুলে অবস্থানের সময় পানি পায় না। ফলে কেউ কেউ বাড়ি থেকে বোতলে করে পানি নিয়ে আসে। এ সমস্যা কীভাবে সমাধান করা যায় তার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।