খাতা মূল্যায়নে পরীক্ষকদের অবহেলা!

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

সময়টা ১৯৯৯ সাল। এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। একজন ছাত্র পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি। তার বিশ্বাস ছিল তিনি দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হবেন। যদি দ্বিতীয় বিভাগেও উত্তীর্ণ হতে না পারেন তবে অন্তত তৃতীয় বিভাগে হলেও পাস করবেন। কিন্তু ফেল করবেন এটা তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। তাই খাতা পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন করেন তিনি। খাতা পুনঃনিরীক্ষণের আবেদনের ফলাফল এখন এক মাসের মধ্যে প্রকাশিত হলেও তখন লাগতো অনেক সময়। প্রায় ৪ মাস পর সেই ছাত্রের নামে একটি চিঠি আসলো, যেখানে বলা হলো খাতা পুনঃনিরীক্ষণের পর তিনি দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যে সেই ছেলে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার গ্লানি নিয়ে পাড়ি জমান বিদেশে। কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে। বিদেশে বসে জানতে পারেন তার পাসের কথা। তখন আর তার কিছু করার ছিল না। বিদেশ থেকে এসে দেশে উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হননি সেই ছাত্র। মানে তার শিক্ষা জীবন শেষ হয়ে গেল একটু ভুলেই। এটা একটি বাস্তব উদাহরণ মাত্র। এমন উদাহরণ আরও অসংখ্য থাকতে পারে। শনিবার (৭ সেপ্টেম্বর) দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

এবার মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। একজন শিক্ষার্থীর দীর্ঘ ১২ বছরের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের চূড়ান্ত ধাপ হচ্ছে এইচএসসি পরীক্ষা। এ সময় একজন শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়ে অপেক্ষায় থাকেন কাক্সিক্ষত ফলাফলের। কারণ এই ফলাফল একজন শিক্ষার্থীর জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এই দীর্ঘ সময়ের পরিশ্রমের পর কাক্সিক্ষত ফলাফলে একজন শিক্ষার্থী তার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করেন। তার সামনে হাতছানি দিয়ে ডাকে আরও বড় স্বপ্ন ছোঁয়ার। উচ্চশিক্ষায় নিজেকে নিয়োজিত করে তৈরি করবেন আগামীর জন্য। নিশ্চিত করবেন নিজের ও পরিবারের ভবিষ্যৎ। সর্বোপরি দেশের। কিন্তু এই সময়ে বিশেষ করে অনেক এইচএসসি শিক্ষার্থীর পরীক্ষা দিয়ে মনের মধ্যেশঙ্কা জাগে নিজের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে পারবেন কি না। কাক্সিক্ষত ফলাফল করে উত্তীর্ণ হতে পারবেন তো। একজন শিক্ষার্থীর জন্য এমন ভয় একেবারে অমূলক নয়। এমন ভয় যে তার জন্য যথার্থ, খাতা অবমূল্যায়নের চিত্র বিশ্লেষণ করলেই তা পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়।

সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে এইচএসসি পরীক্ষা খাতা পুনঃনিরীক্ষণের ফলাফল। এই ফলাফলের চিত্রই সেই প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে নতুন করে। যেখানে দেখা যায় পরীক্ষার ফলাফলে সন্তুষ্ট না হয়ে খাতা চ্যালেঞ্জ করে ২ হাজার ৭৩৯ জন পরীক্ষার্থীর ফলাফল পরিবর্তন হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে অবাক করা তথ্য হলো যেখানে প্রথমে ফেল করা বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী সর্বোচ্চ গ্রেড জিপিএ-৫ পেয়েছে। এটা আমাদের খাতা মূল্যায়নের গাফিলতির বিষয়টি নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে। শুধু তাই নয়, কাক্সিক্ষত জিপিএ-৫ না পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে পুনঃনিরীক্ষণের পর নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৩০০ জনের বেশি। আর সরাসরি ফেল করা শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে পাস করেছেন ছয়শ’র বেশি শিক্ষার্থী। প্রতি বছর এমন খাতা পুনঃনিরীক্ষণে ফলাফল পরিবর্তন হলেও এবার বিপুলসংখ্যক পরীক্ষার্থীর ফলাফল পরিবর্তনের বিষয়টি নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। পাশাপাশি এ বিষয়ে নতুন করে কিছু প্রশ্নের অবতারণাও হচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে খাতা নিরিক্ষণের পদ্ধিতির বিষয়টি নিয়েও।

অবশ্য ইতোমধ্যে বোর্ডের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যেসব পরীক্ষকদের গাফিলতির কারণে ফলাফলে পরিবর্তন এসেছে তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। এমন সিদ্ধান্ত অবশ্য স্বাগত জানানোর মতো। তবে প্রতি বছর এমন বিপুলসংখ্যক পরীক্ষকদের গাফিলতিও মেনে নেয়ার মতো নয়। কারণ পরীক্ষকদের গাফিলতির অর্থ হলো তারা খাতা মূল্যায়নের সময় যতটা মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন তা দেন না। এটা সত্যিই উদ্বেগের। একজন শিক্ষার্থীর সারা বছরের পড়াশোনার পর যদি পরীক্ষকের গাফিলতির কারণে পাস করা শিক্ষার্থীর ফলাফল ফেল আসে তবে তা সত্যিই দুঃখজনক। কিন্তু এটাই হচ্ছে প্রতিবছর। এমনটা হওয়ার পেছনে কিছু নেতিবাচক দিকও ফুটে ওঠে সমাজে। অনেক সময় দেখা যায় অনেক ছাত্রছাত্রী ফেল করার পর তা মেনে নেন, অনেক সময় তারা খাতা পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন করেন না। আবার এমনও দেখা যায় কাক্সিক্ষত ফলাফল না পেয়ে অনেক শিক্ষার্থী বেছে নেন আত্মহত্যার পথ। খাতা পুনঃনিরীক্ষণের ভাবনা তখন তারা ভাবেন না। কাক্সিক্ষত ফলাফল না পেয়ে বাবা-মার বকুনি, সমাজের কাছে ছোট হওয়ার ভয়ে তারা আত্মহত্যা করেন। অথচ অনেকে খাতা পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন করেন না এক্ষেত্রে।

এখন প্রশ্ন হলো- যদি পরীক্ষকের গাফিলতির কারণে এমনটা হয় তবে এর দায় আসলে কে নেবে? বোর্ডের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যেসব পরীক্ষক গাফিলতির সঙ্গে জড়িত তারা, সারা জীবনের জন্য কোনো বোর্ডে পরীক্ষক হতে পারবেন না। কেননা, বোর্ডের আইন অনুযায়ী এ ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার কথাই বলা হয়েছে। কিন্তু যারা খাতা মূল্যায়নের সময় গাফিলতি করেন তাদের এই শাস্তি যথেষ্ট নয়। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এসব পরীক্ষক শ্রেণী কক্ষে শিক্ষক হিসেবে যথাযথ দায়িত্ব পালন করেন কিনা। আবার এর দায় কি শুধুই পরীক্ষকের একার। এখানে শুধু পরীক্ষককে আসামি বানিয়ে শাস্তি দিলেই কি যর্থাথ হবে। আপাত দৃষ্টিতে এখানে পরীক্ষকের দোষ থাকলেও এখানে শুধু পরীক্ষককের দায় একার নয়। এখানে দায় সংশ্লিষ্ট সবার।

কারণ একজন পরীক্ষককে খুব অল্প সময় দিয়ে একগাদা খাতা ধরিয়ে দেয়া হয়। দ্রুত সময়ে খাতা জমা দিতে হবে বলে পরীক্ষকদের দ্রুত সময়ে খাতা মূল্যায়ন করার একটা চাপ থাকে। ভুলগুলো এ চাপের কারণে বেশি হয়। কেননা, তার পক্ষে এত অল্প সময়ের মধ্যে এত বেশিসংখ্যক খাতা দেখা কষ্টসাধ্য। অনেক তাড়াহুড়ো করে বেশিসংখ্যক খাতা দেখেন পরীক্ষক। যে কারণে ভুল হয়ে যায়। তাই নির্দিষ্ট বিষয়ে সর্বোচ্চ ১০০ খাতা একজন পরীক্ষককে দিলে অনেকাংশে ভুল কমে যাবে। এখন বিষয়টি বোর্ডকে নির্ধারণ করতে হবে। শুধু তাই নয়, খাতা মূল্যায়নে শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রয়োজন ভালো শিক্ষকদের এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা। ভালো শিক্ষকদের খাতা মনিটরিংসহ নানা উদ্যোগে নিতে হবে বোর্ডকে। যোগ্য শিক্ষকরা খাতা দেখার সঙ্গে সম্পৃক্ত না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতা যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। তাই তাদের সম্পৃক্ত করা খুবই জরুরি ও সময়ে দাবি। পাশাপাশি খাতা পুনঃনিরীক্ষণের পুরনো পদ্ধতি পরিবর্তন করাও জরুরি। এতে পরীক্ষা নিরীক্ষণের পদ্ধতিতে একটি ইতিবাচক শৃঙ্খলা আসবে। সার্বিকভাবে লাভবান হবেন শিক্ষার্থীরা। সর্বোপুরি শিক্ষাব্যবস্থার লাভ হবে।

এখানে আরও একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেসব শিক্ষার্থীর খাতা পুনঃনিরীক্ষণের পর ফলাফলে পরিবর্তন এসেছে তাদের উচ্চশিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে যেন কোন প্রতিন্ধকতার সম্মুখীন হতে না হয় সে বিষয়ে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। কেননা, ইতোমধ্যে অনেক উচ্চশিক্ষায় ভর্তির আবেদন করার সময়সীমা অনেক ভার্সিটিতে শেষ হয়ে গেছে। অনেক ভার্সিতে শেষের পথে। তাই খাতা পুনঃনিরীক্ষণের পর যাদের ফলাফলে পরিবর্তন এসেছে তাদের বিশেষ ব্যবস্থায় আবেদন করার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে।

লেখক : সাহাদাৎ রানা, সাংবাদিক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান - dainik shiksha সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা - dainik shiksha লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক কেনো বদলি চান - dainik shiksha শিক্ষক কেনো বদলি চান ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে - dainik shiksha ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036709308624268