শিক্ষানীতির বিপরীত গতিতে চলছে দেশের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা। এই শিক্ষার আওতা বাড়ছে। বাড়ছে প্রতিষ্ঠান, বাড়ছে শিক্ষার্থী কিন্তু বাড়ছে না জনবল, অবকাঠামো সুবিধা ও ‘লজিস্টিক সাপোর্ট’। এ কারণে বিশেষজ্ঞরা দেশে ব্যাপকভাবে অদক্ষ জনবল তৈরির আশঙ্কা করছেন।
২০১০ সালে প্রণীত ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’তে বলা হয়েছে, ‘বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত হবে ১ : ১২। এই শিক্ষানীতি প্রণয়নের ১২ বছরেও বিদ্যমান কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাতে ন্যূনতম উন্নতি হয়নি, উল্টো শিক্ষক-কর্মচারীদের অধিকাংশ পদই ফাঁকা রয়েছে। শনিবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন রাকিব উদ্দিন।
প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়, দেশে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের সংগঠন ‘ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ’র (আইডিইবি) তথ্য বলছে, খুঁড়িয়ে চলছে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা। গত আট-দশ বছর ধরে দেশের বিভিন্ন পলিটেকনিক, মনোটেকনিক এবং কারিগরি স্কুল ও কলেজে (টিএসসি) শিক্ষক-কর্মচারীর ৭০ শতাংশ পদই শূন্য আছে।
আইডিইবির সাধারণ সম্পাদক শামসুর রহমান বলেছেন, দেশের ইঞ্জিনিয়ারিং কাজের ৮৫ শতাংশই সম্পন্ন হয় ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাধ্যমে। কিন্তু তাদের দমিয়ে রাখতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিধিবিধান করা হয়েছে।
আইডিইবির তথ্য অনুযায়ী, গত আট-দশ বছর ধরে জনশক্তি ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান ব্যুরোর অধীন কারিগরি প্রতিষ্ঠানেও প্রায় ৬০ শতাংশ শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে।
এছাড়া বিভিন্ন টেকনোলজি ও কোর্সের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক ল্যাবরেটরি নেই। আবার কোথাও কোথাও ল্যাবরেটরি থাকলেও তাতে পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি নেই।
এই পরিস্থিতির মধ্যে কারিগরিতে শিক্ষার্থী আগের তুলনায় দ্বিগুণ-তিনগুণ বেড়েছে। এর বিপরীত দিকে তিনটি সেশনে ১৫০ মিনিট ক্লাস হওয়ার কথা। কিন্তু ক্লাসরুম, ল্যাবরেটরি ও যন্ত্রপাতির সংকটের কারণে সব ব্যাচ একত্র করে ৩০-৩৫ মিনিট ক্লাস নেয়া হয়। এর ফলে শিক্ষার্থীরা হাতেকলমে শিক্ষা পাচ্ছে না।
শিক্ষক-কর্মচারী স্বল্পতার কারণে কারিগরিতে অদক্ষ জনবল তৈরি হচ্ছে দাবি করে শামসুর রহমান বলেন, ‘কোনভাবে সিলেবাস শেষ করে শিক্ষার্থীদের পাশের সনদ দেয়া হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে বিদেশে দক্ষ কর্মী পাঠানো বন্ধ হয়ে পড়বে। ডিপ্লোমা শিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহ আরও কমে যাবে।’
শিক্ষক সংকটের কথা নাকচ শিক্ষামন্ত্রীর
শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ১৬ ফেব্রুয়ারি চাঁদপুরে সাংবাদিকদের বলেন, কারিগরি শিক্ষা বিভাগে শিক্ষক সংকট নেই। কারিগরি শিক্ষা বিভাগে গত চার বছরে অনেক শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। তার আগের ১০ বছরে কোন শিক্ষক নিয়োগ হয়নি।
সব সময়ই কোন না কোন শিক্ষক অবসরে যাচ্ছেন জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘কাজেই কিছু কিছু পদ সব সময় শূন্য হয়। আবার সেই শূন্য পদগুলোর চাহিদা দিয়ে আমরা পূরণ করি এবং এ নিয়োগ যে সহজ প্রক্রিয়া তা নয়, পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ হতে হয়। কাজেই সে প্রক্রিয়াটা চলমান আছে। তবুও কোথায়ও পদ শূন্য থাকলে সেগুলো পূরণ হয়ে হচ্ছে।’
শিক্ষানীতি ও এর বাস্তবায়ন
শিক্ষানীতির আলোকে সাধারণ ধারার মাধ্যমিক স্কুলে কারিগরি শিল্প, কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি বিষয়ে বৃত্তিমূলক শিক্ষা চালু করা হচ্ছে। কিন্তু পর্যাপ্ত শিক্ষক এবং এ সংক্রান্ত শিক্ষা উপকরণ পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ হচ্ছে না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০২০ ও ২০২১ শিক্ষাবর্ষে সারাদেশের ৬৪০ সরকারি ও বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নবম ও দশম শ্রেণীতে ‘বৃত্তিমূলক শিক্ষা’ চালু করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিটিতে দুই শ্রেণীতে দুটি বিষয় ‘ট্রেড’ চালু করা হয়েছে। বিষয়ভিত্তিক প্রতিটি বিদ্যালয়ে ন্যূনতম দুইজন শিক্ষক ও দুইজন ল্যাব অ্যাসিসটেন্ট আবশ্যক।
তিনটি শিক্ষাবর্ষ অতিবাহিত হলেও সবকটি বিদ্যালয়ে এখন পর্যন্ত ট্রেডভিত্তিক শিক্ষকই নিয়োগ হয়নি, ল্যাব অ্যাসিসটেন্টও নিয়োগ দেয়া হয়নি। সরকারি ২০টি বিদ্যালয়ের একটিতেও ‘বৃত্তিমূলক শিক্ষা’ পাঠদানের জন্য শিক্ষক ও শিক্ষা উপকরণ পরিচালনার জন্য জনবল নিয়োগ দেয়া হয়নি। ৬৪০টি বিদ্যালয়ে এ পর্যন্ত মাত্র ৮১৪ জন শিক্ষক নিয়াগ পেয়েছে।
শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে প্রতিটি উপজেলায় একটি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হবে। এছাড়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, লেদার ইনস্টিটিউটসহ এ ধরনের অন্যান্য ইনস্টিটিউটের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হবে।
জানতে চাইলে ‘বেসরকারি কারিগরি শিক্ষক সমিতি’র সভাপতি অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম সাজু বলেন, ‘সরকার কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দিচ্ছে। সেভাবে এর বাস্তবায়নও হতে হবে। বিপুল সংখ্যক শিক্ষকের পদ খালি রেখে, অবকাঠামোর ঘাটতি রেখে এবং সাধারণ শিক্ষা ধারার শিক্ষক দিয়ে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন হবে না।’
কারিগরি প্রতিষ্ঠানেও শিক্ষার্থী বাড়ছে
কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের আওতায় চারটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, একটি টেকনিক্যাল টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, একটি ভোকেশনাল টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, ৫০টি পলিটেকনিক/মনোটেকনিক ইনস্টিটিউট, ১৩৪টি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজসহ মোট ১৯০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা ও ডিগ্রি পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
২০১৯ সালে দেশে সরকারি ও বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল আট ৬৭৫টি। বর্তমানে সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি দশ হাজার ৬৮৪টি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলোতে বিভিন্ন ‘ট্রেড’ভিত্তিক কারিগরি শিক্ষা দেয়া হয়। মোট প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দুই ২৯৪টি এমপিওভুক্ত রয়েছে। বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মোট ১৪ লাখ ৬৩ হাজার ২৩০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে।
শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে দেশে কারিগরি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৯ লাখ ১৪ হাজার ৭১৭ জন। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে ১০ লাখ ৩৮ হাজার ৮২০ জন, ২০১৬ সালে ১১ লাখ আট হাজার ৭৭৮ জন, ২০১৭ সালে ১১ লাখ ৬৮ হাজার ৭৪৫ জন এবং ২০১৮ সালে কারিগরিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১২ লাখ ৬২ হাজার ৭৬১ জন।
কারিগরি শিক্ষায় সরকারের লক্ষ্যমাত্রা
এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০২০ সালের মধ্যে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার হার ২০ শতাংশ (মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের মোট শিক্ষার্থীর), ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে এ শিক্ষার্থী ৪১ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে।
সেই লক্ষ্য অর্জনে কাজ চলছে। বর্তমানে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষার্থীর হার ১৭ দশমিক ২৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ১০/১২ বছর আগেও তা ছিল ২/৩ শতাংশের মতো।
জানতে চাইলে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ (বিডিইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুনাজ আহমেদ নুর বলেন, সরকার কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছে। সেভাবে এই শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধাও বাড়াতে হবে।
সারাবিশে^ স্কিল্ড বেইজড শিক্ষার চাহিদা বাড়ছে জানিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের (বুয়েট) এই অধ্যাপক বলেন, ‘বাংলাদেশেও এখন বেশি প্রয়োজন স্কিল্ড বেইজড এডুকেশন (দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা)। এখানে এই শিক্ষা বিস্তারের যথেষ্ট সম্ভাবনাও রয়েছে। এই শিক্ষায় নির্দিষ্ট বিষয়ে জ্ঞান ও দক্ষতা লাভ করে শিক্ষার্থীরা সরাসরি কর্মক্ষেত্রে চলে যেতে পারে।’