খুবির তদন্ত কমিটির তদন্ত করতে হবে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন তিনজন শিক্ষককে স্থায়ীভাবে বহিস্কার করেছে। একই সঙ্গে দু'জন শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তির নির্দেশনা জারি করেছে। যে 'অপরাধে' এই শাস্তির বিধান জারি করা হলো, তার তদন্ত যথাযথভাবে না হওয়ায় অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলার সুযোগ নেই। উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামানের অনুগত শিক্ষকদের দিয়েই গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি। মঙ্গলবার (২৬ জানুয়ারি) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

অভিযোগের ধরন

কিছুদিন আগে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান 'উপাচার্যের কৈফিয়ত' শিরোনামে একটি প্রতিক্রিয়া জাতীয় দৈনিকের অনলাইনে লিখেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন- 'শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সমর্থনের অভিযোগ তুলে কাউকে চিঠি দেওয়া হয়নি। শিক্ষকদের লাঞ্ছনা, প্রশাসন ভবনে নারী-পুরুষকে আটকে রাখা একাডেমিক ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে বিঘ্ন সৃষ্টির বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।' উপাচার্যের ভাষ্যমতে, শিক্ষক লাঞ্ছিত হয়েছেন। বাস্তবে কোনো শিক্ষক লাঞ্ছিত হওয়ার কথা লিখিতভাবে জানাননি। গত বছর জানুয়ারিতে ন্যায়সংগত আন্দোলনে অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু অভিযোগ উত্থাপিত হলো তিন শিক্ষক এবং দুই শিক্ষার্থীর নামে। এতেই বোঝা যায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগ। এই অভিযোগে বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবুল ফজলকে বরখাস্ত, প্রভাষক শাকিলা আলম এবং ইতিহাস ও সভ্যতা বিভাগের প্রভাষক হৈমন্তী শুক্লাকে অপসারণ করা হয়েছে। এ শিক্ষকরা মূলত ন্যায়সংগত দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন।

তদন্তের আগেই প্রমাণ!

গত বছর জানুয়ারি মাসে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলন করছিলেন। সেই আন্দোলনে সংহতি প্রকাশকে উস্কানি আখ্যা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কোনোরকম তথ্য অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা ছাড়াই উস্কানি দেওয়ার প্রমাণ পাওয়ার কথা উল্লেখ করে ঘটনার ১০ মাস পরে কভিডকালে ব্যাখ্যা চেয়ে অভিযুক্তদের চিঠি দেওয়া হয়েছিল। এই প্রমাণ তারা কোথা থেকে পেলেন এ সংক্রান্ত তথ্য চেয়েও অভিযুক্তরা পাননি।

তদন্ত কমিটির প্রহসন

তদন্ত কমিটি গত ৩১ ডিসেম্বর অভিযুক্তদের একটি নোটিশ জারি করে। ১২ জানুয়ারির মধ্যে সেই নোটিশের জবাব দিতে বলা হয়। সেই জবাব অভিযুক্তরা লিখিত নাকি মৌখিক দেবেন, তা ১০ জানুয়ারির মধ্যে জানাতে বলা হয়। অভিযুক্ত শিক্ষকরা ১০ জানুয়ারি মেইল করে এবং সশরীরে লিখিত দিয়ে জানিয়েছেন, তারা লিখিত জবাব দিতে চান। সেই মোতাবেক তারা ১২ জানুয়ারি লিখিত জবাব দেন। তদন্তকারীরা তাদের প্রতিবেদনে ১০ জানুয়ারির চিঠিকে অস্বীকার করেন এবং এই অজুহাতে ১২ তারিখের জবাব তারা আমলে নেননি। অভিযুক্ত শিক্ষকদের দেওয়া নোটিশের জবাব আমলে না নিয়েই অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে আখ্যা দিয়ে শাস্তির জন্য চূড়ান্ত করা হয়েছে।

তদন্ত কমিটির স্বৈরতান্ত্রিক তদন্ত

অভিযুক্তরা অভিযোগের পক্ষে যেসব তথ্যাদি আছে শাস্তিপ্রাপ্ত শিক্ষকরা তা চেয়েও পাননি। শুধু তাই নয়, তথ্য অধিকার আইনে চাওয়ার পরও দেওয়া হয়নি। অভিযুক্তদের পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয়নি। কখনও দেড় কর্মদিবস, কখনও আধা কর্মদিবস, কখনও এর চেয়ে সামান্য বেশি সময় দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষককে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য চূড়ান্ত নোটিশের জবাব দেওয়ার জন্য মাত্র দেড় কার্যদিবস দেওয়ার ঘটনা পৃথিবীতেই বোধকরি প্রথম।

উপাচার্য তড়িঘড়ি করার কারণ

উল্লিখিত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনয়ন করা হয়েছে মূলত তাদের চাকরিচ্যুত করার জন্য। ফলে মধ্যবর্তী তদন্ত প্রক্রিয়া লোক দেখানো প্রহসন মাত্র। উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হবে এ মাসের ২৮ তারিখ। মেয়াদ পূরণের মাত্র ১০ দিন পূর্বে বিশেষ সিন্ডিকেট সভা আহ্বান করে অভিযুক্তদের স্থায়ী বরখাস্তের চূড়ান্ত চিঠি দেওয়া হয়েছিল। মেয়াদ পূরণের মাত্র ৫ দিন পূর্বে ২৩ জানুয়ারি আরেকটি সিন্ডিকেট সভা আহ্বান করা হয়। এ সভাতেই স্থায়ীভাবে তাদের বহিস্কার করা হয়েছে। অভিযুক্তরা মাত্র সাত দিন সময় চেয়েছিলেন। কর্তৃপক্ষ একদিনও সময় বাড়িয়ে দেয়নি। যাদের স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করা হবে তাদের সময় না দেওয়াও শুধু অমানবিক নয়, ন্যায়বিচারের পরিপন্থিও।


লঘু অভিযোগে গুরুদণ্ড!

যদিও এই অভিাযোগ সর্বৈব অসত্য এবং তদন্ত কমিটি ও তদন্ত প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ, তাতেও আনীত অভিযোগের শাস্তি চাকরিচ্যুতি হতে পারে না। উপাচার্য কি নিজেই বোঝেন না তার বিরুদ্ধে কতগুলো অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। উপাচার্য হয়তো আত্মপক্ষ সমর্থনে বলতে পারবেন তদন্তকারীরা যে প্রতিবেদন দিয়েছেন সেটি আমলে নেওয়া হয়েছে। তদন্ত কমিটির তদন্ত যথাযথ হয়েছে কিনা, সেটিও উপাচার্যের ভালোভাবে দেখতে হবে। এটি উপাচার্যের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। আর যে তদন্ত কমিটি অনিয়মতান্ত্রিকভাবে, স্বেচ্ছাচারী মনোভাব নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের শাস্তির বিধান জারি করার পথ রচনা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।

স্বাধীন প্রতিষ্ঠানে অবরুদ্ধতা

বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান-সৃজন এবং বিতরণের স্থান। সেখানে স্বাধীন মতপ্রকাশ যদি অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে তাহলে সে প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা হারায়। আমরা ব্রিটিশ উপনিবেশকালে কিংবা পাকিস্তানি শাসনামলে অবরুদ্ধ সময় পার করেছি। স্বাধীন বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে কণ্ঠরোধ করার সংস্কৃতিও বন্ধ হওয়া জরুরি। তিন শিক্ষক এবং দুই শিক্ষার্থীকে শাস্তি দেওয়া যদি বন্ধ করা না যায়, তাহলে ওই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতা স্থায়ী রূপে নষ্ট হতে পারে। যে তিনজন শিক্ষক তদন্ত কমিটিতে ছিলেন, সেই প্রশ্নবিদ্ধ তদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করা হোক। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের শাস্তি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হোক।

লেখক : সফিকুন্নবী সামাদী, সুলতান-উল-ইসলাম, আসাবুল হক, আবদুল্লা আল মামুন, জাহাঙ্গীর আলম সৌদ, এ আল মামুন, কাজী মামুন হায়দার, শহীদ ইকবাল, শিমুল মাহমুদ, মতিউর রহমান, রিষিণ পরিমল, তুহিন ওয়াদুদ, শফিক আশরাফ, নিত্য ঘোষ, রাহেল রাজিব, মাখন চন্দ্র রায়, এসএম আবু দায়েন

লেখকরা দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ - dainik shiksha বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি - dainik shiksha যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি - dainik shiksha তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ - dainik shiksha সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই - dainik shiksha শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী - dainik shiksha বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029878616333008