খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে তুঘলকি কাণ্ড!

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে তুঘলকি কাণ্ড! উপাচার্য মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামানের মেয়াদ শেষ হবে ৩০ জানুয়ারি। মেয়াদ পূরণের মাত্র ১২ দিন আগে তিনি সিন্ডিকেটের বিশেষ সভা আহ্বান করেন এবং সেখানেই বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষককে স্থায়ী বহিষ্কারের চূড়ান্ত চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বিধি মোতাবেক কারণ দর্শানোর জন্য ন্যূনতম সাত কর্মদিবস সময় দিতে হয়। উপাচার্যের চাকরির সময় কম থাকার কারণে দেড় কর্মদিবস সময় দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। একজন প্রতিষ্ঠানপ্রধান যখন তাঁর সহকর্মীদের চাকরিচ্যুত করার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠেন, তখন তাঁর নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। আয়নার সামনে দাঁড়ালে উপাচার্য নিজের কৃতকর্মই দেখতে পেতেন।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এক বছর আগে পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন। সেসব দাবি যৌক্তিক। বেতন-ফি কমানো, আবাসনসংকটের সমাধান, দ্বিতীয় পরীক্ষণের ব্যবস্থা সেসব দাবির অন্যতম। সেসব দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণাকে উসকানি আখ্যা দিয়ে তিনজন শিক্ষককে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের চূড়ান্ত নোটিশ দেওয়া হয়েছে। যে শিক্ষকদের চূড়ান্ত নোটিশ দিয়েছে, তাঁরা হলেন বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবুল ফজল, প্রভাষক শাকিলা আলম এবং ইতিহাস ও সভ্যতা বিভাগের প্রভাষক হৈমন্তী শুক্লা। তাঁরা ন্যায়ের পক্ষে প্রতিবাদী শিক্ষকের প্রতীক।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কয়েকজন জুনিয়র শিক্ষককে বরখাস্ত করার জন্য অনেক অপকৌশল নিয়েছেন। ঘটনার ১০ মাস পর ১৩ অক্টোবর দেওয়া হয়েছে কারণ ব্যাখ্যা প্রদানের প্রথম নোটিশ। সে সময় বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধশতাধিক শিক্ষক এই নোটিশের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছেন। ৯ নভেম্বর কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। অভিযুক্ত শিক্ষকগণ ওই চিঠির জবাব দেন ২৩ নভেম্বর। পরদিনই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত কমিটির একজন সদস্যের প্রতি আস্থা না থাকায় অভিযুক্ত শিক্ষকেরা তদন্ত কমিটি পুনরায় গঠনের জন্য অনুরোধ করেন। তদন্ত কমিটির একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ প্রবর্তনের বিরোধিতা করার খবর প্রকাশিত হয়েছিল। অভিযুক্ত শিক্ষকেরা সেই তথ্যসূত্র উল্লেখ করে কমিটি পুনর্গঠনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। ওই কমিটির কাছে ন্যায়বিচার না পাওয়ার অভিযোগ আমলে নেয়নি প্রশাসন, বরং বিশেষ সিন্ডিকেট সভার প্রতি কেন অনাস্থা এনেছে, এই মর্মে আরেকটি কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় কর্তৃপক্ষ। তদন্ত কমিটির কাছে তথ্য-উপাত্ত চেয়েও পাননি অভিযুক্ত শিক্ষকেরা। এমনকি তথ্য অধিকার আইনে তথ্য চাইলেও দেওয়া হয়নি।

গত ২৬ নভেম্বর বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবুল ফজল সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। ১২ দিন তিনি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। উপাচার্য একবারও তাঁকে দেখতে যাওয়া কিংবা ফোন করে খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। তাঁরা জানিয়েছেন, লিখিত জবাব দিতে চান। সেই মোতাবেক তাঁরা ১২ জানুয়ারি লিখিত জবাবও দেন। কিন্তু তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ১০ তারিখের পত্রে তাঁরা কীভাবে জবাব দেবেন, তা উল্লেখ না করায় ১২ তারিখে দেওয়া জবাব আমলে নেওয়া হয়নি—এমন অভিযোগ আছে।

উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগমুহূর্তে তড়িঘড়ি করে শাস্তির প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়া ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রতি তদন্ত কমিটির অসহযোগিতা ছিল, তদন্ত প্রক্রিয়া ছিল না যথাযথ।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, তথা প্রশাসনের এই আচরণ অমানবিক। কয়েক দিন আগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দুজন শিক্ষার্থীকে নানা মেয়াদে বহিষ্কারের আদেশ দিয়েছে। তাঁদের অপরাধ, তাঁরা আন্দোলন করেছিলেন। বহিষ্কারের আগে তাঁদের দুজনকে তদন্ত কমিটি আহ্বান করেছিল। শিক্ষার্থীরা জানতে চেয়েছিলেন, আন্দোলন করেছে অনেকেই, কিন্তু শুধু দুজন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার চেষ্টা কেন হবে। বহিষ্কারাদেশপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা শাস্তি প্রত্যাহারের দাবিতে অনশন করছেন। উপাচার্য তাঁর মেয়াদ পূরণের আগেই তাঁর অপছন্দের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের শাস্তির বিধান নিশ্চিত করতে চান বলে অভিযোগ আছে।

উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগমুহূর্তে তড়িঘড়ি করে শাস্তির প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়া ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রতি তদন্ত কমিটির অসহযোগিতা ছিল, তদন্ত প্রক্রিয়া ছিল না যথাযথ। অভিযোগে যে সরকারি আচরণবিধির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য হওয়ার কথা নয়।

শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের নৈতিক অভিভাবকত্বেই ক্যাম্পাসে থাকেন। সেই নৈতিক দায়িত্ব থেকেই আলোচ্য শিক্ষকত্রয় ছাত্রদের ন্যায়সংগত আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করেছিলেন। সেই আন্দোলন ছিল নিয়মতান্ত্রিক, সেই আন্দোলনে কোনো হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেনি। তারপরও প্রশাসন তাঁদের শাস্তি দিতে চাইছে। এই তুঘলকি কাণ্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ব্যক্তির খামখেয়ালির কারণে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীল অবস্থা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
আমরা শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষক ও দুই শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে নেওয়া দমনমূলক ব্যবস্থা প্রত্যাহারের আহ্বান জানাচ্ছি।

লেখক: তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক

সূত্র: প্রথম আলো


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে - dainik shiksha ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! - dainik shiksha ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! যৌন হয়রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি - dainik shiksha যৌন হয়রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল - dainik shiksha জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল অভিযুক্ত শিক্ষা সাংবাদিকদের পক্ষে জোর তদবির - dainik shiksha অভিযুক্ত শিক্ষা সাংবাদিকদের পক্ষে জোর তদবির কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে যৌ*ন হয়*রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি - dainik shiksha যৌ*ন হয়*রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি - dainik shiksha ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0033469200134277