খেয়াল রাখতে হবে শিক্ষার্থীরা এখনো ট্রমার মধ্যে

মাছুম বিল্লাহ |

গত ১৮ আগস্ট সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়েছে। এর পূর্বে গত ৬ আগস্ট থেকে খুলে দেয়ার ঘোষণা এসেছিলো আইএসপিআর থেকে। সেই ঘোষণা অনুযায়ী মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো মোটামুটি খোলা ছিলো, প্রাথমিক বিদ্যালয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সেভাবে খোলা হয়নি। সেই দিক থেকে বলা যায় যে, ১৮ আগস্টই সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার প্রথম দিন ছিলো। যদিও ৪০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ছিলো না তারপরেও খুলে দেয়া হয়েছে, দ্রুতই ভিসি-প্রোভিসি পদে নিয়োগ দেয়ার কথা জানিয়েছেন শিক্ষা উপদেষ্টা। বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিলেও ট্রমা কাটিয়ে পড়ার টেবিলে বসতে পারছেন না শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের দিনগুলোতে ঘটে যাওয়া বর্বরতা ও নৃশংসতার কথা বারবার তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠছে যা তাদের স্বাভাবিক জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করছে।

তাদের মনে পড়ছে রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারি সংগঠনগুলোর লোকজন কীভাবে তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে, নিজেদের চোখের সামনে বন্ধু-বান্ধবীদের মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখেছে, গুলি খেলে যন্ত্রণায় কাতরাতে দেখেছে এমনকি হাসপাতালে নেয়ার পথে রিকশা-গাড়ি থামিয়ে পুলিশ ও সরকারি লোকজন পুনরায় আক্রমণ করেছে। গুলিতে আহত হওয়ার পরও অনেককে হাসাপাতালে ভর্তি করা হয়নি। দ্বারে দ্বারে আহতদের নিয়ে সহপাঠীরা ঘুরেছেন। গুলি হচ্ছে, আক্রমণ হচ্ছে কিন্তু সহপাঠীকে ছেড়ে তারা যাননি। যারা হাসপাতালে ভর্তি তাদের মধ্যে দু-একজন করে এখনো প্রায় প্রতিদিন মারা যাচ্ছেন। যারা বেঁচে আছেন তাদের অনেকেই হাঁটতে পারবেন না, নিজ হাতে খেতে পারবেন না, চোখে দেখতে পারবেন না। প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে শিক্ষার্থীরা এই স্মৃতিগুলো যেমন মনে করছেন তেমনি ফাঁকা পড়ে আছে অনেক সহপাঠীদের সিট, আড্ডার জায়গা, খাবাবের ক্যানটিন। কেউ কেউ এসব মনে করে মুষড়ে পড়ছেন, কেউবা স্মৃতিচারণ করছেন, কেউ কেঁদেই ফেলছেন। এ অবস্থায় কবে তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবেন সেই চিন্তা যেমন তাদেরকে ঘিরে রেখেছে তেমনি তাদের অভিভাবক ও শিক্ষকেরাও এ নিয়ে শঙ্কার মধ্যে আছেন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, ১৫ জুলাই ছাত্রছাত্রীদের ওপর নৃশংসভাবে হামলা চালায় ছাত্রলীগ। মাথায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তার সাদা শার্ট রক্তে লাল হয়ে যায়। মাথায় তিন ইঞ্চির মতো ক্ষতের তৈরি হয়। মোট তিনটি কোপ লাগে মাথায়, সারা শরীরেও লাঠির আঘাত। এখনো আতঙ্কে আছি। এখনো ফোন করে দেখে নেয়ার হুমকি দেয়। বাবা-মা বলেন, পড়াশোনার দরকার নেই। বাড়িতে চলে আয়।’ ওই শিক্ষার্থীর মতো অনেকেই আতঙ্কে আছেন, তাদের মানসিক ক্ষত এতো বেশি, স্বাভাবিক কোনো কাজেই তারা মন দিতে পারছেন না। কবে পারবেন তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সিএসই বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, সরকারি বাহিনী ও সরকারদলীয় লোকদের হামলার ঘটনা যা দেখেছি সেটার একরকম প্রভাব রয়েছে আর নিজে সরাসরি যে হামলার শিকার হয়েছি তার প্রভাবটা তীব্র। গত ৪ আগস্ট বাড্ডা-নতুন বাজার থেকে রিকশা নিয়ে আন্দোলনে যাওয়ার সময় লিংক রোডে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ফোন চেক করেন। লাল প্রোফাইল দেখেই হঠাৎ এলোপাতাড়িভাবে তারা আমাদের দুজনের ওপর রড, লাঠি, পাইপ নিয়ে হামলা করে। বর্বরভাবে পেটানো হয়। আমার বন্ধুর একহাত ভেঙে পুরোপুরি আলাদা হয়ে যায়। চোখের সামনের এ্ই দৃশ্য মনের গভীর বিরাট ক্ষত সৃষ্টি করেছে। জানি না কবে এ থেকে মুক্তি পাবো। 

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা ঘটেছে ১৮ জুলাই। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষ চলার একপর্যায়ে এলাকা থেকে পুলিশ, র‌্যাব  ও বিজিবির সদস্যরা হাত উঁচু করে ক্যাম্পাস ছাড়ে। তারা শিক্ষার্থীদের কাছে এক ধরনের আত্মসমর্পনই করেছিলো। কিন্তু ওইদিন তাদের এই আচরণের পূর্বে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিলো পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। এক শিক্ষার্থী বলেন, তার হাতে-পায়ে-বুকে-পিঠে ১২টি রাবার বুলেট বিদ্ধ হয়েছিলো। তিনি বলছেন যে, তার শরীরের ভেতর রক্তপাত হচেছ এখনও। দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে পারছেন না। এভাবে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলের শিক্ষার্থীরা দেশের সর্বত্র এ ধরনের হামলার শিকার হয়েছেন, আহত হয়েছেন, মৃতুবরণ করেছেন। চোখের সামনে কাতরাতে কাতরাতে মৃত্যুবরণ করেছেন সহপাঠী, বড় ভাই-বোন, ছোট ভাই। এই দুঃসহ স্মৃতি তাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে সর্বক্ষণ। তারা বলছেন কবে এ থেকে মুক্তি পাবো জানি না বা আদৌ মুক্তি পাবো কি না। 

এতো গেলো যারা আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের কথা। যারা বাসায় বসে, বাসার বারান্দায়, টিভির পর্দায়, ফেসবুক-ইউটিউবে এ ধরনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন তারা কেউই কিন্তু ওই কটা দিন ঘুমোতে পারেননি, খেতে পারেননি। চারদিকে এতো গোলাগুলি, এতো হামলা ও আক্রমণ-এই বুঝি গায়ে গুলি লাগলো, এই বুঝি বারান্দায় গুলি লাগলো এই আতঙ্কে কেটেছিলো পুরো সপ্তাহ। এভাবে গোটা শিক্ষার্থী, শিক্ষকসমাজসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে এক মহাআতঙ্ক কাজ করেছে। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরপরই শুরু হলো ডাকাত আতঙ্ক, সেটিও কিন্তু ছোট শিুশু, স্কুল গোয়িং চিলড্রেনসহ সবাইকে কম ভোগায়নি। গোটা দেশ থেকে পুলিশ সদস্যরা উধাও, রাস্তাঘাটে তখনো হই-হুল্লোড়, গোলাগুলি, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, দেশীয় অস্ত্রের প্রদর্শনী চলছিলো। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিকের দিকে যাচ্ছে। কারণ, সময় হচ্ছে সবচেয়ে বড় হিলার, ব্যথা উপশমকারী। কিন্তু শিুশু ও বড়দের মনের গভীরে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে সেটি সারাতে বহু সময় লাগবে। কাজেই এই সময়ে শিক্ষার্থীরা যে কোনো ধরনের আচরণ করতে পারেন শ্রেণিকক্ষে, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। শিক্ষক ও অভিভাবকদের বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে, অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে সেগুলো মোকাবিলা করতে হবে। আগের মতো শাসন, শোষণ, ধমক দেয়া বা কোনো ধরনের  অভিভাবকত্ব্ ফলাতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে। 

এই সময়ে মনোবিজ্ঞানী ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বেশ কিছু পরামর্শ দিতে পারেন সব ধনের মিডিয়ায় যা শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকসহ সমাজের মানুষ বেশ উপকৃত হবেন। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সমাজের সচেতন মহল-সবাই এই ঘটনা থেকে মারাত্মক শিক্ষা নিতে পারেন। শিক্ষার্থীরা যে দলকেই সমর্থন করুন না কেনো কোনোভাবেই তাদের উচিত হবে না সহপাঠীদের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালানো। শিক্ষকদের উচিত হবে শিক্ষার্থীদের এ ধরনের ঘটনাবলী থেকে প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করতে উৎসাহিত করা। 

লেখক : ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ইউএনওর ‘মানসিক নির্যাতনে’ শিক্ষকের মৃত্যুর অভিযোগ - dainik shiksha ইউএনওর ‘মানসিক নির্যাতনে’ শিক্ষকের মৃত্যুর অভিযোগ শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতির সভা ১৮ সেপ্টেম্বর - dainik shiksha শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতির সভা ১৮ সেপ্টেম্বর সেই অভিযুক্ত রেবেকাই এবার মাউশি ঢাকার ডিডি! - dainik shiksha সেই অভিযুক্ত রেবেকাই এবার মাউশি ঢাকার ডিডি! নাহিদ-দীপুর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিই মাউশি অধিদপ্তরের ডিজি হচ্ছেন! - dainik shiksha নাহিদ-দীপুর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিই মাউশি অধিদপ্তরের ডিজি হচ্ছেন! শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে- জানতে চায় অধিদপ্তর - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে- জানতে চায় অধিদপ্তর এক ফ্যাসিস্টকে দেশ ছাড়া করেছি অন্যকে সুযোগ দেয়ার জন্য নয়: সারজিস - dainik shiksha এক ফ্যাসিস্টকে দেশ ছাড়া করেছি অন্যকে সুযোগ দেয়ার জন্য নয়: সারজিস কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.005709171295166