গণমাধ্যম শিল্পে সংকট, পুঁজিপতি ও সরকারের দায়বদ্ধতা

কুদরাত-ই-খোদা, সিনিয়র সাংবাদিক |

গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্র শিল্পে সংকট এবং গণতন্ত্রের সংকট দুটোই জাতির জন্য অশনি সংকেত। গণতন্ত্র হলো অপেক্ষাকৃত সর্বাধিক জনগণের মতের প্রতিফলন তথা ঐক্যবদ্ধতা। গণমাধ্যমের সংকট হলো কৃষক, শ্রমিক, জনতাসহ বোদ্ধা শ্রেণির মানুষের ভাব, মননশীলতা ও জনমনের প্রতিফলনের গতিরোধ করা। বর্তমান রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, গণমাধ্যম অনেকটা মরণ ব্যাধিতে আক্রান্ত। সংকট উত্তরণের পথও কিছুটা রুদ্ধ।

সম্প্রতি ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের অপব্যবহারসহ, কতিপয় সাংবাদিক নেতৃত্বের দলদাসে পরিণত হওয়া, গণমাধ্যমের সংকটকে নতুন করে গহীন গহ্বরে নিয়ে যাচ্ছে। কয়েকটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলসহ বেশ কয়েকটি সংবাদপত্র কতিপয় সেলিব্রেটি সাংবাদিকদের সুউচ্চ বেতন-ভাতা দেয়। তবে সংবাদপত্র শিল্পের সর্বাধিক সংখ্যক গণমাধ্যমকর্মী ও সংবাদপত্র কর্মচারীরা করোনাকাল থেকে এখন পর্যন্ত দুর্বিসহ জীবনযাপন করছেন। বেতন-ভাতা না দেওয়া নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপরদিকে, ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতার বাইরের দলগুলোর মধ্যে হিংসা, বিভেদ, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার প্রয়াস–এসব নীতি একটি স্থিতিশীল গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। 

গণমাধ্যমের প্রতি দর্শক, শ্রোতা, পাঠক এবং তৃণমূল জনগণ যদি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন, তাহলে এটা হবে গভীরতম দুঃখজনক ঘটনা। কারণ, গণমাধ্যমের প্রতি জনগণের আস্থা হারিয়ে গেলে গণতন্ত্র গভীর সংকটে পড়বে। এতে করে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সব ধরনের সুযোগ ভূলুণ্ঠিত হবে। ইদানীং লক্ষ্য করা যাচ্ছে বেশ কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশন ফেব্রিকেটেড এবং অসত্য সংবাদ প্রকাশ করছে। যা জনমতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। গণমাধ্যমের গত আশি বছরের ইতিহাসে এমন সংকট, দুর্ভাবনা ও গভীর উদ্বেগ আর তৈরি হয়নি। দৃশ্যত বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম তাদের বিশ্বস্ততা, সততা ও ন্যায়-নিষ্ঠা হারিয়ে ফেলেছে। এর মূল কারণ হলো দেশের অন্যতম প্রধান প্রধান গণমাধ্যমগুলো নব্য পুঁজিপতিদের করপোরেট হাউসে পরিণত হয়েছে। পুঁজিপতি মালিকদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য দিতে যেয়ে সংবাদপত্র শিল্প তার নৈতিকতা হারিয়ে ফেলছে। এতে করে স্বাধীন সম্পাদক বলতে আর কিছু থাকছে না। অনেক ক্ষেত্রে পুঁজির মালিক নিজেই সম্পাদক । আবার কিছু ক্ষেত্রে পুঁজির মালিক ও মালিকপক্ষ তার অধীনস্ত অপেশাদার লোককেই সম্পাদক নিয়োগ করছে। এটাই সংবাদপত্র শিল্পে অধঃপতনের অন্যতম কারণ। একাধিক জরিপে দেখা গেছে, কয়েকটি জাতীয় দৈনিক, কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশন ও অনলাইন নিউজপোর্টাল ছাড়া অধিকাংশ গণমাধ্যমই সময় মতো বেতনভাতা দিচ্ছে না। সাংবাদিকরা বছরের পর বছর বেতন পাচ্ছেন না। এতে করে অনেকেই বেকার হয়ে যাচ্ছেন এবং দুর্বিসহ জীবনযাপন করছেন। এটা গণমাধ্যমের জন্য অশনি সংকেত । 

এখন পাঠক বা দর্শকের জানার অধিকার বা রাইট টু ইনফরমেশন একটা স্বীকৃতি। সংবাদ প্রকাশের স্বাধীনতা যেমন অপরিহার্য তেমনি সংবাদ বর্জন করা বা বিকৃতি করার স্বাধীনতা গণমাধ্যমকে দেওয়া হয়নি।তবে একথা ঠিক যে, গণমাধ্যমের গণকাঠামো এখন আর আগের মতো নেই। তার কারণ, সংবাদপত্র এখন বৃহৎ পুঁজি নির্ভর একটি শিল্প। যদিও এই শিল্পের প্রধান নির্বাহী হলেন সম্পাদক, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো যে, পুঁজিপতিরা তা মানতে রাজি নয়। রাষ্ট্র বা সরকার চালকদেরও মনে রাখতে হবে গণমাধ্যমের অধিকার খর্ব হলে, ধরে নিতে হবে যে, গণতন্ত্রের বিপদ আসন্ন। ইতিহাস বারবার এই কথাই বলছে। সাংবাদিক কিংবা রিপোর্টারদেরও একটা কথা মনে রাখতে হবে, জনপ্রিয় কিংবা সেলিব্রেটি সাংবাদিক বলে কোনো কথা নেই । কারণ, দৃশ্যত সত্যিকার অর্থে সাংবাদিকদের কোনো বন্ধু থাকার কথা নয়। যিনি সত্যের ধারক, সত্যের প্রতি আনুগত্য এবং নিজের মর্যাদাবোধই একজন রিপোর্টারকে অসৎ হতে দেয় না। এটাও মনে রাখতে হবে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা না থাকলে নাগরিকদের স্বাধীনতা বিপন্ন ও বিষাদময় হয়ে যায়। 

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025680065155029