গবেষণা সংকটে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

মৌলিক গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম কাজ হলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ খাতে ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছে। এমনকি এক-চতুর্থাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো গবেষণাই হচ্ছে না। যেটুকু হচ্ছে তা মানসম্মত না হওয়ায় এর ৯০ ভাগের বেশি ছাপার সুযোগ পাচ্ছে না আন্তর্জাতিক জার্নালে। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বরাবরই বরাদ্দ কম থাকার অভিযোগ করলেও যেটুকু বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে সেটাও খরচ করতে পারছে না অনেক বিশ্ববিদ্যালয়।

মৌলিক গবেষণা ও আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশনা কমে যাওয়ায় প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে দেশের উচ্চশিক্ষা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গবেষণা প্রকল্প প্রদানে স্বজনপ্রীতি, ভালো ল্যাব না থাকা, গবেষণায় বরাদ্দে অপ্রতুলতা, ভালো গবেষণার স্বীকৃতি না পাওয়া, পদোন্নতিতে গবেষণার চেয়ে রাজনৈতিক মতাদর্শকে প্রাধান্য দেওয়ায় মেধাবী শিক্ষকরা গবেষণাবিমুখ হচ্ছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন শুধু ডিগ্রি প্রদান প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা আরও করুণ। বুধবার (১৯ ‍জুন) বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন শামীম আহমেদ ও জয়শ্রী ভাদুড়ী।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অর্ধেকের বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো গবেষণাই হচ্ছে না। বাকিগুলো নামমাত্র বরাদ্দ রেখে দায় সারছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্যমতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য অনুন্নয়ন বরাদ্দ দেওয়া হয় ৪ হাজার ১৫১ কোটি টাকা। ৩৭টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা বাবদ বরাদ্দ রাখা হয় ৬১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা (১.৪৮%)। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪৫ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুন্নয়ন বাজেট অনুমোদন করা হয় ৪ হাজার ৮৩৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। ৩৪টি বিশ্ববিদ্যালয়কে ৬২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা গবেষণা বরাদ্দ দেওয়া হয় যা অনুন্নয়ন বাজেটের ১.২৯ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৫ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বাজেট অনুমোদন করা হয় ৮ হাজার ৮৮ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে অনুন্নয়ন বাজেট ৫ হাজার ৮৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। ৩৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য গবেষণা বরাদ্দ দেওয়া হয় ৬৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা যা অনুন্নয়ন বাজেটের ১.২৬ শতাংশ। প্রতি বছরই কমেছে গবেষণায় বরাদ্দের হার।

এই বরাদ্দও খরচ করতে পারছে না অনেক বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে গবেষণা খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১৪ কোটি টাকা। বছর শেষে দেখা যায়, খাতটিতে ব্যয় হয়েছে ৮ কোটি ৪২ টাকা। বরাদ্দের ৪০ শতাংশই ব্যয় করতে পারেনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পরের বছর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বরাদ্দ কমিয়ে ৯ কোটি করা হয়। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য গবেষণা বরাদ্দ ছিল এক কোটি টাকা। টাকাটা অব্যয়িত থেকে যায়। প্রতিটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রই এক। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, গবেষণা করতে না পারলে স্কুল আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ তিনটি।

গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান উৎপাদন, বিভিন্ন প্রকাশনার মাধ্যমে সেই জ্ঞান সংরক্ষণ ও পাঠদানের মাধ্যমে জ্ঞান বিতরণ। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শুধু পুরনো জ্ঞান বিতরণ হচ্ছে, নতুন জ্ঞানের আবিষ্কার হচ্ছে না। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য যে বরাদ্দ দেওয়া হয় তার বেশিরভাগই খরচ হয় বেতন-ভাতা ও অবকাঠামো নির্মাণে। গবেষণায় বরাদ্দ নামমাত্র। পর্যাপ্ত সরঞ্জামসহ গবেষণা ল্যাব নেই। ভালো গবেষণার জন্য পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা নেই। পদোন্নতি বা নিয়োগের ক্ষেত্রে গবেষণা মূল্যায়ন করা হয় না। রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেকে পদোন্নতি পাচ্ছেন। এ কারণে মেধাবীদের কেউ কেউ অর্থের জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্টটাইম শিক্ষকতায় যুক্ত হচ্ছেন, কেউ পদোন্নতি ও সুযোগ-সুবিধার জন্য রাজনীতিতে সময় দিচ্ছেন। ফলে মেধাবী গবেষক পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, কম বরাদ্দের মধ্যেও কিছু বিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণ অর্থ খরচ করতে পারছে না। এটা দুঃখজনক।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের ওপর বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। কেউ পাচ্ছে, কেউ পাচ্ছে না। আবার যারা গবেষণা করছেন, সঠিক মান বজায় না রাখায় আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ করতে পারছেন না। যেহেতু কোনোরকমে গবেষণা একটা করে অনলাইনে বা ফ্যাকাল্টি জার্নালে প্রকাশ হলেই পদোন্নতি হচ্ছে, তাই মৌলিক গবেষণা ও আন্তর্জাতিক জার্নালে তা প্রকাশের চেষ্টাও করা হচ্ছে না। এসব কারণে গবেষণার সংস্কৃতিই গড়ে উঠছে না।

ইউজিসির ২০১৬ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে সরকারি ও বেসরকারি ১৩১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৪১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। এর মধ্যে সরকারি ১০টি আর বেসরকারি ৩১টি। ২০১৭ সালের (সর্বশেষ) বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ওই বছর সরকারি- বেসরকারি ১৩৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম ছিল ১২৭টিতে। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮টিতে এবং ৯০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭টিতে কোনো গবেষণা প্রকল্পই ছিল না। পিএইচডি ও এমফিল ফেলোশিপ গ্রহণেও দেখা গেছে অনাগ্রহ। ইউজিসির ১০০টি পিএইচডি ফেলোশিপ থাকলেও ২০১৭ সালে মাত্র ৫৮ জন শিক্ষক তা গ্রহণ করেন। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ২৫ জন ও কলেজ শিক্ষক ৩৩ জন। সমাপ্ত করেন ৩৪ জন। ৫০টি এমফিল ফেলোশিপ থাকলেও গ্রহণ করেন ৬ জন। সবাই কলেজ শিক্ষক। সমাপ্ত করেন ৫ জন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী, ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে এমফিলে ১১৬ ও পিএইচডি প্রোগ্রামে ৫১ জন গবেষক ভর্তি হন। ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে এমফিলে ভর্তিকৃত গবেষকের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৪৯ ও পিএইচডিতে ২২। এক বছরের ব্যবধানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে গবেষণায় অংশগ্রহণের হার কমেছে ৫৮ শতাংশ।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির সদ্য-সাবেক ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো ড. রাহমান নাসির উদ্দিন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় যে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানও সেটা আমরা শিক্ষা-দর্শনে কখনোই বিবেচনায় নেই না। বিশ্বের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে, সেখানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা খাতে সরকারি বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল। বেসরকারিভাবে গবেষণার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রণোদনা নেই। অথচ, বিশ্বের অনেক দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বাজেটের বড় অংশ আসে বেসরকারি খাত থেকে। ফলে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মৌলিক গবেষণা তেমন একটা হচ্ছে না।

বাংলাদেশের প্রধান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণায় কিছু বরাদ্দ রাখে যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক তাই গবেষণার চেয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে অধিক অর্থ উপার্জনে আগ্রহী। আবার গবেষণা বরাদ্দ অনেক ক্ষেত্রে গবেষণা প্রকল্পের গুণগত মানের চেয়ে রাজনৈতিক পরিচয় এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতে দেওয়া হয়। ফলে, অনেক মেধাবী শিক্ষক হয়তো গবেষণা করতে চেয়েও প্রকল্প পাচ্ছেন না। এভাবে সরকারি বরাদ্দের অপ্রতুলতা, বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, বরাদ্দ অর্থের যথাযথ বণ্টন-মনিটরিং-মূল্যায়নের অভাব এবং সর্বোপরি শিক্ষকদেরও গবেষণায় ক্রমবর্ধমান অনাগ্রহের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যতটা এবং যে মানের গবেষণা হওয়া উচিত সেটা হচ্ছে না। ফলে, উচ্চশিক্ষার মানও ক্রমান্বয়ে নিম্নমুখী। কিন্তু, জ্ঞান উৎপাদন না করে জ্ঞান বিতরণের চিন্তা বাস্তবসম্মত নয়।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার চাকরির বয়স নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর চিঠির পর সমাবেশের ডাক দিলো ৩৫ প্রত্যাশীরা - dainik shiksha চাকরির বয়স নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর চিঠির পর সমাবেশের ডাক দিলো ৩৫ প্রত্যাশীরা স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি কি এপ্রিলে এগিয়ে আনা দরকার? - dainik shiksha স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি কি এপ্রিলে এগিয়ে আনা দরকার? কলেজের শিক্ষকদের ডিজিটাল বদলির আবেদন শুরু রোববার - dainik shiksha কলেজের শিক্ষকদের ডিজিটাল বদলির আবেদন শুরু রোববার বুটেক্সের প্রথম সমাবর্তন ৭ সেপ্টেম্বর - dainik shiksha বুটেক্সের প্রথম সমাবর্তন ৭ সেপ্টেম্বর শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি: শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি: শিক্ষা মন্ত্রণালয় দুর্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটিতে বিশেষ কমিটি গঠনে নীতিমালা হবে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha দুর্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটিতে বিশেষ কমিটি গঠনে নীতিমালা হবে: শিক্ষামন্ত্রী দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029070377349854