গাছ থাকতে গাছের উপকারিতা

মাসুদ আনোয়ার |

একটা ডুমুর গাছ। বয়স ১০০ বছর। রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকায় বিরাট জায়গা জুড়ে ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে আছে। গাছের গোড়ায় শহরের শিশুরা খেলাধূলা করে, তরুণেরা আড্ডা জমায় আর বুড়োরাও মাঝে মধ্যে এসে সমবয়সীদের নিয়ে পুরনো দিনের গল্প আর স্মৃতিচারণে মেতে ওঠে। গাছটার গোড়ায় মোটা মোটা শেকড়। দিব্যি আসন বানিয়ে বসা যায়। উঠতি বয়সী কবি হলে আকাশের দিকে তাকিয়ে দু’এক লাইন কবিতার মকশও করা যায়। মোট কথা, শহরের ওই এলাকার মানুষদের দৈনন্দিনতার সঙ্গে মিশে আছে প্রাচীন ডুমুর গাছটি।

গাছটির নিবাস আফ্রিকা মহাদেশের কেনিয়ায়। রাজধানী নাইরোবির পশ্চিমাংশে ওয়াইকা ওয়ে এলাকায় তার সমূল সুবিস্তার। গাছটির শৈশবাবস্থায়, একশ বছরেরও বেশি সময় আগে এশিয়ার এক বিজ্ঞানী বলেছিলেন, গাছের প্রাণ আছে। শুধু মুখেই বলেননি, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা দিয়ে তার প্রমাণও দিয়েছেন। তার উদ্ভাবিত ক্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্রের সাহায্যে প্রমাণ করেছিলেন উদ্ভিদের প্রাণের অস্তিত্ব।

১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে এশিয়ার ওই বিজ্ঞানী বলেন, উদ্ভিদও প্রাণীর মতো বাহ্যিক প্রভাবকের প্রভাবে সাড়া দিতে সক্ষম। তাদের ভেতর কিছু সাদৃশ্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। তারা ব্যথা, আনন্দ, এমনকী ভালবাসাও অনুভব করতে পারে। উদ্ভিদের একটি সঠিক জীবন চক্র এবং প্রজননতন্ত্র আছে, যা প্রাণীরই অনুরূপ। গাছের প্রাণ আছে, এই তত্ত্বের প্রবক্তা ওই বিজ্ঞানীর নাম জগদীশ চন্দ্র বসু তার এই গবেষণাপত্র তখন লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটিতে স্থান করে নিয়েছিল। আর এখন এই ঘোরতর উষ্ণায়নের কালে আমরা জেনেছি উদ্ভিদের সঙ্গে রয়েছে প্রাণীর প্রাণের বন্ধন। গাছ মরে গেলে আমরাও মরে যাই। হুমায়ূন আহমদ তার অনেক উপন্যাসে গাছের কথা টেনেছেন। গাছের মধ্যে প্রাজ্ঞতা আরোপ করেছেন। নুহাশ পল্লীতে সমাবেশ ঘটিয়েছেন হরেক রকম বৃক্ষের। ‘বৃক্ষকথা’ নামে তার একটা বইও রয়েছে।

নাইরোবির শতবর্ষী ওই ডুমুর গাছটি একশ বছর ধরে মানুষের প্রাণের সঙ্গী হয়ে থাকলেও এই মানুষের হাতেই তার প্রাণ সংশয় হয়েছিল কিছুদিন আগে। চীনা সহায়তায় কেনিয়ায় নগরোন্নয়নের কাজ চলছিল। তার ফলে জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছিল ডুমুর গাছটির। মহাসড়ক বানাতে গিয়ে গাছটি কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যান সেখানকার পরিবেশকর্মীরা। তারা গাছটি কাটতে দেবেন না।

এই নিয়ে বিরোধ শুরু হতেই দেশটির প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তা পরিস্থিতিনিয়ন্ত্রণে এগিয়ে এলেন। একটি আদেশ জারির মাধ্যমে গাছটিকে না কেটে রক্ষা করার পদক্ষেপ নিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত সড়ক উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ তাদের মহাসড়ক নির্মাণের নির্দিষ্ট ছক থেকে সরে গিয়ে গাছটিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানালেন জনগণ। চারতলা ভবন সমান উঁচু এই গাছটিকে কেনিয়ানরা তাদের সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত ঐতিহ্য বলে মনে করে। প্রেসিডেন্ট কেনিয়াত্তার নির্বাহী আদেশেও উল্লেখ করা হয়েছে সে কথা। প্রেসিডেন্টের ডিক্রি জারি হওয়ার পর এলিজাবেথ ওয়াথুতি নামের একজন পরিবেশকর্মী টুইটারে লিখেছেন, আমরা এটা করেছি। আমরা সবুজ এবং পরিষ্কার পরিবেশ চাই। পরিচ্ছন্ন কেনিয়া চাই। আমরা সবুজ পরিবেশ রক্ষার জন্য সব কিছুই
করব।

শুধু কেনিয়া নয়, পৃথিবীর প্রায় সব দেশের মানুষই এখন অনুভব করছেন গাছের প্রয়োজনীয়তা। আমাদের দেশেও সরকারি স্লোগান রয়েছে, একটি গাছ কাটলে তিনটি গাছ লাগান। এটা খুব ভাল স্লোগান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা কেবল স্লোগানই্। আমাদের দেশে এখনো মাঝে মাঝে সরকারি উদ্যোগেও গাছ কেটে ফেলার খবর শুনতে পাই। ভাব দেখে মনে হয়, গাছ কেবল কাটার জন্যেই। গাছকে সুরক্ষা না দিলে তারাও যে মানুষের মতো অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়ে যায়, সেটা কেউ চিন্তা করি না।

গাছ নিয়ে একটু ভাবা যাক। আমরা কেন গাছ রক্ষা করব? গাছ রক্ষা করব নিজেদের জন্যে। গাছ আমাদের অক্সিজেন জোগায়, এটা সাধারণভাবে সবাই জানি। কিন্তু যেটা খুব বেশি লোক জানে না, সেটা হলো একটি পূর্ণবয়স্ক গাছ এক বছরে যে অক্সিজেন সরবরাহ করে, সে অক্সিজেন ১০ জন পূর্ণবয়স্ক মানুষের এক বছরের প্রয়োজন মেটায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর টি এম দাস ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে একটি গাছের অবদানকে অর্থমূল্যে পরিবর্তন করে দেখান, ৫০ বছর বয়সী একটি গাছের অর্থনৈতিক মূল্য এক লাখ ৮৮ হাজার ডলার। এই গাছ থেকে বছরে ২১ লাখ টাকার অক্সিজেন পায় মানুষ। বছরে প্রাণীসম্পদের জন্য প্রোটিন জোগায় এক লাখ ৪০ হাজার টাকার, মাটির ক্ষয়রোধ ও উর্বরতা বাড়ায় ২১ লাখ টাকার, পানি পরিশোধন ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করে ২১ লাখ টাকার এবং বায়ুদূষণ রোধ করে প্রায় ৪২ লাখ টাকার।

কেনিয়ায় একটি মাত্র ডুমুর গাছ রক্ষায় স্বয়ং প্রেসিডেন্টকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। সেখানকার পরিবেশকর্মীরা রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন বা জনগণের উন্নয়ন কাজের খাতিরে একটি মাত্র গাছকাটার সিদ্ধান্তের সর্বাত্মক বিরোধিতায় নেমে ছিলেন। চীনের সহায়তায় চলা উন্নয়ন কর্মযজ্ঞের প্রত্যক্ষ ফলভোগী হবে জেনেও একটি মাত্র গাছ কাটতে দেননি তারা। সরকারকে রাস্তা তৈরিতে শেষ পর্যন্ত বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতেই হয়েছিল।

আমাদের দেশে অবশ্য গাছ বাঁচাতে জনগণ রাস্তায় নেমেছিলেন, এমন নজির নেই। বরং রাজনীতি করতে গিয়ে হাজার হাজার গাছপালা ধ্বংসের ভয়াবহ স্মৃতি রয়েছে সাধারণ মানুষের মনে।

২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে হেফাজতের ধর্মের নামে রাজনৈতিক সহিংসতা চলার সময় গাছের ওপর এমন নিষ্ঠুরতা মানুষের মনে জেগে থাকবে অনেক কাল। আর গাছগুলোকে ধ্বংস করেছিল তারাই, যারা সবচেয়ে বেশি জানেন যে, বৃক্ষও সেজদানত থাকে সব সময় আল্লাহর দিকে। হেফাজতি হুজুররা তা জেনেও ধর্মের আড়ালে রাজনৈতিক খেলায় মেতে ‘সেজদারত’ গাছগুলোর সমূলে বিনাশ ঘটিয়েছিল।

গাছকাটা বা বৃক্ষনিধন নিয়ে আমাদের দেশে অনেক কথাবার্তা হয়। কিন্তু কাজ তেমন কিছু হয় না। ঢাকা শহরে উন্নয়নের নামে অহরহ গাছকাটা চলে, কিন্তু গাছ লাগানো হচ্ছে, এমনটা দেখা যায় না। মেট্রো রেল বানিয়ে নাগরিক সুবিধা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে সড়ক বিভাজিকায় রোপন করা গাছ কেটে পরিষ্কার করে ফেলা হয়েছে। কিন্তু শহরের কোথাও কি চলছে গাছ রোপনের উদ্যোগ? আসলে আমাদের দেশে প্রচুর গাছ তো, তাই দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা না বোঝার মতো গাছ থাকতে গাছের উপকারিতা বুঝতে পারছি না আমরা। হতো সৌদি আরবের মতো মরুভূমির দেশ, তাহলে হয়তো বুঝতাম।

সৌদিরা সেটা বুঝেছে হয়তো। শুধু তেল বেচে যে বেশিদিন ভাত জুটবে না নিয়ত পরিবর্তনশীল বিশ্বপরিস্থিতিতে, তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। তাই বিকল্প সম্পদ বাড়ানোর তোড় জোড় শুরু করেছে। তাছাড়া বিশ্ব উষ্ণায়নের যুগে অক্সিজেনের সরবরাহ না বাড়লে যে দমবন্ধ হয়ে মারা যেতে হবে, সেটাও রয়েছে তাদের মাথায়। তাই দেশটিতে গাছ কাটার বিরুদ্ধে কঠোর সাজার কথা ঘোষণা করা হয়েছে।

সৌদি আরবের পাবলিক প্রসিকিউশনের এক টুইটে বলা হয়, গাছ, গুল্ম বা গাছের ছালবাকল তুলে ফেলা বা পাতা ছেঁড়া, চারাগাছ মাটি থেকে উপড়ে ফেলা এবং গাছের গোড়া থেকে মাটি সরিয়ে নেয়াসহ এধরনের কাজকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে। অপরাধীকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং ৩ কোটি রিয়াল জরিমানা করা হবে। দ্য আরব নিউজে এ বিষয়ে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা সৌদি আরবের ভিশন-২০৩০ বাস্তবায়নের একটি পদক্ষেপ। দেশটি আগামী এক দশকের মধ্যে পরিবেশের ভারসাম্যে একটা স্থিতাবস্থা আনতে চায়।

২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারে গতি আনার লক্ষ্যে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান তেলের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে অন্য সম্পদ বাড়ানোর কথা সামনে রেখে এই উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার নেয়ার কথা বলেছিলেন।

পরিবেশমন্ত্রী আবদুলরহমান আল ফাজলি বলেন, আমরা দেশে সবুজ বিপ্লব ঘটাতে চাই। তাই চলুন, গাছ লাগাই। তিনি তিনি এক বছর সময়কালের মধ্যে সারা দেশে এক কোটি গাছ লাগানোর পরিকল্পনার কথাও ঘোষণা করেন। টুইট করে জানিয়েছেন, আমরা বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বাড়াব। পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্রকল্প স্থাপন করব। সকল ধরনের দূষণ এবং মরুভূমির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যথাসম্ভব লড়াই করে পরিবেশ রক্ষার চেষ্টা চালাব।

গাছ কাটলে শাস্তির বিধান যে আমাদের দেশেও নেই, তা নয়। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে এই বিষয়ক একটি বিল সংসদে পাঠানো হয়েছিল। বিলটিতে প্রস্তাব করা হয়েছিল, সরকারের অনুমতি ছাড়া বন, সড়কের পাশের ও পাবলিক প্লেসের গাছ কাটলে সর্বোচ্চ তিন মাসের কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। তবে সেটার ফল কী হয়েছে, তা কখনোই স্পষ্ট হয়নি। অন্তত এখনো যে হারে গাছকাটা চলে, মনে হয় না তাতে কোনো কাজ হয়েছে। ওই বিলটিতে নানা শর্ত টর্তও ছিল। ওসব শর্তের ফাঁক ফোকরে গাছকাটার অনেক সুযোগও রয়েছে।

এভাবে আইন করে গাছকাটা বন্ধ করা খুব সহজ ব্যাপার নয়। গাছের প্রতি মানুষের মমতা সৃষ্টির কাজটা করতে হবে সবার আগে। দুই একটা কর্মসূচি পালন করে সে মমতা তৈরি করা সম্ভব নয়। এ জন্য চাই নিবিড় সামাজিক আন্দোলন, মানুষের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও তা নিশ্চিত করা এবং তার সঙ্গে প্রশাসনিক নজরদারি তো চাই-ই।


লেখক : মাসুদ আনোয়ার, সাংবাদিক ও লেখক ।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান - dainik shiksha সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা - dainik shiksha লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক কেনো বদলি চান - dainik shiksha শিক্ষক কেনো বদলি চান ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে - dainik shiksha ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0096509456634521