গত নয় মাসে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নীতির প্রতিবাদে এক ডজন কর্মকর্তা পদত্যাগ করেছেন। বিষয়টি এখানে শেষ হলেই স্বস্তি পেতেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনকে বাইডেন প্রশাসন যেভাবে সমর্থন দিচ্ছে তাতে প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ সাধারণ আমেরিকানদের মধ্যেও বাড়ছে ক্ষোভ।
এই বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা তাদের খোলা চিঠিতে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ইসরায়েল গাজায় যে গণহত্যা চালাচ্ছে এবং শিশুদের অনাহারে রাখছে তার জন্য ওয়াশিংটন অব্যাহত সমর্থন জোগাচ্ছে। বাইরের প্রশাসনের নীতির প্রতিবাদে পদত্যাগ করা এসব কর্মকর্তারা বলছেন, হোয়াইট হাউজের ব্যর্থ নীতি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তাকেও হুমকির মুখে ফেলছে।
বাইডেন প্রসাশন ইসরায়েলকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানালেও ইসরায়েল তা আমলে নিচ্ছে না। ইসরায়েল আমেরিকার সমর্থন নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে এমনটি ধারণা করা হলেও কার্যত মার্কিন প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ফলে মার্কিন সরকারের প্রতি বিভিন্ন দেশের নতজানু পররাষ্ট্র নীতি বদলে যাচ্ছে। অনেক দেশকে দেখা যাচ্ছে মার্কিন প্রশাসনকে নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে।
বাইডেন প্রশাসন যে নীতি অনুসরণ করছে ইসরায়েল ফিলিস্তিন যুদ্ধে তাতে সেদিন হয়তো বেশি দূরে নয় বিশ্ব মোড়লের মর্যাদা কিছুটা হলেও ক্ষুণ্ন হবে যুক্তরাষ্ট্রের। চীন রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ জোর চেষ্টা চালাচ্ছে ডলারের বিকল্প মুদ্রা প্রচলনের। ইউরোপ তাদের অভিন্ন মুদ্রা ইউরোপ চালু করেও ডলারের আধিপত্যে আঘাত হানতে পারেনি। ইউক্রেন রাশিয়া এবং ইসরায়েল ফিলিস্তিনি যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা কমে আসলে বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠনগুলো শক্তি সঞ্চার করবে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী গত সাতই অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি হামলায় ৩৭ হাজার ৯৫৩ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে আর আহত হয়েছে ৮৭ হাজার ২৬৬ জন। কিন্তু নয় মাসের বেশি সময় ধরে চলা এই যুদ্ধ বন্ধের এখনো কোনো আভাস নেই। এই যুদ্ধে স্পষ্টত সামরিক এবং কূটনৈতিক সমর্থন জোগাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েলের পাশে থেকে ফিলিস্তিনে গণহত্যার মতো অপরাধে বাইডেন প্রশাসনের জড়িয়ে যাওয়াকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যতের জন্য হুমকি হিসেবে দেখছেন দেশটির বোদ্ধামহল। সাবেক কর্মকর্তারা বলছেন, এটি কেবল নৈতিকভাবে নিন্দনীয় এবং আন্তর্জাতিক মানবিক আইন ও মার্কিন আইনের সুস্পষ্ট লঙ্গনই নয়, এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সারা পৃথিবীর মানুষের ক্ষোভেরও সঞ্চার করছে।
মার্কিন প্রশাসনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সরকারি মারিয়াম হাসনাইন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা ইউএসএআইডি ও সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি আরো চারজন রাজনৈতিক কর্মীর বাইডেন প্রশাসন থেকে পদত্যাগ করার বিষয়টি অনুধাবন করতে না পারলে নভেম্বরের নির্বাচনে হয়তো চরম মূল্য দিতে হবে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে।
এদিকে, এক দফায় টিভি বিতর্কে হেরে যাওয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট এখন রয়েছেন দোটানায়। সাধারণ মার্কিনিরা যেমন তার অস্পষ্ট নীতিকে সমর্থন করে না তেমনি ইসরায়েলি মার্কিন ভোটাররাও ক্ষুব্ধ তার ওপর। কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তা ইসরায়েলের জন্য অব্যাহত রাখলেও আন্তর্জাতিক নানান চাপের ফলে প্রশাসন নেতানিয়াহুকে গাজায় হামলা বন্ধ রাখার আহ্বান জানিয়েছে আসছে। একদিকে কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তা অব্যাহত রাখা অন্যদিকে হামলা বন্ধ রাখার আহ্বানকে বিশ্লেষকরা বাইডেন প্রশাসনের দ্বিমুখী আচরণ বলছেন। ফলে নভেম্বরের নির্বাচনকে সামনে রেখে জো বাইডেনের কোনো কুলই রক্ষা হচ্ছে না বলে মনে হচ্ছে।
গাজর আল শিফা হাসপাতালের পরিচালক আবু সালমিয়া ইসরায়েলি বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে দিয়েছেন বিস্ফোরক তথ্য। বন্দিদশায় ইসরায়েলি সৈন্যরা খাবার এবং ওষুধ সরবরাহ করতো না, যা স্পষ্ট তো মানবাধিকারের লঙ্ঘন। দিনে একটু একটু রুটি ছাড়া ইসরায়েলিদের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনি বন্দিদের কিছুই দেয়া হতো। যদিও আবু সালমিয়ার মতো বন্দিরা বেসামরিক নাগরিক।
সম্প্রতি ফিলিস্তিনি তরুণকে সেনাবাহিনীর চলন্ত জিপের সামনে বেঁধে নেয়ার দৃশ্য নাড়া দিয়েছে বিশ্ব বিবেককে। খোদ ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এই ঘটনায় প্রটোকল ভাঙার কথা শিকার করলেও মার্কিন প্রশাসনের ইসরায়েল বাহিনীর প্রতি সমর্থন প্রত্যাহারের কোনো উদ্যোগ সামনে আসেনি।
গাজা থেকে ১৮ মাইল দূরে ইসরায়েলের আসদদ বন্দরে নোঙর একটি জাহাজ নিয়ে নতুন বিতর্ক এখন ইসরায়েল ফিলিস্তিন যুদ্ধের ময়দানে। দাবি করা হচ্ছে ভারত থেকে জাহাজটিতে ২০ টন রকেটের ইঞ্জিন, বিস্ফোরকসহ সাড়ে বারো টন রকেট, ৩ হাজার ৩০০ পাউন্ড বিস্ফোরক ১ হাজার ৬৩০ পাউন্ড কামানের গোলাসহ আরো বেশ কিছু সামরিক সরঞ্জাম ছিলো। শুধু মার্কিন সমরাস্ত্রই নয় গাজার হত্যাকাণ্ডে ভারতীয় অস্ত্রের ব্যবহারের কথাও বেশ জোর দিয়ে বলছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো।
ফিলিস্তিনের সংবাদ মাধ্যমের খবরে প্রকাশ গাজার নুসেইরাত এলাকায় জাতিসংঘ পরিচালিত আশ্রয়শিবিরে ইসরায়েলি যুদ্ধ বিমান থেকে যে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছিলো তাতে স্পষ্ট লেখা রয়েছে মেড ইন ইন্ডিয়া। তা ছাড়া, মোদি সরকারের সঙ্গে ইসরায়েলি নেতানিয়াহুর সুসম্পর্কের বার্তাটিও বেশ পুরনো। মোদি সরকার সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে টেনেটুনে সম্মান রক্ষা করতে পারলেও আটলান্টিকের ওপরের নভেম্বরের পরীক্ষায় বাইডেন কতোটা ফলাফল পাবেন তা নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে নভেম্বর পর্যন্ত। সচেতন মহল এবং মার্কিন বিশেষজ্ঞরা বাইডেন প্রশাসনের চলমান নীতিকে ব্যর্থ আখ্যা দিয়ে দেশটিতে যেভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন তাতে গাজায় মানবিক বিপর্যয় ঠেকাতে হয়তো একদিন সোচ্চার হয়ে উঠবে পুরো বিশ্ব। তখন ভূরাজনীতির চালে কতোটা সঠিক আর কতোটা ভুল করে গেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তা কেবল ইতিহাসই বিচার করতে পারবে।
লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক