ঘুষের টাকা ফেরত পেতে শিক্ষিকার লাশ নিয়ে স্কুলে স্বজনেরা

দৈনিক শিক্ষাডটকম, কাজীপুর (সিরাজগঞ্জ) |

দৈনিক শিক্ষাডটকম, কাজীপুর (সিরাজগঞ্জ) : ঘুষের টাকা ফেরতের দাবিতে এক শিক্ষিকার মরদেহ নিয়ে বিদ্যালয়ে অবস্থান নেন স্বজনেরা! এ সময় বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক গিয়ে উত্তেজিত জনতার সামনে আগামী তিন দিনের মধ্যে গৃহীত ওই ঘুষের টাকা ফেরত দেয়ার অঙ্গীকার করেন। পরে স্বজনেরা লাশ নিয়ে বিদ্যালয় ত্যাগ করে দাফনের ব্যবস্থা করেন। 

গতকাল সোমবার এ ঘটনাটি ঘটেছে সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার গাড়াবেড় গ্রামে। টাকার শোকে গত ৩০ জানুয়ারি ওই শিক্ষিকা তাঁর বাবার বাড়িতে স্ট্রোক করেন বলে দাবি জানিয়েছেন স্বজনেরা। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজ ভোররাতে রাজধানীর একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

মৃত ওই শিক্ষিকার নাম রোকেয়া খাতুন। তিনি উপজেলার জিসিজি বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের মাধ্যমিক শাখার ইংরেজি বিষয়ের সহকারী শিক্ষিকা ছিলেন। ২০ বছর ধরে বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেও বেতন পাননি তিনি। বরং বেতন পাইয়ে দেয়ার আশ্বাসে দফায় দফায় টাকা নিয়েছেন ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও পরিচালনা কমিটির সভাপতি।

বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও স্থানীয়রা বলছেন, রোকেয়া খাতুন বগুড়ার ধুনট উপজেলার ভূতবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা। গাড়াবেড় গ্রামে তাঁর বাবার বাড়ি। বিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকে নিয়মিত পাঠদান করিয়েছেন তিনি। কিন্তু বেতন করে দেয়ার কথা বলে বিভিন্ন সময় ঘুষ নিয়েছেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফরিদুল ইসলাম ও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি কাজীপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান দ্বীন মোহাম্মদ বাবলু।

বিদ্যালয়ের অফিস সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে জিসিজি বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা হয়। পরে ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩ আগস্ট দৈনিক করতোয়া পত্রিকায় ইংরেজি শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। একই বছরের অক্টোবরের ২৩ তারিখে নিয়োগ পরীক্ষার পর ৬ নভেম্বর বিদ্যালয়টিতে ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন রোকেয়া খাতুন। এর পর থেকে অদ্যাবধি শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত থেকে নিয়মিত পাঠদান করাতেন তিনি।

সরেজমিন দেখা যায়, ঘুষের সেই টাকা ফেরতের দাবিতে আজ সকালে মরদেহ নিয়ে বিদ্যালয় চত্বরে অবস্থান নেন ওই শিক্ষিকার স্বজনেরা। চার লাখ টাকা ফেরত দেয়ার অঙ্গীকার করলে মরদেহ নিয়ে বিদ্যালয় ত্যাগ করেন তাঁরা। টাকার শোকে গত ৩০ জানুয়ারি ওই শিক্ষিকা গাড়াবেড়ের বাবার বাড়িতে স্ট্রোক করেন। পরে আজ ভোররাতে রাজধানীর একটি হাসপাতালে মৃত্যু বরণ করেন। 

রোকেয়া খাতুনের স্বামী আব্দুল করিম বলেন, ‘আমি নিজেও বিদ্যালয়টিতে শিক্ষক হিসেবে ঢুকেছিলাম। তখন বিদ্যালয়ের ঘর করার কথা বলে আমার স্ত্রী ও আমার কাছ থেকে ৮০ হাজার টাকা নেয় প্রধান শিক্ষক ফরিদুল। এরপর আমি সেখান থেকে সরে আসলেও আমার স্ত্রী থেকে যায়। বেতন করে দেয়ার কথা বলে পরে দফায় দফায় চার লাখ টাকার মতো নেয় তারা। কিন্তু বেতন করে দেয়নি।’

আব্দুল করিম বলেন, ‘সর্বশেষ বেতন করে দেয়ার কথা বলে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে দুই লাখ টাকা চায়। সহকারী শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাকের উপস্থিতিতে দেড় লাখ টাকায় মীমাংসা হয়। পরে আমি দেড় লাখ টাকা দিয়ে সভাপতি বাবলু চেয়ারম্যানের পায়ে পড়ি, স্ত্রীর বেতন করে দেয়ার জন্য। সেই টাকাও বিফলে যায়। সব মিলিয়ে আমার কাছ থেকে সাত-আট লাখ টাকার মতো  নিয়েছে তারা। টাকার শোকে আমার স্ত্রী স্ট্রোক করে মারাই গেল। আমি ওই টাকা ফেরত চাই। সাথে এই দীর্ঘদিন যে পরিশ্রম করেছে তার ক্ষতিপূরণ চাই।’

রোকেয়ার বড় ভাই খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমার বোনের বেতন করে দেয়ার কথা বলে প্রধান শিক্ষক ফরিদুল ইসলাম ও সভাপতি, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান দ্বীন মোহাম্মদ বাবলু পর্যায়ক্রমে সাত থেকে আট লাখ টাকা নিয়েছে, কিন্তু বেতন করে দেয় নাই। টাকার শোকে আমার বোন স্ট্রোক করে মারা গেছে। আমরা এর ন্যায়বিচার চাই।’ 

রোকেয়ার ভাগনে হাশেম আলী বলেন, ‘এমপিওভুক্তির আবেদনের কথা বলে খরচ বাবদ আমার কাছ থেকে ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা নেয় বিদ্যালয়টির করণিক লোকমান হোসেন। এর বাইরেও সম্মানীর টাকা চান লোকমান হোসেন।’ 

করণিক লোকমান হোসেন টাকা নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘আমি ওই টাকা নিয়ে হেড স্যারকে দিয়েছি। হেড স্যারের বাইরে তো আর আমি কিছু করতে পারব না।’

বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক ফরিদুল ইসলামও টাকা নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘রোকেয়ার টাকা দিয়েই আমরা বিদ্যালয়ের ঘর ওঠাই। বেতন করে দেয়ার কথা বলে বিভিন্ন সময় টাকাও নিয়েছি। আগামী ৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে আমরা রোকেয়ার চার লাখ টাকা ফেরত দেব।’ 

বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও কাজীপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান দ্বীন মোহাম্মদ বাবলুও ঘুষের টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘বেতন করে দেয়ার কথা বলে আমরা যে টাকা নিয়েছি তার চার লাখ টাকা রোকেয়ার স্বজনদের কাছে ফেরত দেব। ইউএনও স্যার এসে আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন।’ 

এ বিষয়ে কাজীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহরাব হোসেন বলেন, ‘শিক্ষিকার লাশ নিয়ে বিদ্যালয়ে অবস্থানের খবরে ঘটনাস্থলে যাই। প্রধান শিক্ষক ও বিদ্যালয়ের সভাপতির সাথে কথা বলি। তাঁরাও টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। তাঁরা বলেছেন আগামী তিন দিনের মধ্যে চার লাখ টাকা ফেরত দেবেন।’

ইউএনও আরও বলেন, ‘মৃত ওই শিক্ষিকার নিয়োগের কোনো কাগজপত্রই দেখাতে পারেননি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। পরবর্তীতে কাগজপত্র দেখে আমরা মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করব। তারাই যাবতীয় ব্যবস্থা নেবে।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দীপু-টিপু-রতন সিন্ডিকেটের ঘুষের সাম্রাজ্য - dainik shiksha দীপু-টিপু-রতন সিন্ডিকেটের ঘুষের সাম্রাজ্য মাধ্যমিকের পাঠ্যক্রম সংস্কার চেয়ে হাইকোর্টে রিট - dainik shiksha মাধ্যমিকের পাঠ্যক্রম সংস্কার চেয়ে হাইকোর্টে রিট যোগদান থেকেই বেতন পাবেন যেসব শিক্ষক - dainik shiksha যোগদান থেকেই বেতন পাবেন যেসব শিক্ষক যোগদান থেকেই বেতন পাবেন যেসব শিক্ষক - dainik shiksha যোগদান থেকেই বেতন পাবেন যেসব শিক্ষক আসামে বসে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর ‘ভারত বিরোধী’ পোস্ট, যে পদক্ষেপ নিলো কর্তৃপক্ষ - dainik shiksha আসামে বসে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর ‘ভারত বিরোধী’ পোস্ট, যে পদক্ষেপ নিলো কর্তৃপক্ষ গণহত্যার মদদদাতাদের দাপটে স্থবির বাউবি - dainik shiksha গণহত্যার মদদদাতাদের দাপটে স্থবির বাউবি কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0048890113830566