চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় :উত্সব আবাহন

সালাহউদ্দিন মো. রেজা |

১৮ নভেম্বর ’১৬ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তী। দিনটিকে সামনে রেখে বেশ কিছুদিন আগে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে প্রাণের উচ্ছ্বাস শুরু হয়েছে। চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলা এমনকি বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীরা এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন।

ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ইতোমধ্যেই সরব হয়ে উঠেছে। সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানের মূল আয়োজক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে এ আয়োজনকে আরো সুন্দর, আকর্ষণীয় ও উপভোগ্য করে তুলতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদেরও সম্পৃক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ছাত্র-ছাত্রী, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ফ্যাকাল্টি মেম্বাররা সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের দিনটির দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছেন।

১৯৬৫ সালের ২৮ নভেম্বর কলা অনুষদের বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস এবং অর্থনীতি বিভাগের ২০০ ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে শুরু হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা। বর্তমানে প্রায় ২২ হাজার ছাত্র-ছাত্রী এখানে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করছেন। গত অর্ধশতাব্দী জুড়ে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ শেষে জীবন ও জীবিকার তাগিদে দেশে ও বহির্বিশ্বে পাড়ি জমিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ বছর পূর্তির এ অনুষ্ঠানে ডাক পেয়ে অনেকে আলোড়িত হয়েছেন। মনের অজান্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনের আড্ডা, অনেক সুখ-দুঃখের অনুভূতিগুলো নাড়া দিতে শুরু করেছে।

গাদাগাদি ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে কোরাস গানের সুর, কিংবা ফিরতি শাটল ট্রেনে সেই দু’জনার একান্তে বসে মনের ভাব বিনিময়ের মধুর দিনগুলো আবার অনেককে আন্দোলিত করে। ক্যাম্পাসের লাল ইটের ভবনগুলোর কোনো এক জায়গায় সহপাঠীদের নিয়ে জম্পেশ আড্ডা, মউর দোয়ানের অফুরন্ত চা, সিঙ্গারা, ক্লাসের ফাঁকে বারান্দায় স্যারদের চোখ এড়িয়ে সিগারেট সাবাড়, এরকম হাজারো টুকরো স্মৃতি মনকে নাড়া দেয়। আরো মনে পড়ে চাকসু ক্যাফেটেরিয়ায় লাইন বেঁধে টোকেন নিয়ে সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার সংগ্রহ করার কথা। কত আনন্দের ছিল সেই দিনগুলো।

এখনো মনে পড়ে বিজ্ঞান অনুষদে পড়ুয়া বন্ধুদের কথা। যারা হলে থাকতেন তাদের তেমন একটা কষ্ট হতো না। কিন্তু শহর থেকে যারা আসা-যাওয়া করতেন, কি হাড়ভাঙা খাটুনিই তাদের করতে হতো। সকালের প্রথম ট্রেনে ক্যাম্পাসে গিয়ে সারাদিন ক্লাস, প্র্যাকটিক্যাল সেরে বিকালের ৫টা ২০ মিনিটের ট্রেনে ফের শহরে ফিরে আসা। বাসায় ফেরার পর ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়তো। নিত্যদিনের এই অভিযাত্রায় হয়তো কষ্টকর ছিল। কিন্তু তার চেয়েও বেশি ছিল আনন্দ। প্রিয় বন্ধুদের সান্নিধ্যে কীভাবে সময়টা চলে যেতো টেরই পাওয়া যেতো না।

শাটল ট্রেনে সবাই মিলে হৈ-হুল্লোড় করে আসা-যাওয়ার চিরায়ত রীতি আজো বহাল রয়েছে। পৃথিবীর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য এ ধরনের শাটল ট্রেন ব্যবস্থা আছে কিনা আমার জানা নেই। শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে পাহাড় ও সবুজ গাছ-গাছালি ঘেরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এক প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে ভরা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলে কানে আসে শেয়ালের ডাক। দিনের বেলায় পাখির কলরোল শহরের কোলাহল মুক্ত এ পরিবেশকে মুগ্ধ না করে পারে না।

৫০ বছরে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে মর্যাদাপূর্ণ একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। এমন এক মাহেন্দ্রক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা প্রশংসনীয়। প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকের পক্ষেই হয়তো শতবছর পূর্তি উত্সবে যোগ দেওয়ার সৌভাগ্য হবে না। তাদের জন্য এবারের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের উত্সবটি তাই বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ। প্রতিটি মুহূর্ত তারা আরো আনন্দ ও উত্সবের আমেজে স্মরণীয় করে রাখতে চাইবেন। যার আভাস ইতোমধ্যে পাওয়া গেছে। গড়ে তোলা হয়েছে প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সমন্বয় পরিষদ।

চট্টগ্রাম শহরে অবস্থিত চারুকলা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্যসহ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের প্রাক্তন ভিপি, জিএসসহ নেতৃবৃন্দ এবং বিভিন্ন ব্যাচ ও বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকবৃন্দ প্রতি শুক্রবার আনুষ্ঠানিক সভা করে যাচ্ছেন। ঐক্যবদ্ধ একক প্ল্যাটফরমে সকল প্রাক্তন শিক্ষার্থীর অবস্থান নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকলেও শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর আলোকবর্তিকা তুলে ধরার এক মন্ত্রে সবাই একমঞ্চে সমবেত হয়েছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস, ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে এবং সুবর্ণজয়ন্তীকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রতিনিয়ত সমন্বয় পরিষদ আলাপ-আলোচনা ও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে পুরো অনুষ্ঠানকে জাকজমকপূর্ণ ও বর্ণিল করে তোলার পরিকল্পনায় ব্যস্ত উদ্যোক্তারা।

এতো গেলো প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সমন্বয় পরিষদের উদ্যোগ। তার চেয়ে আরো ব্যাপক কর্মসূচি ও সৃজনশীল পরিকল্পনা নিয়ে আসছেন বিভিন্ন বিভাগ ও ব্যাচের ছাত্র-ছাত্রীরা। অনেক ব্যাচ তাদের পরিকল্পনা গ্রহণের সুবিধার্থে গত এক বছর ধরে ঢাকা ও চট্টগ্রামে অফিস নিয়ে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন।

চট্টগ্রাম ছাড়াও ঢাকা, সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী, বরিশালসহ বেশ কয়েকটি জেলায় ব্যাচভিত্তিক এবং প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিভিন্ন ব্যাচ ও বিভাগ পূর্ব থেকেই সামাজিক অনুষ্ঠানাদি করে আসছেন। সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে বর্তমানে ১৮ নভেম্বরকেই টার্গেট করে কর্মসূচি গ্রহণ করছেন। অনেকে আবার তাদের ব্যাচের সুন্দর সুন্দর নাম দিতেও ভোলেননি। ১৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা নাম দিয়েছেন সুইট সিক্সটিন। একুশ ব্যাচের নাম রাখা হয়েছে একুশের আড্ডা। সকলের লক্ষ্য একটাই। কিভাবে সবাই মিলে সর্বোচ্চ মজা করা যায়। অধিকাংশ ব্যাচই কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকায় সভা করার মাধ্যমে কর্মসূচি চূড়ান্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। এরই মধ্যে চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় হোটেল-রেস্টুরেন্ট, কমিউনিটি হলে মিলিত হয়ে প্রাথমিক কর্মসূচি ঠিক করছে। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, কবে আসবে সেই দিনটি। কবে যাবো সেই স্মৃতি ঘেরা ক্যাম্পাসে।

লেখক : সালাহউদ্দিন মো. রেজা , সাংবাদিক ও প্রাক্তন শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0050759315490723