দৈনিক শিক্ষাডটকম, চবি: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) উপাচার্য হিসেবে পাঁচ বছর পার করে বিদায় নিয়েছেন অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার। শেষ কর্মদিবসেও অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দিয়েছেন বেশ কয়েকজন কর্মচারীকে। দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া এসব প্রার্থীর বেশির ভাগই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও তাদের আত্মীয়স্বজন বলে জানা গেছে। এছাড়াও বিতর্কিত নিয়োগ, শিক্ষক নিয়োগে আর্থিক লেনদেন, খেয়ালখুশি মতো বিশ্ববিদ্যালয় পরিচলনা, অনিয়ম ও দুর্নীতির বহু অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধ্যাপক শিরীণের প্রশাসনিক ব্যর্থতা দেশের এ বিদ্যাপীঠকে তলানিতে পৌঁছে দিয়েছে। নষ্ট হয়েছে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক।
নিয়োগ পেতে মরিয়া ছাত্রলীগ : মঙ্গলবার ড. শিরীণের শেষ কর্মদিবস জেনে নিয়োগ পেতে ছাত্রলীগের সাবেক একাধিক নেতাকর্মী ভিড় করতে থাকেন ভিসি কার্যালয়ে। এদিন নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী সেকশন অফিসারের পদোন্নতি বোর্ড ছিল। ছাত্রলীগের নেতাদের কারণে সেই বোর্ড অনুষ্ঠিত হয়নি। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাৎক্ষণিকভাবে নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন করতে চাপ সৃষ্টি করেন উপাচার্যকে। বাধ্য হয়ে কার্যালয় ত্যাগ করে ক্যাম্পাসের নিজ বাসভবনে চলে যান ড. শিরীণ। সেখানে বসেই মূলত নিয়োগের কাগজে স্বাক্ষর করেন।
তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী সেলের প্রধান সৈয়দ মনোয়ার আলী বলেন, ‘গতকাল (গত মঙ্গলবার) প্রায় ৪৪ জনের মতো নিয়োগ হয়েছে। অনেকে নিয়োগ পেতে উপাচার্য কার্যালয়ে এসেছিলেন। আমাকেও হুমকি দিয়েছে ছাত্ররা। আমি নিজেই অসুস্থ হয়ে গেছি। আজকেও ক্যাম্পাসে যেতে পারেনি।’
এসব নিয়োগ সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ জামিনুর রহমান বলেন, এসব নিয়োগ সম্পর্কে আমরা অবগত না। নতুন উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চবির বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার ২০১৬ সালে উপ-উপাচার্য হন। সেই পদে থাকাকালেই ২০১৯ সালের ১৩ জুন থেকে উপাচার্য পদে রুটিন দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। ওই বছরের ৩ নভেম্বর চবির প্রথম নারী উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পান তিনি। গত বছরের ৩ নভেম্বর চার বছর মেয়াদ পূর্ণ করেন ড. শিরীণ। এর মধ্যে প্রশাসনের নানা অনিয়মের অভিযোগে বারবারই সংবাদের শিরোনাম হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর গত মঙ্গলবার ড. শিরীণকে সরিয়ে উপাচার্য হিসেবে অধ্যাপক ড. আবু তাহেরকে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি।
শিক্ষক সমিতির আন্দোলন, নানা অভিযোগ : অনিয়মের নানা অভিযোগ তুলে গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর থেকে অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের পদত্যাগের দাবিতে দুই মাসব্যাপী আন্দোলন করে শিক্ষক সমিতি। এসব অভিযোগের মধ্যে রয়েছে বিভাগীয় পরিকল্পনা কমিটির সুপারিশ ছাড়া শিক্ষক নিয়োগ, বিজ্ঞাপিত পদের বাইরে অতিরিক্ত নিয়োগ, প্রচলিত নিয়ম ভঙ্গ করে শিক্ষক নিয়োগ বোর্ড গঠন, তথ্য জালিয়াতির মতো অভিযোগে প্রার্থীকে নিয়োগ দানের জন্য সুপারিশ, বাণিজ্য অনুষদের নির্বাচিত ডিনের সঙ্গে উপাচার্যের অসৌজন্যমূলক আচরণ, উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিতর্কিত ব্যক্তিদের দিয়ে কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ বোর্ড গঠন করা। এসব কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীতের ভাবমূর্তি ক্ষুণœœ হয়েছে বলে দাবি শিক্ষক সমিতির। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল হক বলেন, আমাদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা প্রমাণ হয়েছে। ড. শিরীণের পুরো প্রশাসন দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িত ছিল। অধ্যাপক শিরীণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তিকে তলানিতে নিয়ে গিয়েছেন।
নিয়োগবাণিজ্য : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য ড. শিরীণের সময়ে শিক্ষক ও কর্মচারী পদে প্রায় ৪০০ জনের নিয়োগ হয়েছে। এসব নিয়োগের বেশির ভাগই ‘বিতর্কের’ জন্ম দিয়েছে। বিজ্ঞাপিত পদের বাইরে দেওয়া হয়েছে একাধিক নিয়োগ। বিজ্ঞপ্তি ও পরীক্ষা ছাড়াও নিয়োগ পেয়েছেন দেড় শতাধিক। এ ছাড়া উপাচার্যের বিদায়ের দুই মাস আগেও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নির্দেশনা না মেনে শতাধিক দৈনিক ভিত্তিতে কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন তিনি।
নিয়োগের ফোনালাপ ফাঁস : ‘শিক্ষক পদে চাকরি পেতে ২০ লাখ টাকা লাগবে। চট্টগ্রামের হলে ১৬ লাখ। তৃতীয় শ্রেণিতে চাকরি পেতে ১২ লাখ এবং চতুর্থ শ্রেণির ঝাড়ুদার ও মালীর চাকরি পেতে লাগবে ৮ লাখ। এ টাকাগুলো দিয়ে ভিসি ম্যাডামকে ও প্রশাসনিক দপ্তর ম্যানেজ করতে হয়।’ ২০২২ সালে শিক্ষক নিয়োগবাণ্যিজ্যের এ ধরনের ৫টি ফোনালাপ ফাঁস ছিল ড. শিরীণের শাসনামলে সমালোচিত ঘটনার শীর্ষে। এসব অডিও ফাঁসের ঘটনায় দুই কর্মচারীকে চাকরিচ্যুতও করা হয়। এই ঘটনার ৬ মাস পর তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগবাণিজ্যের আরও দুটি ফোনালাপ ফাঁস হয়। সেখানে তিন চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে আট লাখ ২০ হাজার টাকা নেওয়ার অভিযোগ ওঠে রেজিস্ট্রার অফিসের নিম্নমান সহকারী মানিকচন্দ্র দাশের বিরুদ্ধে। টাকা ফেরত চাওয়ায় প্রার্থীকে হুমকিও দেয় মানিক। এ ঘটনায় মানিককে সাময়িক বরখাস্ত করে কর্তৃপক্ষ।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে সদ্য বিদায়ী উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাড়া মেলেনি।
মারধরে আহত ব্যক্তির নাম ইয়াহিয়া টিপু। তাকে ৫৫০ টাকা দৈনিক মজুরির শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগে কম্পিউটার ল্যাব সহকারী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে যান ড. শিরীণ। বুধবার তিনি রেজিস্ট্রার অফিসে জয়েন করতে এসে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে মারধরের শিকার হোন। টিপু বলেন, ‘আমার চাকরি চূড়ান্ত হয়েছে। আমি জয়েন করতে আসছিলাম রেজিস্ট্রার অফিসে। আমাকে জিজ্ঞেস করছে, আমি ছাত্রলীগ করি কিনা। না উত্তর দেওয়ায় তারা আমাকে মারধর করে।’
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর মোহাম্মদ রোকন উদ্দিন আমাদের সময়কে বলেন, ছাত্রলীগের কিছু ছেলে একজনকে মারধর করতে শুনেছি। রেজিস্ট্রার অফিসেও অনেকে হট্টগোল করে। মানসম্মানের দিকে তাকিয়ে আমরা পরে চলে এসেছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) কে এক নূর আহমেদ বলেন, এটা আমার জন্য অপমানজনক। আমি তো তাদের (ছাত্রলীগ) নিয়োগ দিতে পারব না। নিয়োগ দেবেন ভিসি। তবুও তারা আমার এখানে এসে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছে।