চার বছরে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ও করণীয়

মো. সিদ্দিকুর রহমান |
প্রাথমিকে শতকরা ৬০ ভাগ নারী শিক্ষক। শিশুর প্রতি মায়ের মতো ভালবাসা দিয়ে পাঠদানসহ বিদ্যালয়ে অবস্থানকালীন সময়ে তারা সার্বিক দায়িত্ব পালন করবে এটা আশা করা অযৌক্তিক নয়। সাবেক শিক্ষা সচিব এন আই খান ১৯৯০খ্রিষ্টাব্দে ম্যানচেষ্টারে প্রশিক্ষণে গিয়ে তার বড় মেয়েকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করেন। সেখানে একদিন শ্রেণিকক্ষে মেয়েটি বমি করে ফেলেন। তিনিও তার স্ত্রী বমি পরিষ্কার করতে চাইলে প্রধান শিক্ষক জানান, স্কুলের শিক্ষকেরা বমি পরিষ্কার করবেন। উন্নত বিশ্বে এটাই হলো বাস্তবতা। অথচ আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ইদানিং করোনাকালে ছেলেমেয়েসহ অনেক কাছের আত্মীয় স্বজনও ভিনদেশির মত আচরণ করছেন। আমাদের দেশের মোটামুটি স্বচ্ছল অফিসের ছোট বড় কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষকরা তাদের নিজের চেয়ার টেবিল পরিষ্কার করার জন্য আয়া বা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর অপেক্ষায় হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। একটু নেকড়া দিয়ে নিজের চেয়ার টেবিল তাৎক্ষণিক পরিষ্কার করার মানসিকতা অনেকেই হারিয়ে ফেলেছেন। এ অবস্থা মোটেই কাম্য নয়। 
 
আমার শিক্ষকতার সময় অর্থাৎ এক যুগ আগে প্রাক প্রাথমিক ক্লাস ছিল না। সাধারণত তখন ১ম-২য় শ্রেণির শিক্ষার্থীরা টয়লেট ও বমি করে ক্লাস নোংরা করে ফেলতো। সে সময় আমাদের দেশে শিক্ষকেরা সাধারণত প্রধান শিক্ষকের কাছে অভিযোগ দিয়ে অনেকটা নিরব থেকে অফিস রুমে বসে থাকতেন। কোনো কোনো স্কুলে বেসরকারি চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা পরিষ্কার করতেন। কেউ কেউ বলতেন স্যার, পায়খানা, প্রস্রাব, বমি পরিষ্কার করার কাজ আমাদের নয়। বাধ্য হয়ে প্রধান শিক্ষক বাইরে থেকে লোক এনে শ্রেণিকক্ষ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে থাকতেন। আমাদের দেশে শ্রেণিকক্ষ শিক্ষার্থীকে দিয়ে পরিষ্কার করার বিষয়ে অনেক সময় অভিভাবক বিরূপ মন্তব্য নিয়ে তেড়ে আসেন। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে চার বছর বয়সে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা শুরুর আগে একাধিক পরিচ্ছন্নতাকর্মী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন।
 
আরও কিছু নিয়ম করা দরকার। যেমন, শিক্ষার্থীরা নিজের বেঞ্চ পরিষ্কার করে প্রতিদিন বসবে অনুরূপভাবে যদি সর্বস্তরের কর্মচারী নিজের হাতে নিজের বসার চেয়ার টেবিল পরিষ্কার করে, তবে আমাদের মানসিকতা কিছুটা হলে পরিবর্তন আসবে। 
 
আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষের বদ্ধমূল ধারণা, বেশি বেশি বই, খাতা, বাড়িতে পড়াশুনার চাপ থাকলে শিক্ষার্থী খুব তাড়াতাড়ি শিক্ষিত হয়ে উঠবে। বাস্তবে শিশুর বয়স রুচি সামর্থের বাইরে কার্যকর শিক্ষা নয়। বর্তমান সরকার শিশুর শিক্ষা আকর্ষণীয় ও টেকসই করার লক্ষ্যে ৫ বছরে প্রাক-প্রাথমিক শুধুমাত্র ১টি বই দিয়ে, খেলাধুলা, ছড়া, কবিতা, অংকন, গান-বাজনার মাধ্যমে শিশু বান্ধব শিক্ষা চালু করেছেন। বিদ্যালয় ভবন, শ্রেণিকক্ষ শিশু উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করে যাচ্ছেন। পর্যাপ্ত টাকাও ব্যয় করেছেন। অথচ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংকট বেড়েই চলছে।  
 
আমার দীর্ঘসময়ে শিক্ষকতা ও প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতার আলোকে দুটি চ্যালেঞ্জ উপলব্ধি করছি। সেগুলো হল শিক্ষক সংকট ও বেশিরভাগ অভিভাবকের ভ্রান্ত ধারণা।
 
বর্তমানে দীর্ঘসময় ২৬ হাজার শিক্ষকের শূন্যপদ নিয়ে চলছে প্রাক-প্রাথমিকের ৫ বছর বয়সের শিক্ষা। এছাড়াও প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষকের পদশূন্য। শিক্ষক সংকট শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার জন্য প্রাথমিকে প্যানেল ব্যবস্থার বিকল্প কিছু নেই। 
 
কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিশুর সামর্থের বাইরে বই বন্ধ করতে হবে। যাতে অভিভাবকদের ভ্রান্ত ধারণা দূর হয়। শিশু শিক্ষায় সকল শিশুর অভিন্ন বই, কর্মঘন্টা, মূল্যায়ণ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। ৪ বছরে শিশু বাথরুম ব্যবহারসহ সকল কাজ একাকি করতে পারে না। এদিক থেকে বিবেচনা করলে ৪ বছর শিশুর জন্য বিদ্যালয় ভর্তি হবে অনেকটা যন্ত্রণাময়।  
 
৫ বছরের শিশু সাধারণত ক্লাসের বাইরে বসা মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। মায়ের সান্নিধ্যে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে মাঝে মাঝে শিশু ক্লাস থেকে দৌড় দিয়ে মায়ের কাছে চলে যায়। মায়েরাও জানালার পাশে দাড়িয়ে উঁকি মেরে শ্রেণির স্বাভাবিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটায়। ৪ বছরের অবুঝ শিশু বিদ্যালয় ভর্তি করা হলে শিশু, অভিভাবক শিক্ষকের যন্ত্রণা বাড়বে। এ যন্ত্রণা লাঘবও তৃতীয় শ্রেণিতে হঠাৎ এক লাফে ৩টা থেকে ৬টা বই পড়ার উপযুক্ত করে তোলার জন্য প্রাক-প্রাথমিক ক্লাস ৫-৬ বয়সে, ১ম শ্রেণি ৭ বছর, ২য় শ্রেণি ৮ বছর , ৩য় শ্রেণি ৯ বছর করার প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। 
 
চার বছর বয়সে কিন্ডারগার্টেনসহ সকল স্কুলে আইন করে ভর্তি বন্ধ করতে হবে। আনন্দমুখর পরিবেশে শিশু শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশাল জনগোষ্ঠী সন্তানদের স্বার্থে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষকদেরও ট্রেনিং দিতে হবে। শিশুর বয়স ও সক্ষমতার বাইরে শিক্ষা দেয়ার ফল শুভ নয়। বঙ্গবন্ধুর বৈষম্যহীন সমাজ গঠনকল্পে শিশুর শিক্ষায় বৈষম্য দূর করা জরুরি। শিশু শিক্ষায় বৈষম্য ও শিক্ষক সংকট দূর করা হলে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংকট দুর হবে। আলোকিত হবে শিশু শিক্ষা। বিকশিত হবে শিশুর জীবন। 
 
লেখক : মো. সিদ্দিকুর রহমান, সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ; সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিক শিক্ষাডটকম।

পাঠকের মন্তব্য দেখুন
রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি - dainik shiksha রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী - dainik shiksha গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট - dainik shiksha জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ - dainik shiksha আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0058200359344482