চীনে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ২,৭৬৬ যার শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৪৬ দশমিক ৫৫ মিলিয়ন। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে চীনে গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে ৪৪৩ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করা হয়েছে যা বিশ্বে ২য় স্থান। কিউএস ওয়ার্ল্ড র্যাংকিং-এ চীনের ৩০টি বিশ্ববদ্যিালয় আছে শীর্ষ ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে যেখানে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান ১২তম (২০২২)। উচ্চশিক্ষায় বর্তমানে চীনে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪৬ দশমিক ৫৫ মিলিয়ন যাদের ৬০ শতাংশ বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিদ্যায় লেখাপড়া করছে। বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নাতক হওয়া শিক্ষার্থীদের প্রায় ৯৮ শতাংশ কর্ম খুঁজে পায় ১ বছরের মধ্যে। এদের মধ্যে ছেলেরা ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন কর্মে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদিন অন্ততঃ ৩টি আন্তর্জাতিক কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আর সেমিনার সে-তো কমপক্ষে ৩০টি করে অনুষ্ঠিত হচ্ছে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০২১-এ চীন বিশ্বে সর্বোচ্চ সংখ্যক বিজ্ঞান গবেষণাপত্র প্রকাশ করে যার সংখ্যা ২ দশমিক ০৩ মিলিয়ন। চীনের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয় ডিসেম্বরে। অভ্যন্তরীণ ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের মাত্র ১ দিন ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হয়। গোটা চীনে একটি মাত্র আবেদনে একটি প্রশ্নপত্রে তাদের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। মেরিট ও পছন্দক্রম অনুসারে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভাগ বণ্টন করা হয়। ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিসের’ ব্যানারে গোটা চীনে ১-৩ দিনের মধ্যে ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করে তাদেরকে ডরমিটরিতে তুলে দেয়া হয়। চীনে সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে আবাসিক হলে থাকতে হয়। কারণ, তাদের শ্রেণি কার্যক্রম গবেষণা চলে সকাল ৮:০০ হতে রাত ১১:৪৫ পর্যন্ত। স্নাতক পর্যায়ে ভর্তির মাত্র ১০ দিনের মধ্যে সবাইকে ‘স্মার্ট স্টুডেন্ট আইডি কার্ড’ দেয়া হয়। যে কার্ড ব্যাংক একাউন্টের সঙ্গে লিংক করা থাকে। ফলে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে সকল প্রকার কেনাকাটা ও অন্যান্য কাজ এ কার্ড পাঞ্চ করে করা যায়। এ ছাড়া, ক্যাম্পাসের সকল একাডেমিক ডাটা এই কার্ডে ইনপুট দেয়া থাকে। ফলে যেকোনো একাডেমিক কাজে এ স্মার্ট কার্ড ব্যবহার বাধ্যতামূলক ও সহজ।
সকল স্নাতক শিক্ষার্থীকে (সেপ্টেম্বর সেমিস্টারের প্রথম মাসে) বাধ্যতামূলক সামরিক ট্রেনিং নিতে হয়। সকাল ৭:০০টা হতে রাত ১০:০০টা পর্যন্ত একটানা এ ট্রেনিং চলে। শিক্ষার্থীদের জন্য একটি ক্যাম্পাসে ৪-৫টি কমন গোসলখানা থাকে (পুল টাইপড)। স্নাতক শিক্ষার্থীদের জন্য হলে কোনো গোসলখানা নেই; শুধুমাত্র ওয়াশরুম আছে। সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে ক্যানটিনে খেতে হয়। হলে সংযুক্ত কোনো ক্যানটিন নেই। তাদের ক্যাম্পাসে অবস্থিত কমন ক্যানটিনে খেতে হয় নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে। কেউ নিয়মের বিন্দুমাত্র ব্যত্যয় ঘটায় না। যেমন লাইনে দাঁড়িয়ে (ছাত্র-শিক্ষক) খাবার নেয়া, লাইনে দাঁড়িয়ে তৈজসপত্র যথাস্থানে রাখা এবং নির্ধারিত সময় শেষ হলে কেউ খাবার পায় না। খাবার খুবই সস্তা। ক্যানটিনে কমপক্ষে ৩০ (ত্রিশ) ধরনের খাবার থাকে প্রতি বেলায়।
বছরে তিন মাসের সেমিস্টারের প্রথম দিনই প্রতিটি কোর্সের আউটলাইন দিয়ে দেয়া হয়। অর্থাৎ একটি সেমিস্টারে ১০টি ক্লাস হবে; কোনদিন কোন টপিকের ওপর ক্লাস হবে তা জানিয়ে দেয়া হয়। চার ঘণ্টার ক্লাসে প্রথম ঘণ্টায় শিক্ষার্থীরা প্রেজেন্টেশন দেবেন এবং এর ওপর মতামত, প্রশ্নোত্তর পর্ব চলবে প্রায় বিশ মিনিট। এরপর সংশ্লিষ্ট কোর্স টিচার প্রজেক্টরে প্রেজেন্টেশন দেবেন। প্রেজেন্টেশনে রিসার্চ আর্টিকেল, ডকুমেন্টারি ও ভিডিও প্রদর্শন থাকে কমন বিষয়। একটি নির্দিষ্ট টপিকের ওপর প্রতিটি কোর্সেই দুটি রিসার্চ পেপার জমা দিতে হয়। এগুলো অবশ্যই হতে হবে প্রকাশনাযোগ্য আন্তর্জাতিক মানের রিসার্চ পেপার। কোনো প্লেজারিজম থাকা যাবে না। ক্লাসে উপস্থিতির জন্য ৩০ শতাংশ মার্কস নির্ধারণ করা থাকে। কেউ ক্লাসে যথাযথ ভাবে উপস্থিত না থাকলে তাকে নিশ্চিত ফেল করতে হবে। ১০০ শতাংশ ক্লাসে উপস্থিত থাকলে অন্যান্য বিষয় সহজ করে খাতা মূল্যায়ন করা হয়। প্রতি বছরই প্রত্যেকটি কোর্সের অন্তত ৩০ শতাংশ পরিবর্তন করা হয় সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। অনেক সময় নতুন কোর্স যোগ করা আবার পুরাতন কোন কোর্স বাদও দেয়া হয়। সুতরাং স্নাতক পর্যায় হতে একজন শিক্ষার্থী গবেষণা পেপার রিভিউ, প্রেজেন্টেশন, রিসার্চ রিপোর্ট রাইটিং এ দক্ষতা অর্জন করতে থাকে।
চীনের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সেন্ট্রাল ডাটাবেজ আছে। যেখানে প্রতিটি শিক্ষার্থীর সকল তথ্য ইনপুট দেয়া থাকে। ফলে কোর্স সিলেকশন, সিলেবাস, টিচার সিলেকশন, পরীক্ষার নিয়ম-কানুন, পরীক্ষার সময়, পরীক্ষার ফলাফল ইনপুটেট বা আপলোডেড থাকে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ঘরে বসেই সকল তথ্য অনায়াসে পেতে পারে। ঘরে বসে ডকুমেন্ট ও তথ্য ডাউনলোড বা আপলোড করতে পারে। যেমন-ডরমিটরিতে রুমের আবেদন, ভিসা প্রসেসিং, থিসিস ডিফেন্স প্রভৃতি। কোনো আবেদন সাবমিট করার সঙ্গে সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল অফিসিয়াল বা প্রফেসর তা নোটিফায়িড হবে পরবর্তী কার্যার্থে। সুতরাং ঘরে বসেই অর্ধেক কাজ করা যাচ্ছে। বেশির ভাগ কাজ অনলাইনে স্বাক্ষরসহ অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। ফলে বিদেশে বসেও সকল কাজ করা সম্ভব।
সকল ক্ষেত্রেই ‘স্মার্ট ফাংশনিং’ বিরাজমান। হোম গ্রোউন অ্যাপ ‘উইচ্যাট’ কেবল একটি এপ্লিকেশনই নয়; এটা একটি অফিস বা ব্যাংক। তাৎক্ষণিকভাবে অফিসিয়াল নোটিশ চলে আসে শিক্ষার্থীদের উইচ্যাট আইডিতে। ফলে আধা ঘণ্টার নোটিফিকেশনে অধিকাংশ কাজ করা সম্ভব হয়। এই অ্যাপ এর মাধ্যমে কেনাকাটা, মানি ট্রান্সফার এতোটাই নিরাপদ ও সহজ যে চীনে কারো পকেটেই কোনো ক্যাশ টাকা থাকে না। এজন্যই চীনকে বলা হয় ‘ক্যাশলেস ও পেপারলেস সোসাইটি’। সকল প্রকার কেনাকাটা সম্ভব এই একটি মাত্র অ্যাপে এবং সকল প্রকার অফিসিয়াল কাজও করা যায় এই উইচ্যাট অ্যাপের মাধ্যমে।
প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি এতোটাই সমৃদ্ধ যে মনে হয় বিশ্বকে সামনে নিয়ে পড়তে বসলাম। পুরো লাইব্রেরিটা অটোমেশন করা থাকে। স্টুডেন্ট আইডি কার্ড ব্যবহার করে সবকিছু করা সম্ভব। অর্থাৎ আলাদা কোনো কার্ড কোথাও প্রয়োজন নেই। একটি ‘স্মার্ট আইডি কার্ড’ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল একাডেমিক কাজ করা সম্ভব। লাইব্রেরিতে প্রবেশের জন্য আইডি কার্ড, বই তোলা, ধার নেয়া, লাইব্রেরি সিট বা টেবিল বুকিং সবকিছুই হবে আইডি কার্ড ব্যবহার করে ‘ডিজিটাল ম্যাকানিজম’ এর মাধ্যমে। এর ফলে কারো সঙ্গে কারো কোনো বিবাদ-তো দূরের ব্যাপার কারো সঙ্গে কোনো কথারই প্রয়োজন নেই। লাইব্রেরিতে নামমাত্র মূল্যে ফটোকপি বা প্রিন্ট করা যায়। লাইব্রেরি সংক্রান্ত অনলাইন তথ্য পাওয়ার জন্য রয়েছে কম্পিউটার হল রুম। আইডি নম্বর ব্যবহার করে লগইন করতে হয়। অর্থাৎ বহিরাগত কারো প্রবেশ বা কোনো সার্ভিস গ্রহণ করা সম্ভব নয়। লাইব্রেরির রিডিং স্পেসগুলোতে তাকালে মনে হবে বিশ্বকে জয় করার জন্য চীনে ‘স্টাডি বিপ্লব’ চলছে। এর মানে শত শত শিক্ষার্থী সকাল ৮:০০ টার সময় লাইব্রেরিতে প্রবেশ করে রাত ১০:০০টার সময় বের হয়। কারণ, এ সময় লাইব্রেরি বন্ধ করে দেয়া হয়। লাইব্রেরি বন্ধ হলে শিক্ষার্থীরা চলে যান একাডেমিক ভবনের বিভিন্ন রুমে পড়ার জন্য। কারণ, ওই রুমগুলো সারারাত খোলা থাকে। এগুলো চীন সরকার ক্লাসরুম কাম স্টাডি রুম হিসেবে ব্যবহার করে। কেউ কেউ সারারাত ওখানেই কাটিয়ে দেন।
কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির একটি ডিজিটাল ওয়েবসাইট আছে। ঐ ডিজিটাল লাইব্রেরীতে কী নাই যা বিশে^র অন্য কোথাও আছে। মানে, সকল প্রকার নতুন বা পুরাতন বই, জার্নাল, থিসিসের পিডিএফ ফাইল ওখানে পাওয়া যাবে। সকালে যে জার্নাল পাবলিশ হয়েছে বিকেলে চীনের যেকোন বিশ^বিদ্যালয়ের ডিজিটাল ফরমেটে পাওয়া যায়। এমন কোন জার্নাল নেই তা বাৎসরিক সাবস্ক্রাইব করা নেই। ওপেন একসেস, ফ্রি ডাউনলোড করা যাবে ঐসব জার্নালে। শর্ত হলো লগইন করতে হয় শিক্ষার্থীর আইডি নম্বর দিয়ে। সকল মাস্টার্স ও পিএইচডি স্টুডেন্টদের থিসিস আপনি খুঁজে পাবেন সেখানে। কারণ, ওগুলো ডিগ্রি প্রাপ্তির সময় যখন আপলোড দিতে হয় তখনই পাবলিকলি ওপেন রাখতে হবে। না হলে ডিগ্রি আটকে যাবে। বিশে^র অন্যান্য বিশ^বিদ্যালয়ের থিসিসও অনায়াসে ওখান থেকে ডাউনলোড দেওয়া যায়। প্রতিটি থিসিসের (সারসংক্ষেপ) এমনভাবে ইনপুটেট থাকে যা চীনের সকল গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে, সরকারের নীতি নির্ধারণী অফিসের সঙ্গে লিংকড আপ করা থাকে। অর্থাৎ ‘নতুন কোনো আইডিয়া’ সবার নিকট পৌঁছে দেয়ার জন্য এটা একটা ডিজিটাল টেকনিক। এমনকি ওই থিসিস নিয়ে কেউ জালিয়াতি করবে সেটাও সম্ভব নয়। অন্যদিকে, থিসিসে কোনো চৌর্যবৃত্তি থাকলে তাও ধরা পড়বে। আর এজন্যই এ ব্যবস্থা।
চীনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হওয়ার জন্য পিএইচডি ডিগ্রি অবশ্যই থাকতে হবে। এর পাশাপাশি ‘ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর’ ধারী জার্নালে কমপক্ষে ২টি প্রকাশনা থাকতে হবে। নিয়োগের পরে তাদের যন্ত্রণা আরো বেশি। প্রতিবছর একজন শিক্ষককে নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রকাশনা, সেমিনার, প্রজেক্ট পরিচালনা, কনফারেন্স আয়োজন, স্টুডেন্ট সুপারভাইজ করতে হয় বাধ্যতামূলকভাবে। কোনো একটিতে ঘাটতি পড়লে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চাকরি চলে যাবে। টিচারদের এই পারফরমেন্স বা কোয়ালিটি যাচাই-বাছাই করার জন্য একটি সফ্টওয়্যার আছে যার নাম ‘কেপিএ’। কোনো কিছু পারফরম করার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে প্রমাণসহ ইনপুট দিতে হয়। বছর শেষে রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। পদোন্নতি, প্রজেক্ট প্রাপ্তি, বোনাস, ইনক্রিমেন্ট সবই হবে ‘কেপিএ’ এর রিপোর্ট অনুসারে। প্রতিটি বিভাগে বা স্কুলে কমিউনিস্ট পার্টির শাখা আছে। কোনো বিষয়ে কারো তদবির এখানে দেখা যায়নি। কমিউনিস্ট পার্টির নির্বাহী পদে আসতে হলে গবেষণা, দক্ষতা ও সততার নিরিখেই আসতে হয়। এ ব্যাপারে কারো কোনো সুপারিশ বা তদবির চলে না। এমনকি ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য যদি কেউ হতে চায় তাকেও একাডেমিক ক্ষেত্রে কমপক্ষে তিনটি পুরস্কার পাইতে হয়। ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার জন্য মেধাই একমাত্র যোগ্যতা। পেশি শক্তি বা তদবির কোনো কাজে আসবে না।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, গাছবাড়িয়া সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম