শিক্ষাঙ্গনে টর্চার সেল -৪চুয়েটে আতঙ্কের নাম 'বড় ভাই'

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

আবিদুর রহমান আবিদ। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) ৫১তম ব্যাচের বিডিএস তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে তার বিশেষ জনপ্রিয়তা ছিল। তবে আবিদকে ছাত্রদল কর্মী বলে সন্দেহ করতেন চমেক ছাত্রলীগের নেতারা। এ কারণে পূর্বপরিকল্পিতভাবে ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর দুপুর ২টা, সন্ধ্যা ৭টা ও রাত ১০টায় তিন দফা পিটুনির পর চিকিৎসার সুযোগ না দিয়ে আবিদকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তার বোনের বাসায়। সেখান থেকে চিকিৎসার জন্য তাকে চমেক হাসপাতালে আনা হলে সেখানেও বাধা দেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ২১ অক্টোবর রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান উচ্চশিক্ষা নিতে আসা আবিদ। আট বছর আগের সেই হত্যার বিচার আজও পায়নি আবিদের পরিবার। ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার আসামি ছিলেন ছাত্রলীগের ভিপিসহ ১২ নেতাকর্মী। কিন্তু সাক্ষীরা আসামি শনাক্ত না করায় নির্মম এ ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিরা আদালতের রায়ে বেকসুর খালাস পেয়ে যান। শনিবার (১৯ অক্টোবর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন শৈবাল আচার্য্য।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আবিদ হত্যার পর থেকে চমেকের ছাত্রাবাসে একচ্ছত্র আধিপত্য চলছে ছাত্রলীগের। একই অবস্থা চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট)। এখানে শিক্ষার্থীদের 'বশ' মানাতে টার্গেট করা হয় প্রথম বর্ষে। র‌্যাগিংয়ের মাধ্যমেই চুয়েটে নিজেদের উপস্থিতি জানিয়ে দেন ছাত্রলীগের 'বড় ভাইয়েরা'।

চুয়েটে ভর্তি হয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. কুদরত ই খুদা হলে সিট পেয়ে যান এক শিক্ষার্থী। হলে থাকা যে তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে তা কল্পনাও করতে পারেননি সেই শিক্ষার্থী। প্রথমবর্ষে থাকা অবস্থায় ছাত্রলীগের এক বড় ভাইয়ের বান্ধবীর দেওয়া ফেসবুকের একটি পোস্টে 'সুন্দর হয়েছে' এমন মন্তব্য করায় ছয়-সাতজনের একটি দল সেই শিক্ষার্থীকে ডেকে আনেন ড. কুদরত ই খুদা হলের বর্ধিত একটি অংশে। সবাই মিলে শুরু করেন চড়-থাপ্পড়-লাথি-ঘুষি। তাদের একজন বলেন 'নাচতে'; অন্যজন বলেন 'গাইতে'। আরেকজন বলেন কান ধরে ওঠবস করতে! এভাবেই র‌্যাগিংয়ের নামে চলে অমানুষিক নির্যাতন। বিগত কয়েক বছরে শতাধিক শিক্ষার্থীকে এমন পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল, ক্যান্টিন, গোলচত্বর, ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকসহ বিভিন্ন স্থানে র‌্যাগিংয়ের শিকার হন চুয়েটের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা। নির্দিষ্ট কোনো টর্চার সেল না থাকলেও পুরো ক্যাম্পাসটাই হয়ে ওঠে টর্চার সেল।

শিক্ষার্থীদের র‌্যাগিংয়ের মাধ্যমে অমানবিক নির্যাতনের প্রমাণও পেয়েছে চুয়েট কর্তৃপক্ষ।

চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম বর্ষের প্রায় ১৫ শিক্ষার্থীকে র‌্যাগিংয়ের অভিযোগে দ্বিতীয় বর্ষের চার শিক্ষার্থীকে হল থেকে আজীবনের জন্য বহিস্কার করা হয়। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। একই অভিযোগে ৬ মার্চ সুফিয়া কামাল হলের ১৪ ছাত্রীকে হল থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে দ্বিতীয় বর্ষের দুই ছাত্রীকে আজীবন এবং ১২ ছাত্রীকে এক বছরের জন্য বহিস্কার করা হয়।

২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর চুয়েটের ১১তম ব্যাচের র‌্যাগ ডের আগের দিন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার জেরে ৭-৮ জন যুবক ড. কুদরত ই খুদা হল থেকে কম্পিউটার কৌশল বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী মুক্তাদির শাওনকে তুলে ইমাম গাজ্জালী কলেজের মাঠে নিয়ে যায়। সেখানে অপেক্ষমাণ আরও কয়েকজন মিলে শাওনের ওপর চালায় মধ্যযুগীয় নির্যাতন। তার চোয়াল, বুকের হাড়, মেরুদণ্ডের হাড়, এক পায়ের হাড়ে রড ঢুকিয়ে দেয়, ভেঙে ফেলে হাত ও দাঁত; আঙুলের নখ উপড়ে নেয়, এমনকি জিহ্বাও কেটে নেওয়া হয়। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির পর ২৮ সেপ্টেম্বর তাকে ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালের আইসিইউতে নেওয়া হয়। সেখানে ১৯ দিন অচেতন অবস্থায় চিকিৎসাধীন থাকে শাওন।

র‌্যাগিং মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ায় ২০১৩ সালের মার্চে 'র?্যাগিং শাস্তিযোগ্য অপরাধ' শিরোনামের একটি নোটিশ জারি করে কর্তৃপক্ষ। তাতেও র‌্যাগিং বন্ধ হয়নি। গত বছর সম্মেলনের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি মনীষী রায় টুটুলের ওপর হামলা হয়। বাংলা মদ আনতে শহরে যাওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স চেয়ে না পাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের এক চিকিৎসককে মারধর করা হয়। এসব অভিযোগই ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে।

চুয়েট উপাচার্য অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, র‌্যাগিংয়ের বিষয়টি আমরা অবগত আছি। এর সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে ইতোমধ্যে আমরা বেশকিছু শিক্ষার্থীকে বহিস্কারের পাশাপাশি কারণ দর্শানোর নোটিশও দিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতে এ ধরনের কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে সেজন্য হল প্রভোস্টসহ সংশ্নিষ্টদের নির্দেশনাও দিয়েছি। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় লেখাপড়ার জায়গা। এখানে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। কেউ অন্যায় করলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

র‌্যাগিংয়ের বিষয়টি স্বীকার করে চুয়েট ছাত্রলীগের সভাপতি সৈয়দ ইমাম বাকের বলেন, এসব কাজ যারা করেন তারা সবাই ছাত্রলীগের কর্মী নয়। তাদের মধ্যে কয়েকজন ছাত্রলীগের থাকতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে র‌্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে। র‌্যাগিংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে আমি নিজে কয়েকজনকে ধরে কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিয়েছি। একসময় চুয়েটে অহরহ র‌্যাগিংয়ের ঘটনা ঘটলেও বর্তমানে সে রকম পরিস্থিতি নেই। অতীতে হয়ে থাকলেও আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এ ধরনের ঘটনা এখনও ঘটেনি। আগামীতেও ঘটতে দেব না।

চমেক নিয়ে যত অভিযোগ :চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, '২০০৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের কমিটি সক্রিয় ছিল। পরবর্তী সময়ে ছাত্রলীগের একের পর এক হামলা ও নির্যাতনের মুখে সেখান থেকে বের হতে বাধ্য হয় ছাত্রদল। ক্যাম্পাসে থাকাকালীন ছাত্রদলের প্রায় ৩০ জনকে মারধর করেছে ছাত্রলীগের কর্মীরা। যার কোনোটির বিচার পাইনি আমরা। বর্তমানে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য কোনো সংগঠন কার্যক্রম চালাতে পারছে না।'

২০০০ ও ২০০১ সালের দিকে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন ছাত্রদলের কর্মীরা ছাত্রলীগের কর্মীদের বেধড়ক পিঠিয়েছে বলে অভিযোগ করেন তখনকার চমেক ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বর্তমানে চমেক হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. রিজোয়ান রেহান। তিনি বলেন, 'তখন কোনো কারণ ছাড়াই ছাত্রলীগের কর্মীদের ওপর হামলা চালাত ছাত্রদল। তাদের ভয়ে আমিসহ সাতজন প্রায় দুই বছর ক্যাম্পাসে আসতে পারিনি।'

চমেক ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি হাবিবুর রহমান বলেন, 'সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ আশীর্বাদ। ছাত্রলীগ ও ছাত্র সংসদের কারণে অনেক সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। এখানে কোনো টর্চার সেল নেই। প্রথম বর্ষে ভর্তির পর থেকে শিক্ষার্থীদের থাকা-খাওয়া থেকে শুরু করে বই-খাতা ইত্যাদি আমরাই জোগাড় করে দিই। সিনিয়রদের সঙ্গে জুনিয়রদের সম্পর্কও অনেক ভালো।'


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028510093688965