ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিএনপির অঙ্গ সংগঠনটির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ত্যাগী কর্মীদের অবমূল্যায়ন করা হয়নি। কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের একাধিক নেতা।
২৪২ সদস্যের কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নিয়ে বিদ্রুপকারী এক নারী শিক্ষার্থী।
বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পূর্ণাঙ্গ কমিটির অনুমোদন দেন। এই কমিটিতে সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছেন নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের মাহাদী ইসলাম নিয়ন। তিনি শহীদুল্লাহ হল ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী এবং হল ছাত্রলীগের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম জাহিদের অনুসারী। ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার বিভিন্ন ছবি প্রকাশিত হয়েছে।
এছাড়া বিজয় একাত্তর হল ছাত্রলীগের উপ মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক মো. বজলুর রহমান বিজয় পেয়েছেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ। সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ পাওয়া কাজী শাকিব মিয়া ও সাইফুল ইসলাম রিমন, সদস্য পদ পাওয়া আব্দুল্লাহ আল মামুন ও রায়হান হোসেনের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে। ছাত্রলীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিদ্রূপ করার অভিযোগ থাকা সৈয়দা সুকাইনা নাফিসা তরঙ্গ পেয়েছেন জেন্ডার ন্যায্যতা ও সমতা বিষয়ক সম্পাদকের পদ। ৫ আগস্ট এর পর খালেদা জিয়ার একটা ভিডিও বার্তা নিজ টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে তিনি ব্যঙ্গাত্মকভাবে তিনি লিখেন, ‘ওমা একি জাইগা উঠছে দেখি’ হ্যাশট্যাগ দিয়ে লিখেছেন ‘মাদার্স অব বার্বী গার্লস’। এটিকে খালেদা জিয়াকে নিয়ে কটূক্তি হিসেবে দেখছেন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা।
তারা বলছেন, ২৪২ সদস্যের কমিটির অনেকেই অপরিচিত। যাদের কখনোই আন্দোলন সংগ্রামে দেখা যায়নি। ৫ আগস্টের পর তারা দলে যোগ দিয়েছেন। নিজেদের অবস্থান পোক্ত করতেই অচেনা অজানাদের নিয়ে কমিটি করেছেন কেন্দ্রীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের শীর্ষ নেতারা। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে, যা কোনোভাবেই মানা যায় না।
নেতাকর্মীদের অভিযোগ, যারা বিগত ১৬ বছরে সবচেয়ে নির্যাতিত নিপীড়িত, তাদেরকে সঠিক মূল্যায়ন করা হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের এক নেতা বলেন, ‘কমিটিতে যেটুকু স্বচ্ছতা থাকার দরকার ছিল তার ছিটেফোঁটাও নেই। এমন অন্তত ১০০ জন পদ পেয়েছেন, যাদের বিগত সময়ে কোনো কর্মসূচিতে দেখা যায়নি। এত এত অপরিচিতদের নিয়ে কমিটি গঠন কেন? কেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের পুনর্বাসন করতে হবে। যাদের হাতে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের রক্ত লেগে আছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের কমিটিতে পদ পাওয়া আরেক নেতা বলেন, ‘এই কমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলকে বিতর্কিত করেছে। ছাত্রলীগের তেলবাজ, দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে নিয়ে বিদ্রূপকারীসহ যাদের সঙ্গে ছাত্রদলের ন্যূনতম কোনো সম্পর্ক নেই, এমন লোকজনও কমিটিতে জায়গা পেয়েছে। এই কমিটিতে ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা হয়নি। যারা বিগত ফ্যাসিবাদের আমলে জীবন বাজি রেখে ছাত্রদলের সব কর্মসূচি পালন করেছে, তাদের চেয়ে নতুনদের বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কমিটিতে। এটা ঢাবি ছাত্রদলকে পঙ্গু করে একটা সিন্ডিকেটের আধিপত্য বিস্তারের ষড়যন্ত্র।
ত্যাগীদের অবমূল্যায়নের অভিযোগ তুলেছেন কমিটিতে পদ পাওয়া আরেক নেতা। নাম প্রকাশ না করে তিনি বলেন, ‘যারা বিগত সময়ে হরতাল-অবরোধের মিছিলে ছিল, দুঃসময়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ঝাণ্ডা যাদের হাতে ছিল, তারা বিশেষভাবে কোথাও মূল্যায়িত হয় নাই। সেশন ভিত্তিক কমিটি দেওয়াতে আন্দোলন-সংগ্রামে যারা ছিল, তারা যে মানের পদ পেয়েছে, যারা ঝুঁকি নেয়নি বা নতুন করে ছাত্রদল করতে আসছে তারাও সমমানের পদ পেয়েছে।’
ওই নেতা আরো বলেন, নিজেদের পছন্দের লোককে গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদক পদগুলো দেয়ার জন্য পদের ক্রম পরিবর্তন করে ফেলেছে। ছাত্রদলের বিগত সব কমিটিতে প্রটোকল অনুযায়ী প্রথম থেকে সিরিয়ালি প্রচার সম্পাদক, দপ্তর সম্পাদক, সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক এগুলো থাকে। কিন্তু কোন সিরিয়াল মেইনটেইন করা হয়নি পদের ক্রম গুলোতে।’
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস গণমাধ্যমকে বলেন, ‘তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েছি আমরা। বিষয়টি আমরা দেখছি। আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। তবে তার আগে আমাদের যাচাই-বাছাই করতে হবে।’
সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন বলেন, কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। আমরা অভিযোগগুলো গ্রহণ করেছি। এসব অভিযোগের সত্যতা মিললে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’
কমিটি ঘোষণার পর কিছু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যাওয়ায় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রদল। কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি জহির রায়হান আহমেদ ও এ বি এম ইজাজুল কবির রুয়েলের নেতৃত্বে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটিকে আগামী ২ দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় সংসদের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেন, ‘এসব অভিযোগ সম্পর্কে আমরা অবগত এবং ইতিমধ্যে ঢাবি ছাত্রদলের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’