ছাত্রলীগের কমিটি মানেই টাকার খেলা!

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জয়নুল আবেদিন রাসেল। চরম প্রতিযোগিতা আর চড়াই-উতরাই পেরিয়ে নেতা নির্বাচিত হন তিনি। তাঁর দাবি, ঠুনকো অভিযোগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কমিটির কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। স্থগিতাদেশ তুলতে মাসোয়ারাও দাবি করা হয়। নতুন ক্যাম্পাস নির্মাণের বড় প্রকল্প কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের এক নেতার পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে পাইয়ে দিতে বলা হয়। এসব করতে পারবেন না, আর মাসোয়ারা দিতে অস্বীকৃতি জানালে কমিটির স্থগিতাদেশ বহাল থাকে। সোমবার (১৬ সেপ্টেম্বর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন রফিকুল ইসলাম।

রাজশাহী বিভাগের একটি জেলার কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশী আখতার হোসেন। বর্তমানে সহসভাপতি। তাঁর জেলা কমিটির মেয়াদ শেষ হলেও এখনো সম্মেলন হয়নি। সম্মেলন নিয়ে তিনি কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগও করেছেন। কিন্তু কোনো কূল-কিনারা পাননি। তিনি জানান, কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা তাঁকে পরামর্শ দেন, ২০ লাখ টাকা দিলে কমিটিতে স্থান পাবে। তিনি দরিদ্র পরিবারের সন্তান, টাকা জোগাড় করতে না পারায় আর যোগাযোগ করেননি।

সম্প্রতি গণমাধ্যমে এসেছে, কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম রাকিবের একটি অডিও ফাঁস হয়েছে, যাতে তিনি বলেন ৪০ লাখ টাকায় নেতা হয়েছি। ছয় মাসে ডাবল হবে। অর্থাৎ সাধারণ সম্পাদক পদে মনোনীত হতে কাউকে এই বিপুল অঙ্কের অর্থ দিয়ে কমিটিতে পদ পেয়েছেন তিনি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ৫৩৭ কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। অভিযোগ রয়েছে, ছাত্রলীগকে ভাগ দেয়া ছাড়া ক্যাম্পাসে কোনো কাজ করা সম্ভব হয় না। এর আগেও টেন্ডার নিয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে মারধরের ঘটনা ঘটেছে।

জানা গেছে, টেকনাফ উপজেলার ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর এক ছেলে উপজেলা কমিটিতে পদ পেতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের এক যুগ্ম সম্পাদককে পাঁচ লাখ টাকা দেন। কিন্তু নেতৃত্বে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে কমিটিতে তাঁর স্থান হয়নি। এরপর তিনি ওই নেতার সঙ্গে বার বার দেখা করেও টাকা ফেরত পাননি।

ছাত্রলীগের সূত্র বলছে, টাকা দিয়ে কমিটির নেতা হয়েছেন—এমন ঘটনা কেবল দু-একটি নয়। ছাত্রলীগের জেলা বা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি গঠনে বিপুল অঙ্কের টাকা লেনদেন অনেকটা অঘোষিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। কারো সঙ্গে চুক্তি করে টাকা নেয়া হয়, টাকা দিলে পদ জোটে আর না দিলে জোটে না। আবার নেতা হওয়ার প্রতিদান হিসেবে কেউ উপঢৌকন বা উপহার পাঠিয়ে দেন নেতার বাসায়। কেউ সরাসরি টাকা না দিলেও গাড়ি কিংবা ফ্ল্যাট উপহার দেয়ার ঘটনাও নতুন নয়।

ছাত্রলীগের সূত্র বলছে, কেন্দ্রীয় নেতাদের হাতে টাকা তুলে দিয়ে নেতা হওয়ায় সংগঠনের নীতি-আদর্শ ধুলোয় লুটিয়ে চাঁদাবাজি বা টেন্ডারবাজিতে ঝোঁকেন ছাত্রলীগের নেতারা। টাকা দিয়ে নেতা নির্বাচিত হলে সেই টাকা তুলতে বাধ্য হয়েই চাঁদাবাজি কিংবা টেন্ডারবাজি করতে হয়। আর টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি বা আধিপত্য বিস্তার নিয়ে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ বা মারামারির ঘটনাও ঘটে। সংঘর্ষে দলীয় কর্মী মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটে।

জেলা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কেউ টাকা দিয়ে সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। আবার কেউবা অন্যান্য পদও নেন টাকার বিনিময়ে। কেউ নেতা হওয়ার পর নিয়মিত মাসোয়ারা দেন। কখনো বা বড় কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের টেন্ডার হলে সেখান থেকে নির্দিষ্ট অঙ্কের ভাগ পান কেন্দ্রীয় নেতারা। জেলার প্রকল্পে ভাগ নেয়ার ক্ষেত্রে নিজ নিজ জেলার কেন্দ্রীয় নেতারা বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। আবার কোনো ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় বা সরকারি দপ্তরে গিয়ে নিজেদের পছন্দের ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানে কাজ পাইয়ে দিয়েও কমিশন নেয়ার অভিযোগও রয়েছে।

সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক হাজার ৪০০ কোটি টাকার বেশি উন্নয়ন প্রকল্পে চাঁদা দাবি করেন ছাত্রলীগের সদ্য অব্যাহতি পাওয়া সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের মাধম্যে প্রকল্পের কাজের ভাগ নেয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু পরে নিজেরাই উপাচার্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজেদের ভাগ বুঝে নিতে চাপ দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. ফারজানা ইসলামের তথ্যানুযায়ী, উন্নয়ন প্রকল্প থেকে ৬ শতাংশ চাঁদা দাবি করা হয়।

ছাত্রলীগের দপ্তর সূত্র জানায়, সারাদেশে জেলা কমিটির মর্যাদার ১১১টি সাংগঠনিক ইউনিট রয়েছে। আর বিদেশে রয়েছে ৩৫টি কমিটি। তবে বেশির ভাগ কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। কারণ গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, ছাত্রলীগের জেলা সমমর্যাদার কমিটির মেয়াদ এক বছর। এ সময়ের মধ্যেই সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠনের বিধান রয়েছে। কিন্তু কোনো কোনো কমিটির মেয়াদ পাঁচ-ছয় বছর পার হলেও কমিটি হয়নি। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে বিদায় নেয়া সোহাগ-নাজমুল কমিটি রংপুর জেলা ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করে। এরপর জেলার সম্মেলন এখনো হয়নি। কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলনও হচ্ছে না পাঁচ বছরের বেশি সময়। মেয়াদোত্তীর্ণ জেলা কমিটির সম্মেলন না হওয়ায় নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি হচ্ছে না বলে মনে করছেন কেন্দ্রীয় নেতারা।

জানা যায়, সোহাগ-জাকির কমিটি সারা দেশে ৯০টির বেশি কমিটি গঠন করেছে। সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করেছে। আর নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অন্য শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু সারা দেশে ৯০ শতাংশ জেলা কমিটি এখন মেয়াদোত্তীর্ণ। কোনো জেলার আংশিক কমিটি হলেও পূর্ণাঙ্গ হয়নি কেন্দ্রীয় অনুমোদনের অভাবে।

সম্মেলন না হওয়ার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলা ছাত্রলীগের নেতারা মেয়াদ শেষ হলেও দায়িত্ব শেষ করতে চান না। ছাত্রত্ব শেষ করে বিবাহিত, সন্তানের জনক হলেও নেতৃত্ব ছাড়ছেন না। টেন্ডারবাজি বা চাঁদাবাজিই এর বড় কারণ বলে মনে করা হয়। জেলায় কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাগ তাঁরা পেয়ে থাকেন। ছাত্রলীগ সূত্র বলছে, দেশের শিল্প-বাণিজ্য অঞ্চল বা জেলার কমিটি গঠনে নিজেদের পছন্দের লোককে কমিটিতে স্থান দিতে বিশাল অঙ্কের টাকা পাঠান শিল্পপতিরা। কোনো ক্ষেত্রে টাকা না চাইলেও পাঠিয়ে দেওয়া হয়। নিতে না চাইলেও বাধ্য হয়ে নিতে হয়। কারণ ব্যবসায়ীরা নিজেদের ব্যবসা নির্বিঘ্নে করতে বা আধিপত্য ধরে রাখতে ওই সব অঞ্চলে ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণ নেন।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সম্পাদক জয়নুল আবেদিন রাসেল বলেন, ‘নেতা হতে হলে টাকা চান কেন্দ্রীয় নেতারা। কোথা থেকে সেই টাকা দেবে? আর টাকা দিয়ে নেতা হওয়ায় বাধ্য হয়ে নানা অপরাধে জড়ান নেতাকর্মীরা। টাকার বিনিময়ে নয়, যোগ্যতার ভিত্তিতে কমিটির নেতা বানানো উচিত। যে টাকা দিয়ে নেতা হবে, সে টাকা তুলতে আগ্রহী হবে। এ ক্ষেত্রে আদর্শের দিক দেখবে না।’

ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় বলেন, ‘আগে কী হয়েছিল, সে বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। আমরা দায়িত্ব নেয়ার পর টাকার বিনিময়ে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি হবে না। যারা যোগ্য, পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয়, সেসব যাচাই-বাছাই করে কমিটি গঠন করা হবে। কমিটি দেয়ার নামে টাকা লেনদেন করার বিষয়ে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেন, ‘ছাত্রলীগকে বিতর্কমুক্ত রাখতে যা যা করা প্রয়োজন সবই করব আমরা। যোগ্যতার ভিত্তিতে নেতা নির্বাচন করা হবে। কোনো ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনের বিষয় আসবেই না। এমনকি যারা অর্থের বিনিময়ে কমিটিতে পদ পাওয়ার চেষ্টা করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি - dainik shiksha ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ অষ্টম পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষায় সরকারকে সহযোগিতা করবে ইউএনএফপিএ - dainik shiksha অষ্টম পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষায় সরকারকে সহযোগিতা করবে ইউএনএফপিএ ইসরায়েলকে বোমা পাঠানো বন্ধ রাখছে যুক্তরাষ্ট্র - dainik shiksha ইসরায়েলকে বোমা পাঠানো বন্ধ রাখছে যুক্তরাষ্ট্র ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে - dainik shiksha ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! - dainik shiksha ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল - dainik shiksha জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.013520002365112