ছাত্রলীগে আইনের শাসন!

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

‘এটা কী প্যান্ট পরেছ? জিন্সের প্যান্ট নেই?’

‘ঠিক আছে ভাই, জিন্সের প্যান্টই পরব।’

‘চুলও তো ঠিক নাই।’

‘চুলের কী সমস্যা ভাই?’

‘এই তেল দেওয়া চুলে চলবে না। চুলের দুটো স্টাইল আছে—একটা আর্মি কাট, মানে সাইড পাতলা। আরেকটা পাংকু স্টাইল। দুটোর একটা হতে হবে।’

‘পাংকুটা থাক ভাই। আর্মিটাই ভালো।’

‘আর গেস্টরুমে বসতে হবে। নেতারা কোথাও গেলে সঙ্গে যেতে হবে।’

‘যাব ভাই। নেতাদের সম্মান করতে হবে। তাঁরা তো সম্মানী মানুষ।’

ছাত্ররাজনীতি কিংবা ছাত্রনেতাদের নিয়ে কোথাও আলোচনা শুরু হলেই ২০-২২ বছর আগের দৃশ্যটা স্মৃতি থেকে হানা দেয়। নিজের চোখের সামনে ঘটা এই ছবিটাই আমার কাছে ছাত্ররাজনীতির সারাংশ। যিনি সাক্ষাৎকারটা নিচ্ছিলেন তিনি উঠতি ছাত্রনেতা। যে দিচ্ছিল সে তাঁর হবু কর্মী এবং এই এরা মিলেই ছাত্ররাজনীতি। শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, ছবি বদলেছে? তাহলে কয়েক মাস আগের একটা অভিজ্ঞতা শোনাই। পরীবাগে বন্ধুর বাসা। রাতের দিকে চায়ের দোকানে বসে আছি। সামনে শখানেক তরুণের ভিড়। গোটা পঞ্চাশেক মোটরসাইকেল। খুব বেশি খোঁজখবর করতে হলো না। জানা গেল, ছাত্রলীগের বড় এক নেতা এখানে থাকেন। তাঁকে প্রটোকল দিতেই এই জমায়েত। এসব উগ্র জমায়েত থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকাই এখন এ দেশের নিয়ম। তবু খুব দেখার দৃশ্য বলে খেয়াল করছিলাম। হঠাৎ একটা উত্তেজনা দেখা গেল জটলায়। নেতা নেমেছেন। ভিড়ের দিকে তাঁর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি ফোন নিয়ে হেঁটে হেঁটে ভিড় ছেড়ে এগোলেন। ঠিক পেছন পেছন এগোল মৌমাছির মতো একটা দল এবং একটা সময় ওরা নেতাকে পেছনে ফেলে সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বন্ধ করে দিল রাস্তার যাতায়াত। পরের কয়েক মিনিটের দৃশ্যটা হলো, চারদিকে নেতাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে জনাপঞ্চাশেক তরুণ। নেতা ফোনে কথা বলছেন। ওদিকে রাস্তা বন্ধ। হলিউড-বলিউডের সিনেমায় দাপুটে ডনদের দেখেছি। মনে হলো এটা বোধ হয় সে রকমই কোনো ছবির শুটিং।

ছবি তাই একটুও বদলায়নি। ২০ বছর আগে যা। এখনো তা। ছাত্রদল যা, ছাত্রলীগও তা। প্রথম ঘটনাটা ছাত্রদলের রাজত্বের আমলের। পরেরটা! বুঝতেই পারছেন। ইদানীংকার ঘটনা। ছাত্রলীগ না হয়ে যায় না।

ছাত্ররাজনীতির গল্প বলতে শুরু করলে দেখি উপচে বেরিয়ে আসে অনেক গল্প। মধ্য নব্বইয়ের দশকে একবার একটা হল দখল করে নিল ছাত্রদলের একটা বিদ্রোহী গ্রুপ। এক রাতের মধ্যেই বদলে গেল সব কিছু। মূল গেট বন্ধ করে পেছনের গেট দিয়ে যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হলো। দোকানগুলো সব স্থানান্তর হলো পেছনে। একেবারে যুদ্ধক্ষেত্রের মতো চারদিকে অস্ত্রধারী নিরাপত্তারক্ষী। এসবও তখনকার ক্যাম্পাসে খুব অবিশ্বাস্য ঘটনা নয়; বরং এই জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়ায় এর ভেতরেও আনন্দ খোঁজার চেষ্টা চলত। এখানে আনন্দ অনুসন্ধানের মতো একটা ব্যাপার ছিল। যিনি এই দখলকাজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁর নাম ‘ডগ অমুক (নামটা উল্লেখ করা বোধ হয় উচিত নয়)।’ নামের আগে ডগ কেন? প্রতিষ্ঠিত গল্পটা হলো, তিনি একবার কাঁটাবনে পশু-পাখির দোকানে গিয়ে দেখলেন টাকা দিয়ে মানুষ কুকুর কিনে নিয়ে যাচ্ছে। তখন নিজে হলের সামনে থেকে একটা কুকুর ধরে নিয়ে সেটা বিক্রির চেষ্টা করলেন। দেশি বেয়াড়া শ্রেণির কুকুর তো আর বিক্রয়যোগ্য নয়। দোকানদার কিনবে না। ভাই গর্জে উঠলেন, ‘কেন নেবে না?’

‘স্যার, এটা দেশি কুকুর। আমরা তো কিনি বিদেশি কুকুর।’

‘কী? শুধু বিদেশি কুকুর...তোমাদের তো দেশপ্রেম নেই। দেশদ্রোহী সব।’

এই গল্প ক্যাম্পাসে সংগত কারণেই সুপারহিট। গল্পে নানা শাখা-প্রশাখা যোগ হলো। আর তিনি হয়ে গেলেন ‘ডগ...’।

সেই ডগ ভাইয়ের সমাপ্তিটা অবশ্য অত্যন্ত ট্র্যাজিক। দিন-রাত জেগে হল পাহারা দিতেন। কিছু দিনে পরিস্থিতি কিছুটা সংহত হয়েছে মনে করে তিনি একদিন গেলেন নিউ মার্কেটে। সেই ফাঁকেই বিরোধী পক্ষ সাঁড়াশি আক্রমণে হল দখল করে নেয়। তিনি ফিরে দেখেন হল বেদখল। নিজে আর ঢুকতে পারছেন না। হলের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর যে কী কান্না। একজন শিক্ষকও ছিলেন, হাউস টিউটরই হবেন, ডগ ভাই তাঁকে উদ্দেশ করে আর্তনাদ করলেন, ‘স্যার, আমার হল... আমার হল...।’ একেবারে আশির দশকের আলমগীর-শাবানার ছবির মতো ট্র্যাজেডি দৃশ্য।

আন্ডারওয়ার্ল্ডের ছবির দৃশ্য আছে, ট্র্যাজেডি আছে। কমেডি! তা-ও আছে। একবার একজন ব্যবসায়ীকে ধরে আনা হলো। চাঁদা চাওয়া হয়েছিল। দেননি। গেস্টরুমে অনেক হুমকি-ধমকির পরও ভদ্রলোককে নত করাতে না পেরে শেষে দোতলায় নিয়ে তাঁকে ওখান থেকে ফেলে দেওয়া হলো। যারা ফেলেছিল ওদের ধারণা ছিল পড়ে গিয়ে হাত-পা ভেঙে এবার ভদ্রলোক রাজি হয়ে যাবেন। কিন্তু যে ঘটনা ঘটল এর জন্য বোধ হয় কেউ প্রস্তুত ছিল না। পতিত হয়েও মানুষটির তেমন কোনো শারীরিক ক্ষতি হলো না। পায়ে সামান্য একটু চোট লেগেছিল বোধ হয়। তাই নিয়েই দিলেন দৌড়। দোতলা থেকে নেমে তাঁকে ধাওয়া করে ধরা হয়তো সম্ভব ছিল; কিন্তু ওরা মানুষটার প্রাণশক্তিতে এত বিস্মিত হয়েছিল যে তাড়া করার কথা ভুলেই গিয়েছিল। ফলে সেটা হয়ে গেল হাসির গল্প। কমেডি দৃশ্য। আর সব মিলিয়ে ক্যাম্পাস-হল-ছাত্ররাজনীতি আসলে সিনেমার মতোই অবিশ্বাস্য। কিন্তু অজানা বোধ হয় নয়।

শোভন-রাব্বানীতে চলে আসি। প্রথম যখন ওদের নাম ঘোষিত হয় সভাপতি-সম্পাদক হিসেবে, একটু আনন্দিতই হয়েছিলাম। অনেক বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে এলেও নিজের বিভাগের প্রতি একটা মায়া থাকেই। দুজনই আইন বিভাগের জেনে তাই একটু গর্বও হয়েছিল। সঙ্গে যখন দেখলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি-সম্পাদকও আমাদের বিভাগের, তখন অবশ্য বিস্মিত! চারটা গুরুত্বপূর্ণ পদ একই বিভাগের! ইতিহাসেই বোধ হয় প্রথম। কারো সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। এজিএস সাদ্দামের সঙ্গে একবার একটু কথা হয়েছে। কথায়-ব্যক্তিত্বে যথেষ্টই মুগ্ধ হয়েছি। এমনকি শোভন যেভাবে ডাকসু ভিপি পদে হারের পর নিজেকে এবং দলকে সামাল দিয়েছিল, সেটাও দারুণ লেগেছিল। কিন্তু একই সঙ্গে পত্র-পত্রিকায় দেখলাম সেই পুরনো সব অভিযোগ। অতীতে যেভাবে চলত, যে প্রক্রিয়া, যে ক্ষমতার চর্চা, এখনো তাই। এবং তারপর ডাকসু নির্বাচনে বিরোধী পক্ষকে নিগ্রহ করা মিলিয়ে নতুন কিছুর আশা মিইয়ে গিয়েছিল। সেই নতুন ঘটনা শেষ পর্যন্ত ঘটল, সেটা এমনই বিপরীতমুখী ও অবিশ্বাস্য যে ওরা অপসারিত হওয়ার আগেও বিশ্বাস হচ্ছিল না। কিন্তু কেউ যদি মনে করেন শোভন-রাব্বানীরই পুরো দায়, তাহলে তিনিও একচোখা। শুরুর দিকের যে গল্পগুলো বলছিলাম সেগুলো তো এটা বোঝাতেই যে ছাত্ররাজনীতি বিষাক্ত হয়ে গেছে বহু আগেই। শোভনদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, এমন অভিযোগ কার বিরুদ্ধে ছিল না? প্রমাণিত হয়নি? চাইলে সবই প্রমাণ করা যায়। যেত। যখন একজন উপাচার্যের ছাত্রদের সঙ্গে ভাগ-বাটোয়ারায় জড়িয়ে পড়ার খবর প্রকাশিত হয়, যখন একজন ভিসি ওদের নির্বাচন জেতাতে নিজেকে বিসর্জন দিয়ে কর্মীর মতো নেমে পড়েন, তখন বুঝতে হবে শোভন-রাব্বানীর পথচ্যুতিতে ওরাও জড়িত। নিজেদের চেয়ার ধরে রাখতে ওদের সর্বখেকো ছাত্রনেতা তৈরি করতে হয়। দলের শীর্ষ নেতাদের কারো কারো আবার শক্তি বজায় রাখতে ছাত্রনেতাদের লাগে। ওপরের মানুষদের এভাবে নিচু হতে দেখে ওরা আকাশে চড়ে বসে। তারপর ভাগ্যের ফেরে ওদের মতো কেউ কেউ আকাশ থেকে খসে পড়ে। তাতে আকাশ পরিষ্কার হবে না। পরিষ্কার করতে হলে যাদের হাতে ওদের নাটাই, তাদেরই বদলাতে হবে। না হলে বদলানো মুখোশে তৈরি হবে একই রকম মুখ। ওদের গঠন প্রণালী, লালন-পালন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন না এলে শোভন-রাব্বানী যা, জয়-লেখকরাও তাই। সরকারে থাকলে অপকর্ম করে বোঝা। বিরোধী দলে গেলে পালিয়ে গিয়ে হাওয়া। গেস্টরুম-গণরুমের নির্যাতন, জোর করে মিছিলে নেওয়া, ভাইদের প্রটোকলে সাধারণ ছাত্রদের বাধ্য করা—এগুলো বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিন। ছাত্ররাজনীতি আর এর নেতারা শুদ্ধ হতে বাধ্য।

ওরা যখন দায়িত্ব পায়, তখন একটা লেখা লিখব ভেবেছিলাম। শিরোনাম হবে ‘ছাত্রলীগে আইনের শাসন’। এই লেখারও শিরোনাম তাই। বাস্তবতা বদলে নতুন যে বাস্তবতা, তার সঙ্গেও অদ্ভুতভাবে ‘আইনের শাসন’ মিলে যায়।

কিন্তু এখানে দুঃখের বিষয় এটাই যে আইনের সম্ভাবনাময় ছাত্রদের বেআইনি কাজের শাস্তি দিয়েই ছাত্রলীগে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা শুরু হলো।

মোস্তফা মামুন : সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস - dainik shiksha কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি - dainik shiksha বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় - dainik shiksha ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব - dainik shiksha একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029821395874023