সকাল থেকেই জমজমাট তিতুমীর কলেজ প্রাঙ্গণ। সকাল ১১টার দিকে কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. রিপন মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক জুয়েল মোড়লের নেতৃত্বে শখানেক ছাত্রের একটি দল মূল ফটক থেকে ক্যাম্পাসে ঢুকল। কিছুক্ষণ পর দলটিকে ফিরে আসতে দেখা গেল, তখন অবশ্য দলে যোগ হয়েছে আরো শ-দুয়েক শিক্ষার্থী। আধাঘণ্টা পর দলটিকে আবার একইভাবে ক্যাম্পাসে ঢুকে কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। রোববার (১৯ মে ) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন শরীফুল আলম সুমন ও তানজিদ বসুনিয়া।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত সোমবার ছাত্রলীগের এমন দল বেঁধে কলেজের মূল ফটক থেকে ক্যাম্পাসের ভেতরে ঢোকা আর বেরিয়ে আসাকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বর্ণনা করল শোডাউন বা শক্তি প্রদর্শন হিসেবে। তারা বলছিল, এমন চিত্র প্রতিদিনের। ছাত্রলীগ ছাড়া আর কোনো ছাত্র সংগঠনের কর্মকাণ্ড নেই সরকারি এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে আরো জানা গেল, প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত কয়েকবার শোডাউন করে ছাত্রলীগ। যারা হলে থাকে তাদের এই শোডাউনে নিয়মিতই উপস্থিত থাকতে হয়। এ ছাড়া সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনেকেই এই মিছিলে থাকে।
জানা যায়, তিতুমীর কলেজে একসময় ছাত্রসংসদ ছিল। কিন্তু ২০ বছর ধরে এই সংসদের নির্বাচনও নেই, কার্যক্রমও নেই। তবে ছাত্রসংসদ ভবন রয়েছে, সেখানে এখন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বসে। কলেজের ছাত্রসংসদের প্রথম সহসভাপতি (ভিপি) ছিলেন সিরাজউদ্দৌলা, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ছিলেন মফিজুল ইসলাম। সর্বশেষ ১৯৯৬-৯৭ সালে নির্বাচিত সংসদের ভিপি ও জিএস নির্বাচিত হন যথাক্রমে আক্কাছুর রহমান আঁখি ও আনোয়ারুল হক আনোয়ার।
টানা তিন মেয়াদে ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো সরকারি তিতুমীর কলেজেও ছাত্রসংগঠনগুলোর সহাবস্থান নেই। ছাত্রলীগই এক মাত্র সংগঠন, যারা সক্রিয়। ছাত্রদলের কমিটি থাকলেও কোনো তৎপরতা নেই। অন্য আর কোনো ছাত্রসংগঠনের কমিটি আছে বলে জানা যায়নি।
নাম প্রকাশ না করে একজন শিক্ষার্থী বলেন, গত বছরের ১১ এপ্রিল ৩৬ সদস্যের কলেজ শাখা ছাত্রলীগের কমিটি হয়। এক বছরের মেয়াদ পূর্ণ হয়ে যাওয়া সেই কমিটির পাঁচজন বাদে বাকিরা সবাই নিষ্ক্রিয়। তবে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সক্রিয় আছেন। তবে তাঁরা যদি নিয়মিত পড়ালেখা করতেন তাহলে অনেক আগেই পাস করে বের হয়ে যেতেন।’
জানা যায়, ছাত্রলীগের মধ্যেও কোন্দল-গ্রুপিং রয়েছে। গত বছরের মে মাসে কলেজে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে সোহেল ও রানা নামের দুজন কর্মী আহত হন। তাঁদের চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে জখম করা হয়। মূলত কলেজের নতুন কমিটি হওয়ার পর পদবঞ্চিতদের সঙ্গে এই মারামারির ঘটনা ঘটে। অবশ্য এখন আর সংঘাত-সংঘর্ষ হয় না।
অভিযোগ রয়েছে, ছাত্রলীগ কলেজের তিন হল নিয়ন্ত্রণ করে। হলে থাকতে হলে সংগঠনটির নেতাদের খুশি রাখতে হয়। হলে আসন পেতেও তাঁদের খুশি করতে হয়। হলের একটি কক্ষে চারজনের আবাসিক সুবিধা থাকলেও থাকে ১২ থেকে ১৬ জন। এ ছাড়া গণরুমে ৪০ থেকে ৫০ জন শিক্ষার্থীও থাকে। অবস্থা এমন যে কলেজ কর্তৃপক্ষ কোনো কক্ষে চারজনকে আসন দিলে আরো আটজন তুলে দেয় ছাত্রলীগ। এতে আর্থিক লেনদেনও হয়। এ ছাড়া মহাখালী এলাকার বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকেও তিতুমীর কলেজের ছাত্রলীগের নেতাদের খুশি রাখতে হয়। তা না হলে ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়ে।
অভিযোগ আছে, কলেজ ক্যান্টিন চালু না হওয়ার পেছনেও রয়েছে ছাত্রলীগের দাপট। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা খেয়ে অনেক সময়ই টাকা না দিয়ে চলে যায়। ৫০০ টাকা বিল হলে দেয় ১০০ টাকা। সে কারণে যারা ক্যান্টিন পরিচালনার জন্য আসে কয়েক মাস পর তারা চলে যায়। এরপর আর কেউ ক্যান্টিন পরিচালনায় আগ্রহ দেখায় না। সে জন্য দীর্ঘদিন ধরে কলেজ ক্যাম্পাসে কোনো ক্যান্টিন নেই।
কলেজের নানা সমস্যা নিয়ে কথা হয় ছাত্রলীগের সভাপতি মো. রিপন মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী ও উপমন্ত্রী আমাদের কলেজে এসেছিলেন। আমরা তাঁদের সব সমস্যার কথা বলেছি। তাঁরা সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন।’
হলে আসন পাওয়া এবং থাকতে হলে ছাত্রলীগের খবরদারি মানতে হয়—এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে রিপন বলেন, ‘আমি আজ যে অবস্থানে এসেছি, সেখানে আসতেও কারো না কারো সহায়তা লেগেছে। এখন আমরাও অন্যদের সহায়তা করি। ছাত্রাবাসে সিটের সংখ্যা খুবই কম। হলে উঠতে ছাত্রলীগের কাউকে কিছু দেওয়া লাগে না। আর যারা হলে আছে তাদের কাউকে মিছিলে আসার জন্য জোরও করি না। কেউ যদি মন থেকে ছাত্রলীগ করে সে কর্মসূচিতে আসে।’
কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. আশরাফ হোসেন বলেন, ‘ছাত্রলীগের বর্তমান যে কমিটি রয়েছে তারা খুবই সহযোগিতা করে। তারা নিজেরা কোনো কোন্দলের মধ্যে নেই। আমরাও শিক্ষার্থীদের জঙ্গিবাদসহ নানা সমস্যা থেকে মুক্ত রাখতে সহশিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি। সাংস্কৃতিক চর্চা, খেলাধুলা নিয়মিত হয়। আর এ কাজে ছাত্রলীগ কলেজ কর্তৃপক্ষকে সর্বোত সহায়তা করে।’