ছাত্র ও ছাত্রীদের এগিয়ে নিতে হবে সমান তালে

মো. রহমত উল্লাহ্ |
গত ২৮ জুলাই ২০২৩, শুক্রবার, গণভবনে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা ২০২৩ এর ফলাফল হস্তান্তর অনুষ্ঠানে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে তাগিদ অনুভব করেছেন। তিনি বলেছেন, মেয়েদের তুলনায় ‘কেনো ছেলেদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে তা খতিয়ে দেখা দরকার’। ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ, পাসের হার, জিপিএ-৫ অর্জন ইত্যাদি ক্ষেত্রে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা এগিয়ে আছে। 
 
এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা ২০২৩ এ ছেলে-মেয়েদের তুলনামূলক ফলাফল:
 
বিষয়                                       ছাত্রী                                                         ছাত্র
অংশগ্রহণ                            ১০,৩১,৬৪৭                                             ১০,০৯,৮০৩
উত্তীর্ণ                                   ৮,৪৪,০০০                                              ৭,৯৬,৪০৪
পাসের হার                            ৮১.৮৮                                                     ৭৮.৮৭
জিপিএ-৫                              ৯৮,৬১৪                                                 ৮৪,৯৬৪
 
তুলনামূলক ফলাফলে দেখা যাচ্ছে যে, শুধু অংশগ্রহণের সংখ্যাগত দিক থেকে নয় কৃতিত্ব অর্জনগত দিক থেকেও ছেলেদের তুলনায় ছাত্রীরা এগিয়ে রয়েছে। এটি অবশ্যই আমাদের জন্য কোনো দুঃসংবাদ নয়। মেয়েদের এগিয়ে আনার জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা করে আসছি। উৎসাহ উদ্দীপনা দেয়া, উপবৃত্তি দেয়া, অভিভাবকদের সচেতন করা, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করা, শিশুশ্রম রোধ করা ইত্যাদি কার্যক্রম চলমান রেখেছি। ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রীদের উপবৃত্তি দেয়া শুরু করা হয়। ২০০২ সালে তা উন্নীত করা হয় উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে এসে দরিদ্র পরিবারের ছেলে শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির আওতায় আনা হয়েছে। আমাদের কন্যা শিশুরা এই কার্যক্রম গুলোর অধিক সুফল অর্জন করেছে তাই তাদেরকে ধন্যবাদ।
 
মেয়ে শিক্ষার্থীদের ড্রপ আউটের মাত্রা কমেছে এবং কৃতিত্বের মাত্রা বেড়েছে। শুধু মাধ্যমিক পর্যায়ে নয়; প্রাথমিক, উচ্চমাধ্যমিক, এমনকি উচ্চ শিক্ষাতেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে মেয়েরা এখন অনেক শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। চলতি ২০২৩-এ দেশের সেরা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস কোর্সে ১২০ জন মেয়ে ও ১১০ জন ছেলে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করেছে। অবশ্যই অব্যাহত রাখতে হবে মেয়েদের এই অগ্রযাত্রা। সেইসঙ্গে বৃদ্ধি করতে হবে ছেলেদের সঠিক পথে এগিয়ে চলার গতি। দ্রুত চিহ্নিত করতে হবে ছেলেদের পিছিয়ে পড়ার কারণ। এখনই নিতে হবে সমাধানের পদক্ষেপ। তা না হলে কিছুকাল পরেই উল্টোভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে আমাদের সমাজ। তৈরি হবে আরো অনেক রকম ভয়াবহ সমস্যা! সেগুলো ভিন্ন আঙ্গিকে বিস্তর আলোচনার বিষয়। হয়তো সেটি অনুভব করেই আমাদের দূরদৃষ্টি সম্পন্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খতিয়ে দেখতে বলেছেন ছেলেদের পিছিয়ে পড়ার কারণ।
 
ভেবে দেখতে হবে, কন্যা শিশুদের প্রতি অধিক মনোযোগী হতে গিয়ে পুত্র শিশুদের প্রতি আমরা কম মনোযোগী হয়ে পড়েছি কি না। মেয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সঙ্গে ছেলে শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির আওতায় না আনার কারণে পুত্র শিশুরা অধিক হারে শ্রমে নিয়োজিত হয়ে পড়ছে কি না! মাত্র কিছুকাল আগেও আমাদের পুত্র-কন্যা উভয়ই শিশুশ্রমে নিয়োজিত ছিলো ব্যাপক হারে। বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে কাজের জন্য কন্যা শিশুদের এখন আর দেখা যায় না আগের মতো। এটি অবশ্যই একটি শুভ লক্ষণ। অথচ হোটেলে, গ্যারেজে, টেম্পুতে, নৌকাতে, কারখানাতে, হাটবাজারে, ক্ষেতখামারে কায়িক পরিশ্রম করতে দেখা যায় অনেক পুত্র শিশুকে। এটি ছেলে শিক্ষার্থীদের ড্রপ আউটের প্রধান কারণ। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখা এবং দ্রুত সমাধানের ব্যবস্থা নেয়া অত্যাবশ্যক। তদুপরি খতিয়ে দেখা অবশ্যক ছেলেদের পিছিয়ে পড়ার ও ড্রপ আউট হবার অন্যান্য কারণ। 
 
সাধারণত কন্যা শিশুদের নিয়ন্ত্রণ সহজ বিধায় পুত্র শিশুদের নিয়ন্ত্রণে হাল ছেড়ে দিচ্ছি কিনা তাও ভেবে দেখতে হবে আমাদের। প্রায়ই দেখা যায় যে, মেয়ে শিক্ষার্থীরা যখন পড়তে যান তখন একদল ছেলে মোড়ে মোড়ে আড্ডা মারেন এবং মেয়েকে ইভটিজিং করেন! এমনকি রাতেও মেয়েরা যখন ঘরে লেখাপড়া করেন, তখন একদল ছেলে বাইরে ঘুরাঘুরি করেন। একদল ছেলে বাইক নিয়ে বেপরোয়া গতিতে ছুটে বেড়ান, দুর্ঘটনা ঘটান, আহত হন, নিহত হন! বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে অনেক ছেলেরা দলাদলি করে, মারামারি করে, চাঁদাবাজি করে, মোবাইল ফোনে গেম খেলে, নেশা করে…! প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জেও এমন চিত্র দেখা যায়। এমন শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হলেও থাকে নিয়ন্ত্রণহীন। প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা মেনে চলা, নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত থাকা, শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা, কোনো কিছুই করে না সঠিকভাবে। ফলে তারা লেখাপড়া থেকে ছিটকে পড়ে অথবা পিছিয়ে পড়ে। আর আমরা অনেকেই হাল ছেড়ে দিয়ে অসহায়ের মতো বা দায়িত্বহীনের মতো বসে থাকি! এটি মারাত্মক অশুভ লক্ষণ! এভাবে চলতে থাকলে চরম অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে আমাদের ভবিষ্যৎ।
 
এমন এক সময় ছিলো যখন এলাকার সকল ছেলেদের শাসন-বারণ করার অধিকার ছিলো সকল বড়দের। স্বার্থহীন আদর-স্নেহ দিয়ে অর্জন করে সেই অধিকার প্রয়োগ করতো বড়রা; আর নির্দ্বিধায় তা মেনে নিতেন ছোটরা। একজনের সন্তানের কল্যাণ চিন্তায় সক্রিয় থাকতো শতজন অভিভাবক। বড়দের নেতৃত্বে ছোটরা করতো খেলাধুলা, শিক্ষামূলক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাজ। আমি নিজেও কর্মী হয়ে অংশ নিয়েছি এবং পরে নেতৃত্ব দিয়েছি এমন অনেক কাজে। আমাদের প্রিয় শিক্ষকরাও অংশ নিতেন আমাদের সঙ্গে। তখন শিশুরা বেড়ে উঠতের অন্যের কল্যাণে নিজেকে নিবেদিত করার মানসিকতা নিয়ে। কেউ বিপথে গেলে সবাই মিলে তাকে আনা হতো সুপথে। তেমন মানসিকতা নিয়ে আবার এগিয়ে আসতে হবে সবার। উল্লিখিত কারণগুলোর পাশাপাশি খুঁজে দেখতে হবে ছেলেদের ড্রপ আউট হবার ও পিছিয়ে পড়ার অন্যান্য কারণ। তবে মনে রাখতে হবে, এখন পাল্টে গেছে পরিবেশ ও পরিস্থিতি। সেই সঙ্গে পাল্টে গেছে ডিজিটাল যুগের ছেলেমেয়েদের নিয়ন্ত্রণ কৌশল। তাই অভিভাবক ও শিক্ষকদের অবশ্যই শিখতে হবে স্মার্ট প্যারেন্টিং। ছেলে-মেয়েদের লালন-পালন তথা শিক্ষাদানে ঘরে-বাইরে থাকতে হবে আরো অনেক বেশি সতর্ক ও সক্রিয়। অভিভাবক, শিক্ষক, প্রশাসক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ মিলে প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে কার্যকর পরিকল্পনা। উভয়কেই এগিয়ে নিতে হবে সমান তালে। রাখতে হবে সঠিক পথে। 
 
লেখক : মো. রহমত উল্লাহ্, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ এবং অধ্যক্ষ-কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা 

 

 
 

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ডিআইএর নতুন পরিচালক অধ্যাপক আবু কাইয়ুম - dainik shiksha ডিআইএর নতুন পরিচালক অধ্যাপক আবু কাইয়ুম জাতীয়করণসহ তিন দাবিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরিদের অবস্থান - dainik shiksha জাতীয়করণসহ তিন দাবিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরিদের অবস্থান এমপিওর দাবিতে প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় শিক্ষকদের পদযাত্রা - dainik shiksha এমপিওর দাবিতে প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় শিক্ষকদের পদযাত্রা কারিগরিতে ৪০ শতাংশ নম্বরে উপবৃত্তি - dainik shiksha কারিগরিতে ৪০ শতাংশ নম্বরে উপবৃত্তি কাউকে হেনস্তা না করার আহ্বান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের - dainik shiksha কাউকে হেনস্তা না করার আহ্বান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের আটকের পর বিজিবিকে যে প্রলোভন দেখান বিচারপতি মানিক - dainik shiksha আটকের পর বিজিবিকে যে প্রলোভন দেখান বিচারপতি মানিক নয় বছরের শিক্ষিকাকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হতে বললেন প্রধান শিক্ষক - dainik shiksha নয় বছরের শিক্ষিকাকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হতে বললেন প্রধান শিক্ষক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0023810863494873