ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের বোঝাপড়া

ড. ফাদার হেমন্ত পিউস রোজারি |

বলা হয়ে থাকে জ্ঞানরাজ্যে বিদ্যা দানসাপেক্ষ। মনোরাজ্যে যেহেতু জোর জবরদস্তির কোনো সুযোগ নেই তাই একজন শিক্ষক ছাত্রকে কতটুকু বিদ্যা দান করবেন, সেটা অনেকাংশে তার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। অপরদিকে একজন শিক্ষার্থীকেও বিদ্যার্জনের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে হয়। অর্থাত্ বিদ্যাদান ও বিদ্যার্জন এমন একটি মানসিক প্রক্রিয়া, যেখানে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে এক ধরনের পারস্পরিক বোঝাপড়ার সম্পর্ক ক্রিয়াশীল থাকে। এবং ছাত্র-শিক্ষকের এই পারস্পরিক বোঝাপড়ার মিথস্ক্রিয়ার মধ্যদিয়েই শিক্ষার্থীর বিদ্যার্জন পূর্ণতা লাভ করে। কিন্তু আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় উচ্চশিক্ষার

কেন্দ্রস্থল, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়-গুলোতে এই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ওপর যত্সামান্য গুরুত্বারোপ করা হলেও মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে তার চর্চা একেবারে নেই বললেই চলে। এজন্য দেখা যায় আমাদের সন্তানেরা শিখছে, কিন্তু শিক্ষাটা যেন

পূর্ণতা পাচ্ছে না। পাঠের সঙ্গে, সুশিক্ষার প্রধান আদর্শ ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে তাদের তেমন একটা সংযোগ স্থাপন হচ্ছে না। তাই বলছি পাঠের সঙ্গে, সুশিক্ষার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের যথোপযুক্ত সংযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের বিষয়টি আমাদের গুরুত্বের সঙ্গে উপলব্ধি করার প্রয়োজন রয়েছে।

পাঠদানের ক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকাকে দার্শনিক সক্রেটিস ধাত্রীর সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, ধাত্রী যেমন গর্ভবতী মাকে সন্তান প্রসব করতে সহায়তা করে ঠিক তেমনি শিক্ষার্থীকে একজন শিক্ষক পঠন-পাঠনে সহায়তা করে। অর্থাত্ একজন শিক্ষার্থী নিজেই শিক্ষার্জন করবে, শিক্ষক সেই শিক্ষার্জনে তাকে সহায়তা করবে মাত্র। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক পাঠদানের পাশাপাশি তার কথাবার্তা, চাল-চলন, যুক্তিপূর্ণ বিচার-বিশ্লেষণ ও নৈতিক গুণাবলীর দ্বারা এমন একটি আদর্শ স্থাপন করবেন, যা শিক্ষার্থীদের সামনে অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। এ বিষয়ে মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, ‘একজন শিক্ষকের জীবন শিক্ষার্থীদের সামনে খোলা বইয়ের মতো।’ অর্থাত্ শিক্ষার্থীরা বই পড়ে যেমন জ্ঞানার্জন করে, তেমনি একজন আদর্শ শিক্ষকের জীবন দৃষ্টান্তের দিকে তাকিয়ে জীবনের জন্য শিক্ষা লাভ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে একজন শিক্ষক কেমন মূল্যবোধের মানুষ, তিনি ব্যক্তিগত জীবনে কী ধরনের নৈতিক আদর্শ পোষণ করেন, তার বিচার-বিশ্লেষণ, যুক্তি, বুদ্ধি কিংবা চিন্তার গভীরতার বিষয়গুলো শিক্ষার্থীরা এক ধরনের সহজাত প্রবণতার মধ্যদিয়ে অনুকরণ বা গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যে শিক্ষকের জীবনাচরণকে ব্যক্তিগত জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করছে বা করবে তার সঙ্গে যদি তাদের আত্মিক সম্পর্ক গড়ে না ওঠে বা এক ধরনের বোঝাপড়ার সম্পর্ক না থাকে, তাহলে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সেই শিক্ষকের উন্নত নৈতিক আদর্শকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে এক ধরনের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার সম্পর্ক থাকলে অনেক সময় শিক্ষার্থীরা তাদের মনের অজান্তেই শিক্ষকের উন্নত নৈতিক আদর্শকে ব্যক্তিগত জীবনে গ্রহণ করে ব্যক্তিত্বের উন্মেষ ঘটানোর চেষ্টা করে। শুধু তাই নয় পঠন-পাঠনের সঙ্গেও তাদের সংযোগ বা আগ্রহ তৈরি হয়। অতএব দেখা যায়, ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে সুসম্পর্ক শিক্ষার্থীর পঠন-পাঠন, নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ ও ব্যক্তিত্বের পূর্ণতা সাধনের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপনের প্রধান দায়িত্বটি শিক্ষকদেরই নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের প্রতি তাদের আরো বেশি আন্তরিক হতে হবে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের পারস্পরিক বোঝাপড়ার সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। পিতা-মাতার মতো তাদের প্রতি স্নেহশীল হয়ে পাঠদানে আরো যত্নবান হতে হবে। শিক্ষকরা শুধু তাদের কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন থাকবেন না, নৈতিকতা ও মানবিক গুণাবলী দ্বারা এমন এক উন্নত আদর্শ চরিত্রের অধিকারী হবেন, যাতে শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি অনুকরণীয় হতে পারেন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেও কিছু দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। অর্থাত্ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে পাঠ্যসূচির বাইরে এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিস—যেমন বিভিন্ন শিক্ষাসফরের আয়োজন, খেলাধুলা ও বিভিন্ন ক্লাব প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে ছাত্রদের শিক্ষকের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। একইসঙ্গে অভিভাবক, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকেও উপলব্ধি করতে হবে যে, ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে একটা সুসম্পর্ক স্থাপন করতে পারলে পঠন-পাঠনে শিক্ষার্থীরা যেমন আগ্রহী হয়ে উঠবে, তেমনি শিক্ষকরাও তাদের মনোগত সৃজনশীলতা নিয়ে পাঠদানকে আরো ফলপ্রসূ করে তুলতে পারবেন। একইসঙ্গে ব্যক্তির উন্নত চরিত্রগঠন, দেশ ও সমাজের কল্যাণার্থে শিক্ষার যে মূল উদ্দেশ্য, তা ফলপ্রসূ হবে।

লেখক : অধ্যক্ষ, নটরডেম কলেজ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ - dainik shiksha ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত - dainik shiksha টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.004317045211792