ছুটি না বাড়িয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দ্রুত খুলে দেয়া উচিত

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

একটানা দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কোমলমতি শিশুরা স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ছন্দ হারিয়ে ফেলেছে। বিশেষ করে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা গৃহবন্দি হয়ে বিষণ্ণতায় ভুগছে। দেরি না করে স্কুল খুলে দিলে তাদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসবে সে সঙ্গে শিক্ষা কার্যক্রমে জটিলতাও নিরসন হবে।

শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার বাইরে তাদের মানসিকতা ও সু-মানবিকতার প্রয়োজনে অন্যান্য বিশেষ যোগ্যতা, যেমন- খেলাধুলা, সংগীত, আবৃত্তি, বিতর্ক, বক্তৃতা, চিত্রাঙ্কনসহ বিভিন্ন এক্সটা অ্যাক্টিভিটিজে ব্যস্ত রাখা খুবই জরুরি। করোনাকালে লম্বা সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের শারীরিক-মানসিক বিকাশ ব্যাহত হওয়া ছাড়াও অবসাদ-বিষণœতা বেড়েছে, বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে রাগী কিংবা জেদি হয়ে ওঠার মতো ঘটনা ঘটছে। এছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ে অসংখ্য শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। শ্রেণীকক্ষের বাইরে থাকায় পড়াশোনায় অমনোযোগিতা বেড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত আসা-যাওয়া করলে রুটিন মেনে চলতে হয়। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের ডিসিপ্লিন বা শৃঙ্খলাবোধ তৈরি হয়। গত দেড় বছরে এই শৃঙ্খলা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। মঙ্গলবার (৩১ আগস্ট) দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক উপ সম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।   

উপ সম্পাদকীয়তে আরও জানা যায় নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলে কভিড সংক্রমণ বাড়বে। মূলত কর্তৃপক্ষের অদুরদর্ষিতার খেসারত দিচ্ছে লাখ লাখ শিক্ষার্থী। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা কি ঘরে বসে আছে? তারা কিন্তু বাইরে যাচ্ছে, ঘুরছে-ফিরছে। উপরন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেক শিক্ষার্থী মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে। কারো শিক্ষা জীবন হুমকিতে পড়েছে, অনেকেই মাদকাসক্ত বা বিপথগামী হচ্ছে। করোনা ক্রান্তিকালে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার আজকের শিশু থেকে তরুণ শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য ও জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিতের অদুরদর্শী পরিকল্পনায় সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রায় দেড় বছর ধরে টানা বন্ধ থাকায় শুধু শিক্ষা খাতই বিপর্যস্ত হয়নি, চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে শিক্ষার্থীদের মানসিকতায়।

শিক্ষার্থীদের সুরক্ষার কথা বিবেচনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হলেও শিক্ষার্থীরা শপিংয়ে যায় না? আড্ডা দেয় না? বেড়াতে যায় না? নানাবাড়ি, দাদাবাড়ি, বাজারে, খেলার মাঠে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গেলে করোনার ঝুঁকি নেই? করোনা কি শুধুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে? এমতাবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখাটা কতটা যৌক্তিক তা এখনই ভাবতে হবে।

আমাদের দেশে শিক্ষার্থীর তুলনায় শ্রেণীকক্ষের স্বল্পতা রয়েছে। গাদাগাদি করে শ্রেণীকক্ষে পাঠ নিতে হয়। এটা বিবেচনায় নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে, শ্রেণীকক্ষে দু’জনের মাঝখানে একটি করে স্পেস রেখে, ভাগ ভাগ করে ক্লাস নেয়ার কথা আমরা আগেও ভাবা যেত। যাতে করে কেউ কথা বললেও যেন অন্যের শরীরে এয়ার পার্টিকেল পৌঁছাতে না পারে। সবাই হয়তো সপ্তাহে ছয় দিনই ক্লাস করার সুযোগ পাবে না। একেবারে ক্লাসে না গিয়ে শিফটভিত্তিক সপ্তাহে দুই/তিন দিন ক্লাস করা যেতো না? এক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠদান, কভিড সংক্রমণ পর্যবেক্ষণ ও তা মোকাবিলায় করণীয় ঠিক করতে অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ করা যেত। এছাড়া শিক্ষার্থীদের মানসিক সাপোর্টের জন্য মানসিক কাউন্সিলিং বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। এভাবে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, গবেষকরা একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারতেন। 

কভিড-১৯ বর্তমান সময়ের একটি বড় যুদ্ধ। যুদ্ধের ক্ষতি এক সময় পুষিয়ে নেয়া সম্ভব; কিন্তু শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া মোটেই সহজ নয়। আমাদের দেশে যা হয়েছে, একথায় বলতে গেলে, তা অসম্ভব। করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ কি শেষ হবে? তা কবে? যদি হয়, তারপর বিপর্যস্ত শিক্ষায় কীভাবে আবার সবাই ফিরবে? আর যদি না হয়? করোনার পর আবার অন্য কোনো মহামারি সঙ্গে অব্যাহতভাবে লড়াই করেই মানব জাতীকে টিকতে হয়; তাহলে আমরা কী করব? আমরা কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখব না? আমরা মনে করি, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের কোভিড-১৯-এর সঙ্গে মানিয়ে নিয়েই চলতে হবে। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে সংক্রমণের হার ৫ ভাগ নামিয়ে নিয়ে আসার স্বপ্ন দেখা বাস্তবতাবিবর্জিত। এমতাবস্থায় যে কোনো মূল্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার কোন বিকল্প নেই। এই যুদ্ধাবস্থায় শিল্পকারখানা চালু আছে। যোগাযোগও নানা উপায়ে চালু আছে। হাটবাজার, মার্কেট তো আছেই। সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব চলছে। বন্ধ শুধু শিক্ষা কার্যক্রম। অভিভাবকরা বাইরে যাচ্ছেন। ভিড়ের মধ্যে বহুবিধ স্পর্শ নিচ্ছেন, বাড়িতে এসে সন্তানদের স্পর্শ করছেন। লকডাউন উঠে যাওয়ার পর অনেক অভিভাবককে দেখা যাচ্ছে বাজারঘাটে পর্যন্ত শিশুদের নিয়ে যাচ্ছেন, রেস্টুরেন্টে খেতে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে পর্যটনকেন্দ্রগুলো খোলারও ঘোষণা দেয়া হয়েছে। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গেলেই করোনা ছড়াবেÑবিষয়টি এভাবে দেখা হচ্ছে কী?

গত ১০-১৫ দিন ধরে করোনা সংক্রমণ আবার কমতির দিকে। এ অবস্থায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা মনে করেন, ছুটি আর না বাড়িয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যত দ্রুত সম্ভব খুলে দেয়া উচিত। বাংলাদেশের চেয়ে সংক্রমণ বেশি এমন দেশও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এক পা সামনে এগোয় তো তিন পা পিছিয়ে যায়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে গ্রীষ্মকালীন ছুটি শেষ হওয়ার প্রেক্ষাপটে গত ২৪ আগস্ট ইউনিসেফ প্রকাশিত নতুন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে উত্তর আমেরিকার দেশ পানামায়। এ তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে আছে বাংলাদেশ।

সরকার বেশ কয়েকবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও সে প্রতিশ্রুতি পূরণে সফল হতে পারেনি। বরং বারবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষিত তারিখ পেছানো হয়েছে। একপর্যায়ে বেশ জোর দিয়েই বলা হয়েছিল চলতি বছরের ১২ জুনের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আংশিকভাবে খুলে দেয়া হবে। সে প্রতিশ্রুতিও রক্ষা করা হয়নি। বরং ৩০ জুন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি নতুন এক ঘোষণায় তার পূর্বপ্রতিশ্রুতি থেকে পিছু হটে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সময় আরও বাড়িয়ে দেন। বলা হয়, দেশে করোনা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় সরকার এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন- জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে জীবন থেমে থাকেনি, কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে মাসের পর মাস। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৭ আগস্ট সচিবদের সঙ্গে এক ভার্চুয়াল বৈঠকে ‘করোনাভাইরাস পরিস্থিতির উন্নয়ন’ ও ‘টিকাদান পরিস্থিতি’ এ দুটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এ বৈঠকে তিনি আরও বলেন, ১৮ বছরের বেশি বয়সী শিক্ষার্থী ও বয়স্কদের টিকাদান যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি সম্পন্ন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার পরও জনমনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিগগির খুলে দেয়া নিয়ে সংশয় কাটেনি। কারণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা ছিল শর্তসাপেক্ষে। আমাদের শিক্ষার্থীদের মাঝে অধিকাংশই কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন গ্রহণ করতে সক্ষম হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে যদি আমরা সব শিক্ষার্থীকে ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে এসে তারপর শিক্ষাঙ্গন খোলার পরিকল্পনা করি, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে আরও প্রায় এক বছর শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হবে। সরকারকে মাথায় রাখতে হবে, দীর্ঘদিন ধরে বারবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার তারিখ পিছিয়ে নেয়ার ফলে শিক্ষার্থীদের যে অপূরণীয় ক্ষতিটা হচ্ছে, তা আর চলতে দেয়া যায় না।

লেখক : মোহাম্মদ আবু নোমান


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0024499893188477