ছেলেটাকে বাঁচাতে একজন মানুষও কি ছিল না

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

আমি বুয়েটে শুরুতে ছিলাম শেরেবাংলা হলে। কিছুদিন পর চলে যাই শহীদ স্মৃতি হলে। শহীদ স্মৃতি হলে চলে যাওয়ার পরও শেরেবাংলা হলে অনেক গিয়েছি। বুয়েটের হলগুলো সব পাশাপাশি। সব হলেই সবার বন্ধুবান্ধব আছে। কোনো বন্ধুর সঙ্গে একসঙ্গে বসে পড়াশোনা করতে, হলের ক্যান্টিনে বিকেলের নাশতা করতে, কমনরুমে পত্রিকা পড়তে, দাবা খেলতে বা টেবিল টেনিস খেলতে এক হলের ছেলেরা অন্যান্য হলে নিয়মিতই যাওয়া-আসা করে। এ রকম চেনা একটা হলের চেনা সিঁড়িতে এই হলেরই একটা ছেলের মৃতদেহ পড়ে আছে—খবরটা শুনেই শিউরে উঠলাম। কোনো খুনের খবর শুনলেই তো বুকের ভেতর একটা ধাক্কা লাগে। আর সেটা যদি হয় কোনো অতি পরিচিত স্থানে, তখন বুকের ভেতর একটা মোচড় দিয়ে ওঠে। শুক্রবার (১১ অক্টোবর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও বলা হয়, এতক্ষণে সবাই জেনে গেছেন, খুনিরা ছেলেটাকে শেরেবাংলা হলের ভেতরেই পিটিয়ে মেরে সিঁড়িতে ফেলে রেখেছে। তা-ও আবার দিনদুপুরে। হ্যাঁ, দিনদুপুরেই। বুয়েটের হলে তো রাত ২টা-৩টার আগে রাত হয় না। আমাদের সময় হলের ছাত্রদের একটা বড় অংশ রাত ৩টার আগে ঘুমাতে যেত না। আমিও তাদের একজন। তিতুমীর হলের জব্বার ভাই মাঝরাতের পরে রুমে রুমে চা বিক্রি করতে আসতেন। যতটুকু জানা গেছে, আবরারকে তারা রাত ৮টার দিকে তার রুম থেকে ডেকে অন্য একটা রুমে নিয়ে গেছে এবং সেখানেই পিটিয়ে মেরেছে। আমার জন্য এটা বিশ্বাস করা খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে। পাঁচ বছরেরও বেশি সময় আমি বুয়েটের হলে ছিলাম। কখনোই আমি কাউকে মারামারি করতে দেখিনি। সিনিয়র ভাইয়ারা, ছাত্রনেতারা হুমকি-ধমকি দূরে থাক, হাসিমুখ ছাড়া জুনিয়রদের সঙ্গে কথা বলেননি। ভিন্ন ভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতারা একসঙ্গে মিলে চা খাচ্ছেন, খেলছেন, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করছেন—এ ছিল প্রতিদিনের নিয়মিত দৃশ্য। রুহুল ভাই যেদিন নৌবিহারে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা গেলেন, সেদিনও তাঁর সঙ্গে অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের নেতারাও ছিলেন। তাঁদের মধ্যে কি রাজনৈতিক মতপার্থক্য ছিল না? অবশ্যই ছিল। তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ ছিলেন। কিন্তু সৌজন্য ও বন্ধুত্ব তাঁদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এটা হয়তো বিশ্বাসই করবে না। সেই বুয়েটে এ ঘটনা কিভাবে ঘটল?

ঘটনার এক দিনের মধ্যেই এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে বুয়েট ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী আবরারকে তাঁর রুম থেকে ডেকে নিয়ে জেরা করেছে এবং পিটিয়েছে। তারা আবরারের কাছে জানতে চেয়েছে সে ফেসবুকে কী লেখে আর কোথায় লাইক দেয়। একজন মানুষ কী লেখে, কোথায় লাইক দেয়, তা নিয়ে একটা ছাত্রসংগঠনের কিছু নেতাকর্মীর কাছে জবাবদিহি করতে হবে কেন? সে যদি দেশের আইনবহির্ভূত কিছু করে থাকে, তার জন্য দেশের বিচারব্যবস্থা আছে। আর সরকারের সমালোচনা তো অন্যায় কাজ নয়। সরকারের নীতি ও কাজের সমালোচনা করা দেশের প্রত্যেক নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। প্রত্যেক নাগরিকের মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। ভিন্নমতের উপস্থিতি যে খুব স্বাভাবিক শুধু তা-ই নয়, ভিন্নমতের অনুপস্থিতি খুবই ভয়ংকর। এটা কি এই খুনিরা জানত না? তাহলে তারা রাজনীতি করে কী শিখেছে?

আরো দুটি প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে। ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ দেখে বোঝা যাচ্ছে, কমপক্ষে ছয়-সাতজন এই খুনের ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। তাদের মধ্যে কি একজনও মানুষ ছিল না, যে ছেলেটাকে বাঁচাতে পারত? আবরার যে কয়েকটা ছোট পোস্ট ফেসবুকে লিখেছে, সেগুলোকে যুক্তি দিয়ে ভুল প্রমাণ করে একটা লেখা কি এই ছয়-সাতজন মিলেও লিখতে পারেনি।

মালেক খান : সহকারী অধ্যাপক, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগ, টেক্সাস এ অ্যান্ড এম ইউনিভার্সিটি, কিংসভিলে


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে খাড়িয়া ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণের আহবান প্রধান বিচারপতির - dainik shiksha খাড়িয়া ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণের আহবান প্রধান বিচারপতির উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষক হতে চান না শিক্ষক দম্পতিদের কৃতী সন্তানরা - dainik shiksha শিক্ষক হতে চান না শিক্ষক দম্পতিদের কৃতী সন্তানরা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025651454925537