জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বই কেনার তালিকায় এক সচিবের ২৯ বই

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে ‘জ্ঞানচর্চা ও পাঠাভ্যাস’ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। জেলা-উপজেলায় বই কিনতে ৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে পাঠানো হয়েছে ১ হাজার ৪৭৭টি বইয়ের তালিকা। এরই মধ্যে বই কিনতে শুরু করেছেন জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা। তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো তালিকার মধ্যে একজন অতিরিক্ত সচিবেরই রয়েছে ২৯টি বই। শনিবার (২৭ আগস্ট) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন সাদিয়া মাহ্‌জাবীন ইমাম। 

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, তালিকার ১ হাজার ৪৭৭টি বইয়ের মধ্যে শতাধিক বই অন্তত ২৫ জন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তার লেখা। যার মধে৵ অনেক বইয়ের প্রসঙ্গ একই। তালিকায় আছে আইনকানুন, দাপ্তরিক বিভিন্ন জরুরি প্রসঙ্গ, ইতিহাস ও দর্শনের প্রয়োজনীয় অনেক বই। তবে এ তালিকায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখকের বই স্থান না পাওয়ায় নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন এসেছে।

তালিকা খতিয়ে দেখা গেছে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে থাকা ১৬৬টি শিরোনামের মধ্যে অন্তত ৪০টি বই আছে, যা ১৫ জন সরকারি কর্মকর্তার লেখা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বই কেনার এই উদ্যোগ নিয়ে কোনো কমিটিও গঠিত হয়নি। এমনকি বৈঠকে ডাকা হয়নি বই বা পাঠাগারসংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তিকে। এসব বই সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কোথায় কীভাবে রাখা হবে তা নিয়েও এখন মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ভাবতে হচ্ছে।

কোনো ধরনের বাছাই কমিটি ছাড়া এমন তালিকা তৈরি করে বই কেনা এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারি কর্মকর্তাদের বই পড়ানোর জন্য এত টাকা খরচ কতটা প্রয়োজন এবং এর উদ্দেশ্য কতটা ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের কাছে এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পরিকল্পনার গোড়ায় গলদ। সব শুনে মনে হচ্ছে, বই পড়ানোর চেয়ে বিক্রির টাকা পকেটে যাওয়াই বেশি গুরুত্বপূর্ণ । সরকারি কর্মকর্তারা কি অফিস বাদ দিয়ে বই পড়বেন? অনেক ভালো লেখক জায়গা পাচ্ছেন না; কিন্তু একজন অতিরিক্ত সচিবের এত বই একটি তালিকায় থাকা তো রীতিমতো অপরাধ। ২৯টি বই থেকে তিনি কত উপার্জন করেছেন দুদকের তদন্ত করা উচিত। আর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ওপর যেনতেনভাবে একটি বই লিখেই লেখকের তালিকায় নাম জায়েজ করা যায় না।’

এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে গত অর্থবছরের (২০২১-২০২২) শেষ সময়ে। কোনো ধরনের প্রকল্প ছাড়াই মন্ত্রণালয়ের ‘বইপত্র ও সাময়িকী’ খাত থেকে বই কিনতে দেশের ৪৯২ উপজেলা কার্যালয়ের জন্য দেড় লাখ টাকা, ৬৪ জেলা প্রশাসক ও ৮ বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের জন্য তিন লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। দেশব্যাপী সরকারি কর্মকর্তাদের পরবর্তী তিন অর্থবছরেও একইভাবে বই পড়ানোর পরিকল্পনা আছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের।


ভিন্ন ভিন্ন নির্দেশনা ও নির্দিষ্ট প্রকাশনীর নাম

কুড়িগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা, বান্দরবান, সিলেট, রাজশাহী, খাগড়াছড়ি, ফরিদপুর জেলার অন্তত ১৫ জন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বই কেনার ক্ষেত্রে দুই রকমের নির্দেশনা দিয়ে চিঠি গেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে। তারা কেউ চিঠি পেয়েছেন দুটি, কেউ একটি। এর মধ্যে ৫ জুন উপসচিব স্বাক্ষরিত চিঠিতে প্রথম শর্তে আছে ‘শুধুমাত্র প্রেরিত তালিকা অনুযায়ী বই ক্রয় করতে হবে।‌’ ১৬ দিন পরই ২১ জুন স্বাক্ষরিত দ্বিতীয় চিঠিতে বদলেছে শুধু একটি বাক্য। প্রেরিত তালিকার জায়গায় লেখা হয়েছে ‘যথাসম্ভব সংযুক্ত তালিকা’ অনুযায়ী বই ক্রয়ের কথা। চিঠি দুটি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ভিন্ন ভিন্ন তারিখে স্বাক্ষর করলেও চিঠির খসড়া তৈরির তারিখ দেখানো হয়েছে একই কার্যদিবস ২৩ মে।

চিঠিতে স্বাক্ষরকারী উপসচিব মোহাম্মদ আশফাকুল হক চৌধুরী ২১ জুন স্বাক্ষরিত চিঠিটি দেখিয়ে জানান, যথাসম্ভব তালিকা থেকে কিনতে বলার চিঠিটি পাঠিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু দেশের একাধিক ইউএনওর কাছ থেকে পাওয়া গেছে মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো শুধু প্রেরিত তালিকা থেকে বই কেনার শর্ত দেওয়া প্রথম চিঠিটি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ইউএনও জানান, শর্তের ভাষা যা–ই থাকুক, কেন্দ্রীয় অফিসের তালিকার ব্যাপারে স্থানীয় কর্মকর্তাদের অলিখিত বাধ্যবাধকতা থাকেই।

তালিকার সঙ্গে মন্ত্রণালয় থেকে ইউএনওদের কাছে গেছে দুটি প্রকাশনীর বইয়ের তালিকাও। যাদের কাছ থেকে বই কেনার মৌখিক নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে। তবে কোনো কোনো ইউএনও জানান, তালিকা অনুসরণ করেও কিছু বই নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী কিনছেন বিভিন্ন লাইব্রেরি থেকে। আর বই রাখার জন্য নতুন করে ‘বুকশেলফ’ তৈরি করছেন তাঁরা।

তালিকায় নেই গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের বই
তালিকায় রয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. নবীরুল ইসলামের লেখা ২৯টি বই, যার অধিকাংশই কবিতার বই। এর মধ্যে ২৪টি প্রকাশিত হয়েছে মাত্র একটি প্রকাশনী থেকেই। তাঁর বইগুলোর মধ্যে রয়েছে চলো এক সঙ্গে জলে রাখি পা, মুগ্ধ আলোয় দাঁড়িয়ে, অবাধ্য ইচ্ছের কম্পন।

বইয়ের নাম নির্বাচন প্রসঙ্গে নবীরুল ইসলাম বলেন, ‘কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের পাঠাগারের দুই হাজার বইয়ের তালিকা এনে সম্পাদনা করে বানানো হয়েছে এটি। এরপর সচিব স্যার তালিকা দেখে সম্মতি দিয়েছেন।’

বই কেনার জন্য কোনো কমিটি গঠন না করার বিষয়ে নবীরুল ইসলামের বক্তব্য, ‘এটা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত। এখানে বাইরে থেকে কাউকে ডাকার তো প্রয়োজন নেই। আমার দায়িত্বে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাই মিটিং করে নির্ধারণ করেছেন বইয়ের নাম। কিছু হলেও বই সম্পর্কে আমার নিজের তো ধারণা আছে।’

তালিকায় একজন সংসদ সদস্যের চারটি বই আছে, যার তিনটির প্রসঙ্গ একই। এতে উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের একাধিক বই স্থান পেয়েছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন আবু হেনা মোরশেদ জামান, মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক, সমীর কুমার বিশ্বাস।

তালিকায় জায়গা হয়নি পল্লিকবি জসীমউদ্‌দীন, আবু জাফর শামসুদ্দীন, ঔপন্যাসিক শওকত আলী বা বদরুদ্দীন উমরের মতো গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের একটি বইও। ভাষা আন্দোলন–সম্পর্কিত বইয়ের সংখ্যা মাত্র ১১।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিভাগীয় কমিশনার আর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে চার হাজার বই আর ইউএনওর কার্যালয়ে দুই হাজার বইয়ের পাঠাগার তৈরির পরিকল্পনা আছে বলে জানান নবীরুল ইসলাম। এত টাকার বই এভাবে সরকারি কর্মকর্তাদের প্রাধান্য দিয়ে কেনা ঠিক কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, তালিকা দেওয়া হয়েছে শুধু ধারণা দিতে। যাতে মানহীন বই কিনে না বসেন কর্মকর্তারা। এ ছাড়া দেশের শিল্প–সাহিত্য জগতে যে সরকারি কর্মকর্তাদেরও অবদান আছে, তা সামনে আনা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

কতটা সফল হবে উদ্দেশ্য
বইগুলো থাকবে শুধু সরকারি কার্যালয়ের পাঠাগারে। কার্যালয়ের কর্মকর্তা ও অফিস–সংশ্লিষ্টরাই শুধু পড়তে পারবেন। মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে উল্লেখ আছে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেশাদারি, বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানচর্চা ও পাঠাভ্যাস জোরদার করতেই এ উদ্যোগ। কিন্তু কর্মদিবসের মধ্যে কখন তাঁরা বই পড়বেন, এ নিয়ে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। ফলে উঠে এসেছে এভাবে অর্থ বরাদ্দের আগে পুনর্মূল্যায়নের কথা।

এসব প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হয়েছিল সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খানের কাছে।তিনি বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে বই কেনার পর কোনোবার মূল্যায়ন হয়েছে বলে আমার অন্তত জানা নেই। অথচ বই কেনা নিয়ে নানারকম অভিযোগ বহু বছর ধরেই ঘটছে। স্বচ্ছ উপায় বের করতে হলে বই কেনার পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে সরকারের মূল্যায়ন করা উচিত। তাহলে যদি কিছুটা ইতিবাচক ফল হয়।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025861263275146