বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব দৃশ্যমান। কোনো অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা, কোনো স্থানে দাবানল, কোথাও আবার খরা- এ যেনো জলবায়ু পরিবর্তনের বহুমাত্রিক ও ভয়াবহ রূপ। জলবায়ু পরিবর্তনের বহুমুখী প্রভাবের মধ্যে অবাক করা খবর হলো, গত বছরের ৩ জুলাই ইতিহাসের রেকর্ডকৃত উষ্ণতম দিন দেখেছে বিশ্ব। এদিন বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ছিলো ১৭ দশমিক শূন্য ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ তথ্য জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল প্রেডিকশন সংস্থা। জলবায়ু পরিবর্তনের এই ভয়াবহ প্রভাবের মধ্যে শুরু হয়েছে ‘এল নিনো’র প্রভাব। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভুগতে হচ্ছে বিশ্বকে। বাংলার প্রকৃতিতে বৃষ্টির অভাবে কখনো খরা আবার অসময়ে অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে কখনো বন্যা। জাতিসংঘের আবহাওয়া বিষয়ক সংস্থা (ডব্লিউএমও) জানিয়েছে, চলতি বছর জুড়ে এল নিনোর প্রভাব বহাল থাকবে। এল নিনোর প্রভাবে বিশ্ব জুড়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। বাস্তবতা হলো, প্রকৃতি তার ভারসাম্য রক্ষা করে চলে। প্রকৃতির সঙ্গে যেমন আচরণ করা হবে প্রকৃতি ঠিক তেমনটাই ফিরিয়ে দিবে। পৃথিবী নামক এই ছোট্ট গ্রহে প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকা এক প্রকার অসম্ভব।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সব দেশে সমান ভাবে পড়েনি। ঘূর্ণিঝড়, দাবানল, খরা ও বন্যার প্রভাব একেক দেশে একেক রকম। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বিশ্বের সমুদ্র উপকূলের দেশসমূহ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করা হচ্ছে। জাতিসংঘের তথ্য মতে, ২০৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ১৭ ভাগ এলাকা তলিয়ে যাবে। দিনে দিনে স্থলভাগ ও সাগরের তাপমাত্রা বাড়ছে। মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিগর্মনের দায় উন্নত দেশসমূহ এড়াতে পারে না। জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বৈশ্বিক তাপমাত্রার বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস সীমিত রাখার লক্ষ্য থেকে বিশ্ব ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার কারা? উত্তর হলো- নারী। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নারীরা যেমন ভুক্তভোগী তেমনি সমস্যা মোকাবিলায়ও তারা ভূমিকা রাখছে বেশি। এমনিতেই বিভিন্ন সামাজিক পরিস্থিতিতে নারীরা পুরুষের তুলনায় বেশি সমস্যার মুখোমুখি হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ঠ কোনো দুর্যোগ সেইসব সমস্যাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। বন্যা বা খরার মতো দুর্যোগে নারীদেরকেই সমস্যায় বেশি পড়তে দেখা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষের তুলনায় নারী কম আর্থসামাজিক মর্যাদা ভোগ করেন। অসচ্ছল পরিবারে শিশু সন্তানদের বেশিরভাগ দায়িত্ব নারীকেই সামলাতে হয়। গ্রামের নারীরা জলবায়ু পরিবর্তন দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত। জাতিসংঘের গবেষণা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনে যে মানুষজন বাস্তুচ্যুত হয়েছে তাদের আশি শতাংশই নারী। জলবায়ু পরিবর্তনে যে সমস্যা প্রবলভাবে দেখা দিয়েছে তা হলো বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব। খরার কারণে বিশুদ্ধ পানির উৎসগুলো দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, বরগুনা ও পিরোজপুরের উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বেড়েই চলেছে। কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত নারীরা এখন পেশা বদল করতে বাধ্য হচ্ছেন। লবণাক্ততার কারণে বিশুদ্ধ পানীয় জল পাচ্ছেন না তারা। বিশুদ্ধ পানি দূর দূরান্ত থেকে সংগ্রহ করতে হচ্ছে। আবার ক্ষেত্র বিশেষ বিশুদ্ধ পানীয় জল সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না। বাধ্য হয়েই লবণাক্ত পানি পান করতে হচ্ছে নারী ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে অসচ্ছল পরিবার আরো বেশি অসচ্ছল হয়ে পড়ছে। উপকূলীয় অনেক এলাকায় গভীর নলকূপ বসিয়ে পানি উত্তোলন করে বিক্রি করা হচ্ছে। অর্থ সংকটে অসচ্ছল পরিবারগুলো পানি কিনে খেতে পারছে না। এককথায়, উপকূলীয় এলাকায় বৈষম্য দিন দিন প্রকট হচ্ছে। জলবায়ুগত সমস্যার কারণে পৃথিবীর স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে সমস্যাসমূহ মোটামুটি একই ধরনের। সোমালিয়ার শাবেলা অঞ্চলের নারীদের পানি সংগ্রহ করতে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় নষ্ট করতে হচ্ছে। মধ্য আফ্রিকায় লেক চাদের ৯০ শতাংশ শুকিয়ে যাওয়ায় পানি সংকটে সেখানকার নারীরা ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন। জলবায়ুগত সমস্যায় জর্জরিত পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের জলবায়ুকবলিত নারীদের সমস্যা কোনো অংশে কম নয়। বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাবে উপকূলীয় এলাকায় নারীদের বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। লবণাক্ত পানি পান করার কারণে নারীর গর্ভপাতের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। লবণাক্ত পানিতে মাছ ধরতে ধরতে অনেক নারী নানাবিধ স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। জলবায়ুগত অভিঘাত নারী ও শিশু পাচারের মতো সমস্যাকে ত্বরান্বিত করছে। অতি সম্প্রতি জাতিসংঘের দুই সংস্থা জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তৈরি প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে পানি সংগ্রহে নারীদের দায়বদ্ধতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় ১০ গুণ বেশি। পানি সংগ্রহের কাজে নারীদের সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় করতে হয় যেসব দেশে, বাংলাদেশ সেসব দেশের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। জলবায়ুগত সমস্যা উপকূলের নারীদেরকে পরিবেশগত, স্বাস্থ্যগত ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে দিচ্ছে। অনেক পরিবার বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে সমস্যা সমাধানের কোনো রকম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জলবায়ু সমস্যায় টিকতে না পেরে শহরে জলবায়ু শরণার্থী বাড়ছে। তথ্য বলছে, প্রতিদিন ঢাকা শহরে প্রায় ২ হাজার মানুষ বসবাস ও কর্মসংস্থানের জন্য আসছে। এর এক-চতুর্থাংশ জলবায়ু শরণার্থী। এসব জলবায়ু শরণার্থীরা কোনো রকমে রেললাইনের পাশে কিংবা বস্তিতে আশ্রয় নিচ্ছেন। এসব উদ্বাস্তু পরিবারে নারীকেই বেশি সংগ্রাম করতে হচ্ছে।যেসব দেশ বা যেসব দেশের নারীদের জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা নেই বললেই চলে তাদের কেনো ভয়াবহ ফল ভোগ করতে হবে? সাতক্ষীরার শ্যামনগরের সখিনা খাতুন কিংবা খুলনার দাকোপের ময়না বিবি হয়তো জানেন না তাদের এই পরিণামের জন্য কারা দায়ী। তবু জলবায়ুগত সমস্যায় জর্জরিত হয়েও ভুক্তভোগী নারীরা টিকে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের এ সংগ্রাম মূলত সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। যারা জীবাশ্ম জ্বালানির উৎপাদন বাড়িয়ে দিয়ে পুঁজির পাহাড় গড়ছে। জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কিংবা জলবায়ু সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বৈশ্বিক আলোচনায় ভুক্তভোগী নারীদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো নয়। পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ সেটার জানার জন্য জলবায়ু সংক্রান্ত সব দেশি-বিদেশি সম্মেলনে বা সেমিনারে ভুক্তভোগী নারীদের অধিক মাত্রায় অংশগ্রহণ সবেচেয়ে বেশি জরুরি। সমস্যা মোকাবিলার সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। জলবায়ুগত সমস্যা যেভাবে জেঁকে বসছে তাতে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য যে কী অপেক্ষা করছে তা সময়-ই বলবে। তবে এতে নারীদের যে আরো বেশি ভোগাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সমাজের বৃহৎ অংশ নারীদের সমস্যার মধ্যে জর্জরিত রেখে টেকসই উন্নয়ন কী সম্ভব? বৃক্ষরোপণ, বৃষ্টির পানি সংগ্রহের ব্যবস্থা, উপকূলীয় টেকসই বাঁধ নির্মাণ, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার, অভিযোজন ও সচেতনার মতো বিষয়গুলোতে এখনই জোর না দিলে বাংলাদেশের উপকূল টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। উপকূলের নারীদের এই জীবন সংগ্রাম আমাদের এগিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় প্রেরণা। উপকূলের সহজ-সরল নারীরা সংগ্রাম করতে করতে একসময় সৃষ্টিকর্তার কাছে অভিযোগ দিয়ে নিয়তি মেনে নিয়ে হয়তো থেমে যাবে কিন্তু তার পরও কী জলবায়ু সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব হবে? জলবায়ু ন্যায়বিচারের দাবি জোরালো হচ্ছে। ভুক্তভোগী নারীরা এখন ন্যায়বিচার চান। জলবায়ুগত সমস্যায় জর্জরিত নারীর অভিযোগের কথা শুনতে হবে। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তাদের সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিতে হবে। নারীর ক্ষমতায়ন ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।
লেখক: জলবায়ু ও পরিবেশকর্মী
সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)