বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক জহির রায়হান এর জন্মদিন আজ। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে ফেনী জেলার মজিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মওলানা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ কলকাতা আলীয়া মাদরাসার অধ্যাপক এবং ঢাকা আলীয়া মাদরাসার অধ্যক্ষ ছিলেন। জহির রায়হান কলকাতায় মিত্র ইনিস্টিউটে এবং পরে আলীয়া মাদরাসায় পড়ালেখা করেন। ভারত বিভাগের পর তিনি তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিজ গ্রামে চলে আসেন। জহির রায়হান ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে আমিরাবাদ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং ঢাকায় এসে কলেজে ভর্তি হন। তিনি আইএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বাংলায় স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন। অল্প বয়সেই জহির রায়হান কম্যুনিস্ট রাজনীতিতে আকৃষ্ট হন। তখন কম্যুনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিলো। তিনি কুরিয়ারের দায়িত্ব পালন করতেন অর্থাৎ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চিঠি ও সংবাদ পৌঁছে দিতেন। গোপন পার্টিতে তার নাম রাখা হয় ‘রায়হান’। তার আসল নাম ছিলো জহিরুল্লাহ। পরবর্তী সময়ে তিনি জহির রায়হান নামে পরিচিত হন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন। ২১ ফেব্রুয়ারি যে ১০ জন প্রথম ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেন তিনি তাদের অন্যতম। অন্যান্যদের সঙ্গে তাকে মিছিল থেকে গ্রেফতার করে কারারুদ্ধ করা হয়।
ছাত্রজীবনেই তিনি লেখালেখিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। ১৩৬২ বঙ্গাব্দে তার প্রথম গল্পসংগ্রহ সূর্যগ্রহণ প্রকাশিত হয়। তার লিখিত অন্যান্য বইগুলো হচ্ছে ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’, ‘হাজার বছর ধরে’, ‘আরেক ফাল্গুন’, ‘বরফ গলা নদী’ এবং ‘আর কত দিন’। তিনি ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ইংরেজি পত্রিকা দ্য উইকলি এক্সপ্রেস প্রকাশের উদ্যোক্তাদের অন্যতম। এ ছাড়া তিনি কিছু সাহিত্য পত্রিকার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। হাজার বছর ধরে উপন্যাসের জন্য তিনি আদমজী পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে তাকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেয়া হয়।
জহির ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ফটোগ্রাফি শিখতে কলকাতা যান এবং প্রমথেশ বড়ুয়া মেমোরিয়াল স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চলচ্চিত্রে প্রবেশ করেন। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে তার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘কখনও আসেনি’ মুক্তি পায়। তারপর একের পর এক তার নির্মিত চলচ্চিত্র মুক্তি পেতে থাকে। এসব চলচ্চিত্র হলো: কাজল, কাঁচের দেয়াল, বেহুলা, জীবন থেকে নেয়া, আনোয়ারা, সঙ্গম এবং বাহানা। জীবন থেকে নেয়া ছবিতে প্রতীকী কাহিনীর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসনকে চিত্রিত করা হয় এবং জনগণকে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে উদ্বুদ্ধ করা হয়।
তিনি ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ নামে একটি ইংরেজি ছবি নির্মাণ শুরু করেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় তিনি তা শেষ করতে পারেন নি। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের পর তিনি কলকাতায় যান। সেখান থেকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার গণহত্যার চিত্র সম্বলিত ‘স্টপ জেনোসাইড’ নির্মাণ করেন। ছবিটি পৃথিবী জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
জহির রায়হানের উর্দু ছবি সঙ্গম ছিলো পাকিস্তানের প্রথম রঙিন ছবি। তার অপর উর্দু ছবি বাহানা ছিলো সিনেমাস্কোপ। তিনি ‘কাঁচের দেয়াল’ ছবির জন্য অনেক পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চলচ্চিত্র অভিনেত্রী সুমিতা দেবীকে বিয়ে করেন। ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে অপর চলচ্চিত্র অভিনেত্রী সুচন্দাকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে জহির রায়হানের বড় ভাই প্রখ্যাত লেখক শহীদুল্লা কায়সার কে অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তরা তার বাসভবন থেকে তুলে নিয়ে যায়। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর তিনি খবর পান যে, শহীদুল্লা কায়সারকে ঢাকার মিরপুরে রাখা হয়েছে। তিনি তাকে উদ্ধারের জন্য সেখানে যান। কিন্তু তিনি আর ফিরে আসেননি। ঐ দিনটি জহির রায়হানের অন্তর্ধান দিবস হিসেবে পালন করা হয়।